মীনা কুমারী নায ।। নিঃসঙ্গ আকাশে একা চাঁদ ।। জাভেদ হুসেন

বোম্বের ‘পাকিযা’ ছবির কথা মনে আছে আপনাদের? সামনে খোলা জায়গা, সিঁড়ি বেয়ে উঠে উঁচুতে গানের আসর বসেছে। নায়িকা সামনের দিকে আঙুলে ইশারা করে গান শুরু করলেন “ঠারে রহিও ও বাকেঁ য়ার রে”। একটু দাঁড়াও ও আমার বাঁকা শ্যাম। কাকে দাঁড়াতে বলা হচ্ছে? আসরের সবাই ঈর্ষায় ঘুরে তাকালেন। দেখা গেল আকাশে হাঁসছে বাঁকা চাঁদ।
ঠারে রহিও গানটি শুনতে ক্লিক করুন
ইনি মীনা কুমারী। জন্মেছেন মাহযাবিন বানো নামে। আলী বখশ আর ইকবাল বেগমের ঘরে। ১৯৩৩ সালে। বাবা মা দুজনই পারশি থিয়েটারের শিল্পী। বাবা হারমোনিয়াম বাজান, গান শেখান আর উর্দু কবিতা লেখেন। সিনেমাতে ছোট চরিত্রে অভিনয়ও করেন, গানে সুর দেন। কিন্তু সংসার চলে না। তৃতীয় কন্যা মাহযাবিনের জন্মের পর ডাক্তারের ফি দেয়ার পয়সা ছিল না। ঝামেলা এড়াতে সদ্যজাত মেয়েকে এতিমখানায় দিয়ে এলেন।
মাহযাবিনের কোন শৈশব ছিল না। বাবা এতিমখানা থেকে নিয়ে এলেন। কিন্তু স্কুল যাওয়া হলো না। এ নিয়ে সারা জীবন দুঃখ ছিল। ৪ বছর বয়সে সিনেমায় অভিনয় করা শুরু করতে হলো বাবা মার চাপে। নাম হলো বেবি মীনা। সেই তখন পরিবারের উপার্জন করা সদস্য। ১৩ বছর বয়সে প্রথম নায়িকা হিসেবে কাজ শুরু করেন।

২১ বছর বয়সে অভিনয় করেন কাল্ট ফিল্ম ‘ব্যায়জু বাওরা’তে। ফিল্ম ফেয়ার এওয়ার্ড পান। ১৯৬৩ সালে সবগুলো শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর মনোনয়ন পান তিনি।
১৯৫২ সালে পরিচয় ঘটলো আরেক প্রতিভা কামাল আমরোহির সাথে। ‘মুঘলে আযম’ ছবির পরিচালক। দুজনের প্রেম হলো। মাহযাবিন লিখলেন:

আগায তো হোতা হ্যায় আনযাম নেহিঁ হোতা
জাব মেরি কাহানি মেঁ ও নাম নেহিঁ হোতা

(শুরু যদিও হয়, শেষ তো হয় না
যদি আমার গল্পে না আসে সেই নাম)

গানটি শুনতে ক্লিক করুন

কামাল তাঁকে ‘আনারকলি’ ছবিতে অভিনয়ের আমন্ত্রণ জানালেন। কিন্তু এর মধ্যে তিনি গাড়ী দূর্ঘটনায় বাঁ হাতের কড়ে আঙুল হারালেন। এরপর থেকে সব ছবিতে সেই আঙুল আড়াল করে শুটিং হয়েছে। ১৯৫২ সালে দুজন বিয়ে করলেন গোপনে। মেয়ের বাবা নারাজি, ওদিকে কামালের আছে স্ত্রী, তিন সন্তান।


কামালের সঙ্গে বিয়ে স্বস্তি আনলো না। সৈয়দ বংশের নয় বলে মীনার সঙ্গে কোন সন্তান নিতে তিনি রাজি হলেন না। দুই জন একে অপরের কাছে ক্রমেই অবোধ্য হয়ে উঠতে লাগলেন। মীনাজির উপলব্ধি হলো:

হামসফর কোয়ি মিলে ভি তো কাহিঁ
দোনো চলতে রহে তানহা তানহা

(কোথাও যদি কোন সঙ্গী মিলেও যায়
দুজনেই চলেছি একই পথে একা একা)

দিল তোড় দিয়া উস নে য়ে ক্যাহ কে নিগাহোঁ সে
পাত্থার সে টকড়ায়ে ও জাম নেহিঁ হোতা

(দৃষ্টির ভাষায় হৃদয় ভাঙল সে এই কথা বলে
পাথরে ঠোকর খাওয়া কাঁচের পানপাত্রের কাজ নয়)

অথচ কামাল আমরোহির কাছে তাঁর চাওয়া ছিল খুব স্পষ্ট আর সরল:

যিন্দেগি ইক বেরংগ কাতরা হ্যায়
তুমহারে দামন কি পানাহ পাতে তো আঁসু হো জাতা

(জীবন এক রঙহীন একবিন্দু জল
তোমার আঁচলের আশ্রয় পেলে সে অশ্রু হয়ে যেত)

১৯৬০ সালে আলাদা হয়ে ১৯৬৪ তে পাকাপাকি আইনি বিচ্ছেদ হলো। মাহযাবিন বানো এবার মীনা কুমারী নায হয়ে মদিরাতে আশ্রয় খুঁজলেন। সঙ্গে জন্ম নিলো কবিতা। প্রবাদপ্রতীম সুরকার নওশাদ বলেছেন – “মীনা তাঁর জীবনে সব সময় কারো না কারো স্বার্থে কাজে লেগেছেন। এই বেদনা আর হতাশাবোধ থেকে আশ্রয় নিয়েছেন মদ আর কবিতার”। কিন্তু কবিদের জগতও তাঁকে অস্বীকার করলো ফিল্মের নাচনেওয়ালি বলে। বিখ্যাত কবি ফিরাক গোরাখপুরি মুশায়রায় মীনা কুমারীর উপস্থিতিতে কবিতা পড়তে অস্বীকার করলেন – এ কি বাইজির নাচের আসর?

Meena Kumari with Pradeep Kumar in “Aarti”

উর্দু কাব্য ঐতিহ্য বরাবরই মানুষকে সীমিত করে ফেলার কাঠামো আর পদ্ধতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। মীনা কুমারী নায সেই ঐতিহ্যে যোগ দিলেন। পাদপ্রদীপের আলো থেকে সরে এসে দেখলেন কত সহজে তাঁর বাইরের জনপ্রিয় খোলস ‘নায়িকা’র মৃত্যু হতে পারে। তিনি তা মেনেও নিয়েছেন:

আয়াদত হোতি জাতি হ্যায় ইবাদত হোতি জাতি হ্যায়
মেরে মরনে কি দেখো সব কো আদত হোতি জাতি হ্যায়

(খবর নিতে আসার ছলে তোমাদের পূণ্য হয়ে যায়
দেখো, আমার মৃত্যুতে সবার কেমন অভ্যাস হয়ে যায়)

নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করবার মাঝ দিয়ে যখন নিজের থাকবার প্রমাণ খুঁজতে হয়, সে বড় নির্মম মুহুর্ত! মির্জা গালিব এমন প্রসঙ্গে বলেছিলেন:

দোস্ত মেরি গমখোয়ারি মেঁ সয়ি ফরমাওয়েঙ্গে কেয়া
যখম কে ভরনে তলক নাখুন না বাঢ় আওয়েঙ্গে কেয়া

(বন্ধুরা আমার দুঃখনিদানে কি সঙ্গ দেবে?
জখম সারার আগেই কি নখ আবার বড় হয়ে যাবে না?)

নায লিখলেন:
খুদ হি কো তেয নাখুনোঁ সে হায় নোচতে হ্যাঁয় আব
হামেঁ আল্লাহ খুদ সে ক্যায়সি উলফত হোতি জাতি হ্যাঁয়

(তীক্ষ্ণ নখে নিজেকেই ক্ষতবিক্ষত করি আজকাল
ঈশ্বর!নিজেকে এ কেমন ভালবাসতে শুরু করেছি আমি)

তিনি কবিতা লিখেছেন ১৯৬০ এর দশকে। প্রগতিশীল কবিদের ধারায় তিনিও গজলের প্রথা মেনে লিখতে চাননি। তাঁর কবিতা সরাসরি, মনের কথা বোঝাতে কোন জটিলতা তিনি পছন্দ করতেন না। অলংকারহীন, সরল সেই কবিতা তাঁর তারকা জীবন থেকে বের হয়ে আসার অভিযান। এই তারকা জীবন মীনা কুমারীর জীবনকে গিলে খাচ্ছিল। যে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি অনিচ্ছায় এসেছিলেন স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছে বাদ দিয়ে, কবিতা ছিলো সেই ইন্ডাস্ট্রির দেয়া পাব্লিক ইমেজ হতে তাঁর দূরে যাওয়ার বাসনার প্রকাশ। নিবিড় পাঠে সেই কবিতা যতটা তাঁর, তারচে’ বেশি সেই বিনোদন কারখানার অন্তরালে মানুষের জীবনের মৃত্যুর কথা বলে।
একটা মাত্র কবিতার বই তাঁর। বের হয়েছে মৃত্যুর পর। ঘনিষ্ঠজন গুলজারের উদ্যোগে। গোটা পঞ্চাশেক কবিতা। এ হলো পপুলার কালচার ইন্ডাস্ট্রি আর এর সকল অসুখের বিরুদ্ধে একজন মানুষের বিদ্রোহ। কবি নিজের পাবলিক ইমেজকেই চ্যালেঞ্জ করছেন। মেলে ধরছেন নিজের ভেতরের বহুস্তরের ব্যক্তিত্ব। সেই মানুষের জন্মই হয়েছে এই সংস্কৃতির মধ্যেই।

তাঁর অভিনয় করা ‘সাহেব বিবি অওর গুলাম’ ছবির চরিত্রের মতই মীনাজির সৌন্দর্য ছিল নিজেকেই ধ্বংস করতে উন্মুখ। এমন সংবেদনশীলতা আর বুদ্ধিমত্তা নিয়ে নিছক ট্রাজেডি কুইনের ফিল্মি ইমেজ তাঁর কাছে স্বস্তিদায়ক ছিলো না। একটা কবিতা লিখেছিলেন ‘কালের বিপণী’ নামে। সেখানে দেখিয়েছেন সম্পদের মোমের পুতুলের পেছনে ধাওয়া করতে গিয়ে মানুষের সত্তা কেমন সামান্য স্পর্শে গলে পড়ে। নায সেখানে বলছেন যে এই বেণিয়া সাফল্য মানুষের চাওয়া প্রশান্তির বিকল্প হতে পারে না:

একটা সুন্দর ভালবাসার স্বপ্ন
আমার আগুন চোখে ঢালবে যে শান্তি বারি
নিখুঁত কাছে পাওয়ার একটি মুহুর্ত মাত্র
আমার অস্থির প্রাণে যে দেবে দু’দণ্ড শান্তি
আমি তো এর বেশি চাইনি কিছু আর
আর দেখো এই কালের দোকানে
এসবের কিছুই রাখা নেই

নিজের সময়কে সবচেয়ে নগ্নভাবে দেখেছেন তিনি। মানুষ কেমন করে এই কালের কাঠামোতে সাফল্যের জন্য নিজের সত্তাকেই জ্বালানী হিসেবে সঁপে দেয় দেখেছেন। দেখেছেন কেমন করে এই সময় মানুষকে যে আশা দেয়, সে আশা আসলে তার ধোঁয়াহীন চিতা হয়ে ওঠে:

যামানা জ্যায়সে ফাকাযাদাহ গিরোহ গিদ্ধরোঁ কা
বেকাফন উম্মিদোঁ পে পেহরা দেতা হ্যাঁয়

(কাল যেন উপোষী শকুনের দল
কাফনহীন আশার লাশ পাহারা দেয়)

সিনেমার নায়িকা হয়ে মীনা কুমারী তাঁর প্রেমিকের জন্য শর্তহীন আনুগত্য দেখিয়েছেন। কবিতায় তিনি সম্পুর্ণ বিপরীত। মানবিক সম্পর্ক তো বটেই, এমনকি মানুষের বিমূর্ত বর্তমান আর অতীত কালকে ছকের মধ্যে দেখতে তিনি একেবারে নারাজ। ‘কাল ও আজ’ নামের এক কবিতায় তিনি বলছেন:

প্রতিটি সুখ এক তীব্র বেদনা
প্রতিটি বেদনা এক সর্বনাশা সুখ
এই চেনা অন্ধকার
এক ধর্ষিত আলো
ধর্ষিত আলো একেকটি অন্ধকার
তেমনই
এই সব বর্তমান
নিভে যাওয়া অতীত
আর সব অতীত
নিশ্চিহ্ন বর্তমান

নিজের সবটুকু দিয়ে অজস্র জনতার কিছু ভালো সময় কাটানোর নিমিত্ত মাত্র হতে মীনাজির আপত্তি ছিল। মানুষ তাঁর অভিনয়ে তাঁকে ‘ট্রাজেডি কুইন’ উপাধি দিয়েছিল। তাঁর কাছে তা নামমাত্র ছিলো না। নিজের জীবনে আরো বড় ট্রাজেডি সওয়ার সাহস তার ছিলো। নিজের ভেতরে যে নিঃসঙ্গ চলচ্চিত্রের জন্ম হচ্ছিলো সে নিয়ে তিনি খুব স্পষ্ট ধারনা রাখতেন:

আবলা পা কোয়ি ইস দশত মেঁ আয়া হোগা
ওয়ারনা আঁধি মেঁ দিয়া কিস নে জালায়া হোগা

(পথ চলে বিক্ষত পায়ে কেউ এসেছে হয়তো
নইলে এমন ঝড়ে প্রদীপ জ্বালাবে কে?)

খুন কে ছিঁটে কাহিঁ পুছ না লেঁ রাহোঁ সে
কিস নে বিরানে কো গুলযার বানায়া হোগা

(রক্তের এই চিহ্ন যদি পথকে প্রশ্ন করে ফেলে
কে এই বিরান মরুকে ফুলবাগান বানালো?)

গানটি শুনতে ক্লিক করুন

‘পাকিযা’ ছবিটি কামাল আমরোহি বানানোর কাজ শুরু করেন ১৯৫৮ সালে। তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদ হলো। ছবির কাজ থেমে গেল। তখনো কাজ অর্ধেক শেষ হয়নি। মীনাজি ততদিনে আকন্ঠ মদে ডুবে গেছেন। ১৯৬৯ সালে সুনীল দত্ত আর নার্গিস সেই ছবির কিছু রিল দেখলেন। তাঁরা উঠে পড়ে লাগলেন, এই ছবি শেষ করতে হবে। দুজনই রাজি হলেন। হিন্দুস্তান টাইমসে সেই ঘটনা ছাপা হয়েছিল:

“মীনা কোন কথা বললেন না। চোখ দিয়ে অবিরল জল ঝরলো শুধু। আমরোহি ছবি আবার শুরুর প্রতীক হিসেবে একটা সোনার গিনি দিলেন মীনা কুমারীকে। বললেন: দেখো, ছবি শুরুর দিনের মতোই সুন্দর দেখাবে তোমাকে”।

চূড়ান্ত অসুস্থ মীনা জানতেন হাতে সময় খুব কম। অমানবিক পরিশ্রমে তিনি তাঁর জীবনের শেষ বিন্দু নিংড়ে দিলেন এই ছবিতে। ‘পাকিযা’ মুক্তি পেলো ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে। ছবি ফ্লপ। সপ্তাহ না ঘুরতেই হল থেকে নেমো গেলো। এই জগতকে ঠিকই চিনতেন মীনা কুমারী। ছবি মুক্তির দুই মাস না যেতেই তিনি মারা গেলেন। ট্রাজেডি কুইন যে সত্যিকারের জীবনেও তাই ছিলেন জানতে পেরে এবার হল উপচে পড়লো। মীনা কুমারী পেলেন মরণোত্তর তাঁর জীবনের দ্বাদশ আর সর্বশেষ ফিল্মফেয়ার মনোনয়ন। গার্ডিয়ানের চলচ্চিত্র সমালোচক ডেরেক ম্যালকমের মতে পাকিযা তাঁর দেখা শ্রেষ্ঠ একশটি ছবির একটি যা কি না “সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মিউজিক্যাল মেলোড্রামার অন্যতম”।

মাহযাবিন বানো, মীনা কুমারী না কি মীনা কুমারী নায – কেউ একজন লিভার সিরোসিসে মারা গিয়েছিলেন ৩১ মার্চ ১৯৭২ সালে ৩৮ বছর বয়সে। জন্মের পর বাবা তাঁকে এতিমখানায় রেখে এসেছিলেন অর্থাভাবে। মৃত্যুর পরও দেখা গেল নার্সিং হোমের খরচ শোধ করার মতো টাকা নেই।

রাহ দেখা করেঙ্গে সদিও তক
ছোড় জায়েঙ্গে য়ে জাহাঁ তানহা

(বহু শতাব্দী পথ চেয়ে থাকবে
এই পৃথিবীকে নিঃসঙ্গ ছেড়ে যাবো আমি)

গানটি শুনতে ক্লিক করুন

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top