মাসরুর আরেফিনের উপন্যাস ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’: বাকস্বাধীনতা ও রাষ্ট্রনৈতিক এক অনন্য দলিল // আশানুর রহমান

এক। ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ উপন্যাসে রুশ সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা

‘…অসুখী পরিবারগুলো সব একইরকম আর সুখী পরিবারগুলো একটা থেকে আরেকটা কতই না আলাদা’। বাক্যটি পড়ে একটা ধাক্কা খাই এই ভেবে যে, আরে এটা তো লিও তলস্তয়ের ‘আনা কারেনিনা’ উপন্যাসের প্রথম বাক্য! কিন্তু ভুল আমারই। কারণ লিও তলস্তয় ঠিক উল্টো কথাটাই বলেছিলেন। তাঁর প্রথম বাক্যটি ছিল—‘সমস্ত সুখী পরিবার একইরকম, আর প্রতিটি অসুখী পরিবার একটা থেকে আরেকটা কতই না আলাদা’।

প্রায় দেড় শ বছর আগে লেখা ‘আনা কারেনিনা’ উপন্যাসের বিখ্যাত সেই প্রথম বাক্যটির অর্থ মাসরুর আরেফিন শুধু পাল্টেই দিলেন না, নিজের উপন্যাসে তার স্বপক্ষে যুক্তি দিলেন মূলত দুই জায়গায়। তাই উপন্যাসে কথককে বলতে দেখি:

“আমাদের শৈশবের বরিশালে যতগুলো পরিবার ছিল আমার চেনাজানার ভেতরে, তাদের প্রত্যেককে চাইলে কীভাবে অদলবদল করে নেওয়া যেত একটার সঙ্গে অন্যটা। কারণ তাদের প্রতিটাতেই ছিল সেই একই কান্নাকাটি, একই অসুখ, একই দুশ্চিন্তা, যেহেতু আজ এই ঘরের ছেলে যোগ দিচ্ছে আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিকসে, তো কাল ঐ ঘরের ছেলে ওভারগ্রাউন্ড কোনো শ্রমিক দলে; আজ এই ঘরের মেয়ে দেখা যাচ্ছে এই ছেলের সঙ্গে এ ছাদে তো, কাল ওই ঘরের মেয়ে ওই ছেলের সঙ্গে এক ঝোপের আড়ালে – তারপর কেলেঙ্কারি, তারপর লজ্জা, তারপর ছি-ছি।” (পৃষ্ঠা-৮)

আবার অন্যত্র লেখক একই যুক্তি দেখাতে গিয়ে বলছেন:

“মনে পড়ল আমাদের তিন বাড়ি পরের এক ঘন ঝোপের মধ্যে মাথা তোলা মরিচাপড়া কামালদের টিনের বাসাটার কথা। এক স্কুল মাস্টারের চরম অসুখী টিনের বাসা ছিল সেটা, যে-বাসার কামাল নামের বড় ছেলেটার সঙ্গে ডাংগুলি খেলতে গেলেই আমি ওর ছেঁড়া হাফপ্যান্টের ফুটোগুলোর দিকে তাকিয়ে বুঝতাম যে, সে বলতে গেলে দুপুরে কিছুই খায়নি, আর তাই কীভাবে অসুখী পরিবারগুলো সব একই রকম, আর সুখী পরিবারগুলো একটা থেকে আরেকটা কতই না আলাদা।” (পৃষ্ঠা-৬২)

কী রকম আলাদা? নায়ক সেটারও ব্যাখ্যা দিচ্ছেন পরের লাইনে ঠিক এভাবে:

“অসুখী পরিবারগুলোয় ভাত খাওয়া হচ্ছে আলুভাজি ও ডাল দিয়ে। আর সুখী পরিবারগুলোয় কেউ খাচ্ছে স্যুপ, কেউ মুরগির রান, কেউ পোলাও, আর কেউ ডিমভুনা দিয়ে গরম ভাত, কৈ মাছের ভুনা, ঘন ডাল, সাথে আচার, সাথে কাঁচামরিচ, সাথে আলাদা পেঁয়াজ, যেহেতু সেই বাসায় গুনে গুনে পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ-ডিম খরচ করা লাগে না, যেহেতু সেই বাসায় এই না-গোনার কত সুখ, এই একেক বেলা একেকভাবে ভাত-পোলাও-স্যুপ-পাউরুটি খাবার কত ভঙ্গিমা—কখনো হাত দিয়ে, কখনো কাঁটাচামচ দিয়ে, কখনো চাইলে এমনকি হতে পারে পা দিয়েও, যেহেতু খিদে নেই, তবু প্রচুর খাবার এসে গেছে রান্নাঘর থেকে। তাই সেখানে খাবারে অনীহা, খাবারে অশ্রদ্ধা।”

দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিতে হলো নায়কের সুখী এবং অসুখী ধারণার স্বরূপ বোঝাতে। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায় নায়কের সুখী-অসুখী ধারণা আসলে তার ছোটবেলায় দেখা বরিশালের সেই দরিদ্র পরিবারগুলোর দৈনন্দিন সংকট থেকে উৎসারিত। সুখ-অসুখের মাপকাঠি এখানে দারিদ্র্য, এখানে সুখ ভোগে—মানে জিহ্বায়; সুখ পেটে খাবার থাকা আর না থাকায়। এই সুখ হলো স্থুল সুখ। মানুষ যখন মনের সুখে হাসে, সেই হাসির মধ্যে বৈচিত্র্য কম, কিন্তু দুঃখী মানুষের দুঃখগুলো অনেক বৈচিত্র্যময়। তাই লিও তলস্তয়ের কথাটার অর্থ এরকমও যে, কোনো পরিবার যদি সুখী থাকে, তবে তাদের সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ করার মতো আকর্ষণীয় কিছুই থাকে না। অন্যদিকে যে পরিবারগুলি অসুখী বা অসফল, তাদের সকলের লড়াইয়ের পেছনে হয়তো অনন্য গল্প আছে। এই উক্তির মধ্যে অন্তর্নিহিত একটি বিশ্বাস এরকম যে, সুখী পরিবারগুলি বোঝা সহজ এবং সেই তুলনায় অসুখী পরিবারগুলো সত্যিই জটিল। আর এই ধারণার পিছনে হয়তো তলস্তয়ের ক্রিশ্চিয়ান ধর্ম বিশ্বাসেরও একটি ভূমিকা ছিল।

আর মাসরুর আরেফিন তাঁর উপন্যাসে ঐ বাক্যটিকে যেন ‘Null Hypothesis’ ধরে নিয়ে পুতিনের “৩৫ নম্বর সার্কেলের” সদস্য, বাল্যবন্ধু কামাল, সুন্দরী ভ্যালেন্তিনা আর মস্কোর আন্ডারগ্রাউন্ডের ক্ষমতাবান অদ্ভুত সব চরিত্র দিয়ে প্রমাণ করলেন ‘আনা কারেনিনা’র প্রথম বাক্যটি আজও সত্য। প্রিয় সাহিত্যিকের প্রতি এভাবেও তাহলে শ্রদ্ধা নিবেদন করা যায়!

লেখক মাসরুর আরেফিন বিশ্বসাহিত্যের একজন নিবিড় পাঠক। কথাটা তিনি নিজেও কয়েক জায়গায় বলেছেন। বিশ্বসাহিত্যের যে-সব লেখকের প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্ব আছে, তাঁদের কথাও তিনি স্বীকার করেন অবলীলায়। তেমনিভাবে রুশ সাহিত্যের প্রতি তাঁর ভালোবাসা, পক্ষপাতিত্ব সীমাহীন। তাঁর এই তৃতীয় উপন্যাসে সেই পক্ষপাতিত্ব দেখি আরো কয়েকটি জায়গায়।

নিকিত্স্কি বুলভারের যে বাসায় নিকোলাই গোগল স্বেচ্ছামৃত্যু ঘটান, সেই বাসার সামনে দিয়ে যাবার সময় লেখককে স্মরণ করতে দেখি তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘ডেড সোলস্’-এর শেষ এবং অসমাপ্ত পঙক্তিটুকু: ‘…আমি তাদের বলছি যে, তাদের কর্তব্যগুলোর দিকে তারা আরও নিবিড় দৃষ্টি দিক, আর তারা সব সময় রাখুক নিজের দেশের প্রতি সৎ থাকার বিষয়টার কথা, এই অর্থে যে, সামনে অন্ধকার, আর আমরা বলতে গেলে প্রায়…’

ঠিক তেমনিভাবে মস্কো থেকে দেশে ফেরার সময় এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন পুলিশের হাত থেকে রেহাই পেয়ে চারজন পুলিশের কর্ডনের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে বোর্ডিং গেট বন্ধ হবার পাঁচ সেকেন্ড আগে প্লেনে পৌঁছে লেখক মনে মনে নিজের বিবেক, যাকে তিনি ডাকেন ‘সেবাস্তিয়ান’ নামে, তার সাথে কথা বলতে বলতে উপন্যাস শেষ করেন একটি অসমাপ্ত বাক্যে—’…বিশেষত যখন সামনে ভবিষ্যৎ অন্ধকার ঠিকই কিন্তু তারপরও খেলা চলবে আর আমরা বলতে গেলে প্রায়’

এমনকি নেই কোনো কমা, সেমিকোলন বা দাড়ি। সেভাবেই উপন্যাসটি শেষ হয় ঠিক যেভাবে নিকোলাই গোগল তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘ডেড সোলস্’ শেষ করেছিলেন। উভয়েই তাদের উপন্যাস শেষ করেছেন অসমাপ্ত বাক্য ‘আমরা বলতে গেলে প্রায়’ দিয়ে।

উপন্যাসের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ভ্যালেন্তিনা, যে কিনা লেখকের বন্ধুর ছোট ভাইয়ের স্ত্রী, যার মা রাশান আর বাবা বাংলাদেশী, প্রথম দেখাতেই তার চোখ দেখে লেখকের মনে হয়—‘টানা আয়তাকার, যেমন হয় সুন্দরী রাশিয়ান-পোলিশ-ইউক্রেনিয়ান মেয়েদের, আর তাতে ঘুম না হবার ক্লান্তি ও সমস্ত বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে পাহাড়ে বেড়াতে যাবার ইচ্ছার ঝলকানি’। অথবা তার চোখের দিকে তাকিয়ে লেখকের মনে হয়—‘তার চোখের ভেতরেই কোথাও আছে ইরকুতস্কের রেলস্টেশন, যেখানে নামলে পরে যাওয়া যায় বৈকাল হ্রদের পাড়ে।’

কথক প্রথম দর্শনেই ভ্যালেন্তিনাকে পছন্দ করেন, তবে সেই পছন্দ কোনো নিষ্কাম পছন্দ নয়। কথকের ভাষায় ‘…নারী ও পুরুষের মাঝখানের বিষয়গুলো যেহেতু এভাবে শুধু দাপ্তরিকই থাকে না, যেহেতু কোনো অফিস ম্যানুয়ালেই বলা নেই বন্ধুর ছোট ভাইয়ের বউয়ের দিকে তাকানো যাবে না।’ আর তাই তিনি বলছেন, “…অতএব ভ্যালেন্তিনার বৈকাল হ্রদের মতো গভীর চোখের দিকে তাকিয়ে ভেসে যেতে লাগলাম নিপীড়িত-উৎপীড়িত রাশিয়ার মালভূমি ও পাহাড়গুলোর ওপর দিয়ে—ভলগা নদীতে ভেসে চলা নৌকা, এর নোভোসিবিরিস্কির সেন্ট নিকোলাস চ্যাপেল, আবখাজিয়ার স্তেপে ক্লান্ত ঘোড়ার দল, কাজান শহরের বাস স্টেশন, স্নোলেনস্কের ‘শিখা অনির্বাণ’ স্মৃতিসৌধ, কামচাটকার আগ্নেয়গিরি আর সেন্ট পিটার্সবার্গের ভ্লাদিমির নবোকভের পৈতৃক প্রাসাদ, এই সব কিছুর ওপর দিয়ে আমি উড়তে লাগলাম এক মায়াভরা চোখের ভেতরে পৃথিবীর প্রারম্ভ ও কালগ্রাসকে দেখতে দেখতে। ”

এভাবেই প্রেম ও প্রকৃতির এক অদ্ভুত সুন্দর বর্ণনায় পাঠকের মুগ্ধতা তৈরিতে মাসরুর আরেফিন মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। আবার ভ্যালেন্তিনার চুল ও গা থেকে আসা পারফিউমের গন্ধের বর্ণনা পাই এভাবে—‘গন্ধটা পুডিংয়ের, অনেক লবঙ্গ মেশানো পুডিং; গন্ধটা নেশা ধরানো, গন্ধটা মূলত সন্ধ্যা রাতের, গন্ধটা প্রাদোষিক, পাখিদের ঘরে ফেরার সময়ের…’।

এই ভ্যালেন্তিনার সাথে কথকের আলোচনা জমে ওঠে আন্তন চেখভ নিয়ে, জীবনের মানে খোঁজা নিয়ে। তাই সঙ্গতভাবেই আসে চেখভের বিখ্যাত গল্প ‘লেডি উইদ এ লিটল ডগ’-এর কথা। এই গল্পে হোটেল রুমে গল্পের নায়ক গুরভের সাথে গল্পের নায়িকার প্রথম শারীরিক সম্পর্ক হয়। শারীরিক সম্পর্ক শেষে নায়ক গুরভ টেবিলে রাখা তরমুজ খায় আধাঘন্টা ধরে। এটা নিয়ে লেখক ও ভ্যালেন্তিনা দু’জনেই হাসে এটা মনে করে যে, প্রেমিকার সাথে প্রথমবার সেক্সের পর নায়ক তরমুজ খায়। তরমুজ!

মাসরুর আরেফিনের উপন্যাসে আমরা দেখি যে, আজকের দিনে দুজন মানুষের (এখানে সবটা বলে দেওয়া যাবে না) নিরানন্দময় সেক্স শেষে হোটেলের রুমের টেবিলে রাখা আনারস, আপেল, আঙুর আর বড় এক ফালি তরমুজ থেকে বিবস্ত্র অবস্থায় সেই তরমুজের ফালি হাতে নিয়ে পুরুষটা মেঝেতে বসে চম্ চম্ শব্দ তুলে তরমুজ খায় প্রায় ত্রিশ মিনিট ধরে। মেয়েটা এসময় বলে: ‘আজকে থেকে আমার মধ্যে দালাল আর প্রস্টিটিউটে কোনো ফারাক নেই। আমার তরমুজ খাওয়ার দিন শেষ।’

‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ উপন্যাসে চেখভ এভাবেই ফিরে আসেন এবং জীবনের মানে জীবন দিয়েই বুঝতে বলেন। ধ্রুপদী রুশ উপন্যাস ও সাহিত্যিকদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের এক অনন্য উদাহরণ লেখক এখানে সৃষ্টি করেছেন, যার আর কোনো নজির বাংলা সাহিত্যে আছে বলে আমার জানা নেই।

দুই। আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতি ও আনুগত্যের অগ্নিপরীক্ষা

উপন্যাসের নাম ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ শুনে শৈশব ও কৈশোরের কিছু তাজা স্মৃতি মুহূর্তেই জ্বলজ্বল করে ওঠে। গভীর রাতে একদল যুবকের অস্ত্রহাতে আনাগোনা, কোনো কোনো রাতে তাদের খাওয়াতে গিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত মায়ের রান্না-বান্না, রান্নাঘরের টুংটাং আওয়াজ শুনতে শুনতে আমার ঘুমিয়ে পড়া, সকালবেলা তাদের কথা জিগ্যেস করলে মা-বাবার নিরুত্তর মুখচ্ছবি; কেবল বাড়ির কাজের যুবক ছেলে শহীদুলের বলে ওঠা যে, ওরা রেতো পার্টির লোক খোকা, দিনের বেলা ওদের দেখা যায় না।

মনে পড়ে একদল রহস্যজনক মানুষের এক ধরনের রোমান্টিক ও গা ছমছম করা তৎপরতা। মনে পড়ে কোনো এক সকালে ঝিনাইদহের এক গ্রামে স্কুলের পিছন দিকের মাঠে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ছলাৎ ছলাৎ জলে ক্ষেতের ‘আলে’ পেতে রাখা ‘ঘুনি’ থেকে মাছ ‘ঝাড়তে’ গিয়ে আলের পাশে গলাকাটা লাশ দেখে প্রচণ্ড ভয়ে মাছের পাত্র ফেলে ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফিরে আসা। শৈশবের সেই সব ভীতিকর ও রোমাঞ্চকর দিন—ভূতের গল্প শোনার মতই, সেই আবছায়াময় সময়ের নামই তো ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ সময়।

উপন্যাসের শুরুতেই মস্কো এয়ারপোর্টে ট্রলি হাতে লাগেজের জন্য অপেক্ষারত নায়কের স্মৃতিচারণে পাঠক ঘুরে আসে বরিশালের ভাটিখানা, আমানতগঞ্জের বিল, আর সালাম জমিদারের বাড়ির পিছনের কাশবনে। আমরা ক্রমশ জানতে পারি ৭০ থেকে শুরু হয়ে ৮০ দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সরব বরিশালের চরমপন্থী বামদের আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির খবরাখবর। আর সেই আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির জনসম্পৃক্ততা কতটা ছিল সেই চেহারাটা ফুটে ওঠে লেখকের বর্ণনায় মাত্র দুই লাইনে, “…ভাটিখানায় ঢোকার মুখে নান্নু ভাইদের বাড়ির পাঁচিলজুড়ে ‘জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো এবং শাসকের চিকন গলা নামিয়ে দাও, থামিয়ে দাও’ লেখা চিকাগুলো আমরা বাচ্চারা বালতি ভরা চুন-রং ইত্যাদি কাপড়ে মাখিয়ে মুছে দিতাম রোজ-রোজ।” (পৃষ্ঠা -১১)

আবার একই সাথে সেইসব চরমপন্থী আন্ডারগ্রাউন্ড দলগুলোর পারস্পরিক লড়াইয়ের বীভৎসতা ফুটে ওঠে লেখকের বর্ণনায় এভাবে: “কামালের রাশিয়া যাবার মাত্র দু মাসের মাথায় আমাদের তুলনামূলক সুখী বাসাটা থেকে ওই বিশাল রাশিয়াতেই ঠেলে পাঠানো হলো আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টির তরফে হকিস্টিক হাতে নেওয়া আমার বড় ভাইকে, কারণ সবাই বুঝল এখানে থাকলে সামনেই একদিন সাক্ষাৎ মারা পড়বেন তিনি—করকিনা মাছে ভরা ড্রেনগুলোয় পড়ে থাকবে তার কাটা আঙুল, তারই একটু পরে তার কানের লতি, আবার তারই অল্প দূরে তার রক্তে ভেজা জামার পকেট, আর ঐ পথ ধরে এগোতে এগোতে সালাম সাহেবদের জমিদার বাড়ির পাশের কাশবনে পাওয়া যাবে তার মরবার সময়ে আকুলিবিকুলি করে ওঠা মৃতদেহ।” (পৃষ্ঠা -১৩)

এখানেই পাঠককে ইঙ্গিত দেয়া হয় যে, নায়কের বড় ভাই নাকি মানুষ খুন করেছিল। আর এই খুনের ঘটনার করুণ বর্ণনা শুনি নায়কের বড় ভাই শামসুলের মুখে মস্কো স্টেশনের কাছে ‘লোটে প্লাজা’র সামনে—ছাব্বিশ বছর পর দুই ভাইয়ের মুখোমুখি প্রথম সাক্ষাতের এক পর্যায়ে। ওই বর্ণনার মধ্য দিয়ে উঠে আসে বামপন্থী দলে (তা সে আন্ডারগ্রাউন্ড বা ওভারগ্রাউন্ড, যেটাই হোক না কেন) দলের প্রতি ‘সাবমিশন’ বা ‘আনুগত্যের’ নামে কর্মীদের অগ্নিপরীক্ষার নির্মম চিত্র। বামপন্থী দলে লেনিনের ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা’র যে তত্ত্ব, তারই বিকৃতরূপ হলো—যে কোনো অবস্থায় দলের প্রতি, নিম্ন কমিটি কর্তৃক উচ্চ কমিটির প্রতি, কর্মী কর্তৃক নেতার প্রতি, কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক দলের সাধারণ সম্পাদকের প্রতি এই সাবমিশন বা আনুগত্যের পরীক্ষা।

দলের কাছে নিজের আনুগত্যের পরীক্ষা দিতে আমরা উপন্যাসে দেখি এক আপন বড় ভাই বরিশালে নিজের ছোট ভাইকে হত্যা করছে। সেই মামলার আসামী হয়ে পুলিশী হয়রানি থেকে রক্ষা পেতেই শামসুল পালিয়ে যায় রাশিয়ায়, আজ থেকে ছাব্বিশ বছর আগে। আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে যে, গল্পের পটভূমি রাশিয়ায় কেন?

তিন। উপন্যাসে সাম্প্রদায়িকতা এবং জাতিগত হিংসা

উপন্যাসে জাতি-সম্প্রদায় এমনকি শ্রেণি ঘৃণা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে। আজকের বৈশ্বিক বাস্তবতার সঙ্গে যেটা ভীষণভাবে সঙ্গতিপূর্ণ। ফলে ‘লুস খেলা’ গৃহশিক্ষক প্রদীপ বসাককে শাস্তি দিতে আসা বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী বলাৎকারী প্রদীপ বসাকের আড়ালে আসলে হিন্দু ‘মালাউন’ প্রদীপ বসাককে শাস্তি দিতে চায়। উপন্যাসে লেখক বিষয়টি নিয়ে আসে এক লাইনে এভাবে “…প্রদীপ স্যারকে খুঁচিয়ে মারা হবে লুস খেলার অভিযোগের আড়ালে আসলে বুকের মধ্যে ছলকে ওঠা হিন্দু মারার গুড়গুড় ডাক বরাবর।” (পৃষ্ঠা – ২০৩)

আবার নায়ক যখন সাদাত ও তার স্ত্রী ভ্যালেন্তিনাসহ মস্কোর ওসিপ মান্দেলশ্তাম মিউজিয়াম দেখতে যায়, সেখানে দেখতে পাই চেচেন তকদিরভের প্রতি রাশান দিমিত্রি, ভিতালি ও কুভালদিনের উপচে পড়া ঘৃণা। সেই সাথে চেচেন তকদিরভের মধ্যেও দেখি আত্ম-অহংকারের পাশাপাশি রাশান ও ইহুদি-বিদ্বেষ।

মুসলিম বিদ্বেষে বরিশালের প্রদীপ বসাক আর রাশান নাদেঝদার মধ্যে ভৌগলিক কোনো বাধা থাকে না। আবার ছেঁড়া, ফুটো, তালি দেয়া হাফপ্যান্ট পরা ভাটিখানার কামাল রাশিয়ায় গিয়ে ভাগ্য বদলে পুতিনের ৩৫ নম্বর সার্কেলের সদস্য হয়ে দারিদ্রকে সে শুধু ঘৃণাই করে না, সে নায়ককে বলে, “আর কয়বার বলব যে, তুই আমারে বরিশালের গরিবি মনে করাবি না? নো মেমোরি অব পভার্টি প্লিজ। আমার গরীব সহ্য হয় না। সাদাতরে সহ্য করব, তা-ও শুধু ভ্যালেন্তিনারে লুস মারব বলে।” (পৃষ্ঠা – ১০৭)

আর এভাবে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ উপন্যাসে দেশ-কাল-স্থান নিরপেক্ষভাবে জাতি-সম্প্রদায়-শ্রেণিঘৃণা যে আজকের বৈশ্বিক বাস্তবতা এবং বিরাট সমস্যাও বটে, সেটাই লেখক নিপুণ দক্ষতায় তুলে ধরেন।

চার। ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ উপন্যাসের পটভূমি হিসেবে রাশিয়াকে কেন?

প্রশ্ন উঠতে পারে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ উপন্যাসের পটভূমি রাশিয়া কেন? কেন বাংলাদেশ নয়?

‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র কবি ওসিপ মান্দেলশ্তাম। আর লেখকের ধারণা আজকের পৃথিবী বাস্তবে কীভাবে চলে সেটা বুঝতে হলে আমাদের জানা দরকার সোভিয়েত আমলে স্তালিনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বিশ শতকের শ্রেষ্ঠতম রাশিয়ান কবি ওসিপ মান্দেলশ্তামকে কেন খুন হতে হয়েছিল? কেন ওসিপ মান্দেলশ্তামের বাকস্বাধীনতা রাষ্ট্রকে কেড়ে নিতে হয়েছিল?

ওসিপ মান্দেলশ্তামকে কেন এভাবে খুন হতে হলো? অথবা স্তালিন কেন তাকে এভাবে খুনের পরিকল্পনা করলেন? ওসিপ কি বিপ্লবের জন্য হুমকি হয়ে উঠছিল? ওসিপও তো প্রথম জীবনে সক্রিয় স্যোসাল রেভ্যুলুশানারি ছিলেন? ওসিপও কী একদিন সমাজতন্ত্র চাননি? তাহলে বিপ্লবের পরে কেনো তিনি বিপ্লবকে, যাকে বলা হচ্ছে নতুন সূর্য, তাকে ‘গোধূলি’র সাথে তুলনা করলেন?

দ্বিতীয় কারণ হল, উপন্যাস জুড়ে বারবার উঠে আসা এক মৌলিক প্রশ্ন—বিপ্লবের পরে কী? বিপ্লবটা যেহেতু রাশিয়ায় হয়েছিল ফলে উপন্যাসের পটভূমি রাশিয়া ছাড়া আর কী-ই বা হতে পারত?

বিপ্লবের সময় একদিকে জার্মানীর সাথে যুদ্ধ অন্যদিকে বিপ্লব বিরোধীদের সাথে লড়াই করতে গিয়ে রাশিয়ার অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। যে ‘শান্তি-রুটি-জমি’র শ্লোগান তুলে বিপ্লব জয়যুক্ত হয়, তার কিছুই অর্জিত হচ্ছিল না। লেনিনের ‘যুদ্ধকালীন সাম্যবাদী’ নীতির কারণে দেশে তখন দুর্ভিক্ষাবস্থা। যে নাবিকেরা বিপ্লবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, ১৯২১ সালেই তাদেরই এক বিদ্রোহ দমন করা হল ১৫ হাজার নাবিককে হত্যা করে। কবি আন্না আখমাতোভার স্বামী এবং কবি মান্দেলশ্তামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু নিকোলাই গুমিলিয়ভ, যিনি নিজেও একজন কবি ছিলেন, তাকে রেডগার্ডরা গুলি করে হত্যা করে নৌবিদ্রোহে উসকানি দেয়ার অভিযোগে। বিপ্লবের অন্ধকারের দিকগুলো মাসরুর আরেফিন তুলে আনলেন একটি মাত্র বাক্যে: “বিপ্লবের গলা পিপাসায় শুকনো, কিন্তু সে বাইরের কারও হাত দিয়ে পানির একটা ফোঁটাও নেবে না। বিপ্লবের পরে তাই তৃষ্ণা—ক্ষমতা ও রক্তের বিরাট তৃষ্ণা।”

সেন্ট পিটার্সবার্গের ‘স্ট্রে ডগ ক্যাফে’-তে বসে ১৯১১-১৯১৫ পর্যন্ত যেসব কবি আড্ডা দিয়েছেন একসাথে বিপ্লবের পরে তারাও ভাগ হয়ে গেলেন। নতুন বিপ্লবকে স্বাগত জানিয়ে কবি মায়াকোভস্কি বললেন, “যে যাই বলুক এই বিপ্লব আমার”। আর ওসিপ মান্দেলশ্তাম এই বিপ্লবকে তুলনা করলেন স্বাধীনতার ‘গোধূলি’ বলে। ‘গোধূলি’ কবিতায় ওসিপ বলছেন,

“ভাইয়েরা, স্বাধীনতার গোধূলির আসো প্রশংসা করি,
বন্দনা করি এই মহান গোধূলি সাল!
——

প্রশংসা করি আসো ক্ষমতার গোধূলিভরা ভার,
কী দুর্বহ ওজন যে এই ক্ষমতার।”

এই ক্ষমতার ওজন টের পাচ্ছিল রাশিয়ানরা। প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনার সময় থেকেই তারা টের পাচ্ছিল সেটা। আর মান্দেলশ্তাম টের পেয়েছিলেন আরো আগে—সেই ১৯২৪ সালে, লেনিনের মৃত্যুর ২০ দিন আগে। একটু একটু করে স্তালিনের হাতে সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত হচ্ছে। ট্রটস্কি ও বুখারিনের মতো কয়েকজন ছাড়া সবাই তখন স্তালিনের আস্তিনের নিচে। ওসিপ মান্দেলশ্তাম ১৯২৪ সালে ১লা জানুয়ারি লিখলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘নেকড়ে’।

পাঁচ। উপন্যাসের নামকরণ ও মস্কোর আন্ডারগ্রাউন্ড নিয়ে কিছু কথা

‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ উপন্যাসে তৃতীয় অধ্যায়ের ৭৩ থেকে ১০৮ পৃষ্ঠাব্যাপী লেখক মস্কোর আন্ডারগ্রাউন্ডের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা একান্তই প্রতীকী, যেখানে বাস্তব, অবাস্তব, পরাবাস্তব মিলেমিশে একাকার। লেখক এক অদ্ভুত ও উদ্ভট প্রান্তরে পাঠককে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন যে প্রান্তরের কোনো মেঝে নেই, নেই কোনো ছাদ, মেঝে ও ছাদ মিলে একই জিনিস। কে নেই সেই আন্ডারগ্রাউন্ডে? তস্কর, বেশ্যার দালাল, জালিয়াত, চোরাকারবারি, হিজড়া, ছেলে ধরা, চোরাইমালের ক্রেতা, ওয়াগন ব্রেকার, ভিখিরি এবং তাদের থেকে ভিখিরিদের চালায় যে মালিক তারা, ডাকাত, মেয়ে ধরা থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীরা, আছে আর্মি জেনারেল ফ্লাশটারমেইশ্টার—সেখানে সে এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রও বটে; আছে মন্ত্রী থেকে রাষ্ট্র প্রধানরা, আর আছে এক শয়তান, যার পায়ুতে চুমু দিতে ব্যস্ত সেখানে উপস্থিত সকলেই। কে এই শয়তান? এই শয়তান কি ঈশ্বর প্রেরিত ধর্মগ্রন্থের শয়তান? এই শয়তানই কি হিটলার, স্তালিন, বুশ, ট্রাম্প, মোদীসহ পৃথিবীর তাবৎ স্বৈরশাসক? নাকি গ্লোবাল কর্পোরেট পুঁজির রক্ষক এক সিস্টেম? আমরা জানি না। লেখকও স্পষ্ট করে কিছু বলেন না।

মস্কোর আন্ডারগ্রাউন্ড অধ্যায়টি বর্ণনা করা হয়েছে এমনভাবে যার কিছুটা বোঝা যায়, কিছুটা যায় না; যেন চাইনিজ রেস্টুরেন্ট বা পাঁচতারা হোটেলের বারের আলো-আঁধারির আবছায়া। আবার একই সাথে লেখা এখানে একটু এলোমেলো, অগোছালা, খাপছাড়া, অনেকটা যেন একটা ঘোর নিয়ে লেখা, অথবা নিয়মিত মদ খাওয়া লোকের পরিমিতিবোধ হারিয়ে একটু বেশি খেয়ে ফেলা, ঘোর লেগে কিছুটা ঝিমিয়ে পড়া, আবার একই সাথে ঘোর থেকে ‘মিকি মিকি’ বলে জেগে ওঠা।

পাঠকও যেন আন্ডারগ্রাউন্ড আর ওভারগ্রাউন্ডের খেলাটা পুরোপুরি ধরতে পারে না, বুঝতে পারে না। যদিও লেখক এই অংশেই বলেছেন,  “পৃথিবীর কতটুকুই বা আমরা ধরতে পারি? যেটুকু পারি, সেটাই আমাদের ‘উমওয়েল্ট’, আমাদের জ্ঞান-পরিধি, আমাদের বোধগম্যতার সীমা।” হয়তো তাই। আর একারণেই পৃথিবীর ‘সিস্টেম’কে বোঝাতে লেখকের প্রয়োজন পড়ল আন্ডারগ্রাউন্ড নামক এক মিথ বানানোর।

ছয়। ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ উপন্যাস—বাকস্বাধীনতার বৈশ্বিক সংকটের দলিল

মাসরুর আরেফিন তাঁর উপন্যাসের ফ্ল্যাপে জোর দিয়েই বলেছেন, “এই উপন্যাসের মূল কথা এই সময়, এই কাল, যা, এক বুনো পশু, যার মেরুদণ্ড ভাঙা। তাই সে নিষ্ঠুর, তাই সে প্রতিহিংসাপরায়ণ। তাই সে গণতন্ত্র ও উন্নয়ন নিয়ে উচ্চাভিলাষী, কিন্তু আপনাকে কথা বলতে না দেবার ব্যাপারে মরিয়া।”

রাশিয়ায় যখন বিপ্লব হয় তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। একদিকে জার্মানীর সাথে ফ্রন্টে ফ্রন্টে যুদ্ধ, অন্যদিকে শ্বেতবাহিনীর (ক্ষমতাচ্যুত ভূস্বামী, সেনাবাহিনীর একটা অংশ ও কেরেনস্কির সমর্থক) সাথে লড়াই। লেনিন তখন ‘ওয়্যার কমিউনিজম’ ঘোষণা করে উৎপাদনের উপায়ের ওপর রাষ্ট্রের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণসহ সমস্ত জমি রাষ্ট্রায়ত্বের ঘোষণা দেন। এর ফল হয় মারাত্মক। ১৯১৩ সালে যে রাশিয়ার শিল্প উৎপাদন ছিল ২০%, সেটা নেমে আসে ১৩%-এ। খাদ্য উৎপাদন কমে যায় মারাত্মকভাবে, টাকার পরিবর্তে বিনিময় ব্যবস্থা হিসেবে বার্টার সিস্টেম প্রচলন করা হয়। যুদ্ধের জন্য খাদ্য রিক্যুইজিশনের ফলে কৃষকরাও উৎপাদন কমিয়ে দেয়, ফলে ভয়াবহ খাদ্য সংকট দেখা দেয়। এই অবস্থায় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির প্রেক্ষাপটে লেনিন NEP (New Economic Policy) চালু করেন। ১৯২৮ সালে এসে স্তালিন প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনা গ্রহণ করেন (১৯২৯-৩৩) যার প্রধান দু’টো উদ্দেশ্য ছিল—ব্যাপক শিল্পায়ন, বিশেষত ভারী শিল্পায়ন এবং ব্যাপক কৃষককে সমবায়ের মাধ্যমে যৌথখামারে অন্তর্ভুক্তিকরণ। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায় ৫০%, শিল্প শ্রমিক ৪৬ লক্ষ থেকে বেড়ে ১.২৬ কোটিতে পৌঁছায়, যে রাশিয়া ছিল শিল্পায়নে বিশ্বের মধ্যে ৫ম, তার অবস্থান গিয়ে দাঁড়ায় দ্বিতীয়তে, আমেরিকা তখন প্রথম।

রাশিয়ার এই উন্নয়ন অভিজ্ঞতা ও মানুষের বাকস্বাধীনতার সম্পর্কসূত্রটি বিবেচনায় রেখে আমরা যদি বাংলাদেশের বর্তমান উন্নয়ন মডেলের ধরণটি খেয়াল করি তাহলে আমরাও দেখি যে, উন্নয়নের সূচকগুলো একদিকে উর্ধ্বমুখি (৮.২% জিডিপি, ৪৩ বিলিয়ন রিজার্ভ, ২০০০ ডলারের ওপর মাথাপিছু আয়, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পদোন্নতি), অন্যদিকে মানুষের বাকস্বাধীনতা নিম্নগামী।

যে সময় বা কালকে মাসরুর আরেফিন তাঁর উপন্যাসের মূল কথা বলে মনে করেন, সেই সময়কেই তিনি উল্লেখ করেছেন এক বুনো পশু হিসেবে, যার মেরুদণ্ড ভাঙা। মাসরুর বলছেন, ‘এই সময় বা কাল নিষ্ঠুর, তাই সে প্রতিহিংসাপরায়ণ। তাই সে গণতন্ত্র ও উন্নয়ন নিয়ে উচ্চাভিলাষী, কিন্তু আপনাকে কথা বলতে না দেবার ব্যাপারে মরিয়া’। তাই আমরা দেখি যে, ২০১৯ সালে শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেই মামলা হয়েছিল ৭৩২টি আর গ্রেপ্তার ছিল ৬০৭ জন। ২০২০ সালে প্রথম ৫ মাসেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছিল ৪০৩টি, গ্রেপ্তার ছিল ৩৫৩ জন। অর্থাৎ, ২০২০ সালে করোনাকালে কথা বলার দায়ে দমন-পীড়নের হার বেড়ে গিয়েছিল। আর এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেই ২০২০ সালে গ্রেফতার করা হয় লেখক মুশতাক আহমেদ ও কার্টুনিস্ট আহমেদ কবীর কিশোরকে। কারাবন্দী থাকাকালীন লেখক মুশতাক আহমেদ মারা যান ২৫ শে ফেব্রুয়ারি ২০২১। মাসরুর আরেফিন তাঁর উপন্যাসের মূল হিসেবে যে সময়ের কথা বলেছেন, এই হচ্ছে সেই সময়। লেখক দুই সময়কে একই সাথে গেঁথে তাঁর আন্ডারগ্রাউন্ড উপন্যাসে দেখিয়েছেন বাকস্বাধীনতাহীন এক বৈশ্বিক বাস্তবতাকে, যে-বাস্তবতায় লেখকের প্রিয় রাশান কবি মান্দেলশ্তামকেও একইভাবে দূর নির্বাসনে একাকী মৃত্যুবরণ করতে হয়। তাই লেখক বলছেন এভাবে, “শেখার আছে অনেককিছু। ওসিপ মান্দেলশ্তাম ও আন্ডারগ্রাউন্ডকে পাশাপাশি রেখে শেখার আছে অনেক কিছু ব্রাদারস্। ওসিপ ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি দেখতে পেয়েছিলেন যে, শাসককে নিয়ে এক ব্যঙ্গ-কবিতা লেখার অপরাধে তাকে একদিন মেরে ফেলা হবে। তাই তিনি স্ত্রী নাদেঝদাকে বলেছিলেন, ‘নাদেঝদা, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। এই খুনে প্রান্তরে আসলে আমার কী কাজ?’ তার মানে তাঁর দেখার এটাও বাকি ছিল না যে, এই খুনে প্রান্তরে একদিন কোনো এক বাঁকা ধরনের ব্যঙ্গচিত্র আঁকবার অপরাধে কাউকে কানে ও পায়ে বেদম মারা হবে, আর সেই ব্যঙ্গচিত্রের জন্য একটা বাঁকা ধরনের ক্যাপশন লেখার অপরাধে আরেকজনকে পিটিয়েই পৃথিবীছাড়া করা হবে।” (পৃষ্ঠা -২০৩)

সাত। বরিস পাস্তেরনাক ও স্তালিন

ওসিপ মান্দেলশ্তাম ‘স্তালিন এপিগ্রাম’ নামের ১৬ পঙক্তির কবিতাটি পড়ে শোনান ১৯৩৪ সালে এপ্রিল মাসে। যাদের সামনে তিনি কবিতাটি পড়েন, তাদের মধ্যে উপস্থিত কবিবন্ধু বরিস পাস্তেরনাক সেই কবিতা শুনে ভয়ে কাতর হয়ে বলেন, “আমি এই কবিতাটি শুনি নি, তুমি এটা আবৃত্তি করো নি। তুমি জানো কীসব বিচিত্র আর ভয়ংকর ঘটনা ঘটতে চলেছে, মাঝরাতে বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মানুষজনকে। আমার ভয় লাগে যে, দেয়ালেরও কান আছে, এমনকি রাস্তার ধারের বেঞ্চিগুলোও শুনেছে তোমার কবিতা এবং পরে অন্যকে বলবে। এখনই বলে রাখছি আমি কিছুই শুনি নি।” আবার আন্না আখমাতোভা কবিকে একটু অবাক করে দিয়েই বলেছিলেন, ‘দৈত্যাকার এক সস্তা পপুলিস্ট পোস্টার ঘরানার যেনতেনভাবে লেখা এক ফালতু কবিতা’।

ওসিপ মান্দেলশ্তাম এর স্ত্রী নাদেঝদা মান্দেলশ্তামের স্মৃতিকথার বইটি ১৯৭০ সালে ‘হোপ এগেনেইস্ট হোপ’ নামে প্রকাশিত হয়। সেখানে নাদেঝদা লিখেছেন, “মান্দেলশ্তামের কবিতা এমনই বিপদজনক যে, সেসব লাইনের যারা প্রথম শ্রোতা ছিলেন, তাদের সবারই জীবনে বিয়োগান্তক পরিণতি ঘটেছিল।” কথাটা যথার্থ, তবে প্রশ্ন হল প্রথাগত অর্থে মান্দেলশ্তাম তো কোনো রাজনৈতিক কবিতা লিখতেন না। তাহলে কেনই বা তিনি স্তালিনকে নিয়ে ‘স্তালিন এপিগ্রাম’ নামের কবিতাটি ‘রচনা’ করলেন? পাঠক খেয়াল করুন আমি ‘রচনা’ বলেছি, ‘লিখলেন’ বলিনি। কারণ তাঁকে যখন গ্রেফতার করা হয় তখনও কবিতাটি তাঁর মাথায় ছিল, তিনি শুধু এর কিছুদিন আগে তাঁর ছোট্ট ফ্ল্যাটে ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের উপস্থিতিতে সেটা আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন মাত্র।

মান্দেলশ্তাম জড়িত ছিলেন ‘আকমেইজম’ নামক শিল্পকলার আন্দোলনের সাথে। তিনি প্রতীকবাদী ছিলেন না, কারণ তিনি মনে করতেন প্রতীকবাদীদের কবিতা বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে, বিপরীতে তাঁর কবিতা ছিল জীবন থেকে তুলে আনা বাস্তব চিত্রকল্প। মান্দেলশ্তাম এটাও বিশ্বাস করতেন যে, কবিতার কোর্স করেও কবি হওয়া যায়, যেমন কেউ যন্ত্রকৌশল শিখে প্রকৌশলী হয়। যাঁর শিল্পভাবনা এরকম তাঁর জন্য কবিতায় রাজনৈতিক প্রসঙ্গ নিয়ে আসা বা শিল্প আন্দোলনের জন্য রাজনীতি জরুরি থাকে না। তবে মান্দেলশ্তাম যে সময়ে এই কবিতাটি রচনা করেন সেই সময় সম্পর্কে বলতে গিয়ে অনেক পরে আন্না আখমাতোভা বলেন, “এটা হচ্ছে সেই সময় যখন মৃতরাই কেবল সুখে হাসতে পারত, শেষ পর্যন্ত নিষ্কৃতি মিলেছে—এই বোধে।”

তখন সময়টা এমন যে, ১৯৩৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টির ১৭তম কংগ্রেসে যে ১৯৯৬ জন প্রতিনিধি যোগ দেয়, তাদের দুই-তৃতীয়াংশকে হত্যা করা হয়। সেই কংগ্রেসের ১৩৯ জন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের মধ্যে ৯৮ জনকে হত্যা করা হয় ৪ বছরের মধ্যে। এটা এমন এক সময় যখন কে গুপ্ত পুলিশের চর, আর কে নয় সেটা বোঝা দুষ্কর। ফলে তেমন একটা সময়ে ঘরোয়া এক আসরে কবিতা পাঠের সময় এমন কেউ উপস্থিত ছিল, যে হয়তো গুপ্ত পুলিশের চর ছিল। ‘এনকেভিদি (NKVD), এখন যার নাম ‘কেজিবি’, তার কয়েকজন সদস্য ১৯৩৪ সালের ১৪ই মে মান্দেলশ্তামকে ধরতে আসে। গুপ্ত পুলিশের হাতে গ্রেফতারি পরোয়ানা, যাতে স্বাক্ষর আছে গুপ্ত পুলিশের প্রধান গেনরিখ ইয়াগেদারের। পুলিশের লোকেরা তখন তন্ন তন্ন করে খুঁজছে কাগজপত্র। ভোর রাতে পুলিশ চলে গেল মান্দেলশ্তামকে নিয়ে। সকাল হতেই আন্না আখমাতোভা ছুটে যান বরিস পাস্তেরনাকের বাসায়। বরিস গেলেন নিকোলাই বুখারিনের কাছে। শুধু তাই নয়, আন্না চলে গেলেন লেনিনগ্রাদে, সেখানকার পার্টি প্রধানের সাথে তাঁর পরিচয় ছিল, যে কিনা স্তালিনের ঘনিষ্ঠও—যদি তিনি কিছু করতে পারেন।

পরেরদিন আবার পুলিশ আসে। তারা তন্ন তন্ন করে খোঁজে একটি কবিতা—‘নেকড়ে’। কবিতাটি মান্দেলশ্তাম রচনা করেন কুলাকবিরোধী অভিযানে কৃষকদের ওপর দমন-পীড়নের প্রচ্ছন্ন প্রতিবাদে। দুর্দান্ত এই কবিতার অসাধারণ অনুবাদ করেছেন মাসরুর আরেফিন তার উপন্যাস আন্ডারগ্রাউন্ডে।

“…
আমাকে পথ দেখাও রাত্রির দিকে যেইখানে বয় ইয়েনিসি,
আর পাইন গাছগুলি যেইখানে উঠে যায় নক্ষত্রের দিকে,
কারণ রক্তের দিক থেকে আমি কোনো নেকড়ে যে নই,
আর আমার সমান যে-জন, আমাকে মারবো দেখো সে-ই।”

এ ধরনের কবিতা লেখার অর্থ যে নিজের বিপদ ডেকে আনা, সেটা মান্দেলশ্তাম জানতেন। ছোট খাটো গড়ন আর দৈহিক শক্তির বিচারে বেশ দূর্বল মান্দেলশ্তাম এটাও জানতেন যে তাঁর কবিতাটি এতই শক্তিশালী যা ক্ষমতাধর স্তালিনেরও ভয়ের কারণ হতে পারে। তা না হলে তিনি লিখতে পারতেন না, “…আর আমার সমান যে-জন, আমাকে মারবে দেখো সে-ই।”

আর একারণেই হয়তো মনে মনে তিনি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। তাই যদি না হবে তবে ১৯৩৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই তিনি আন্না আখমাতোভাকে কেন বলবেন, “আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত আছি।” কবিতা কতটা শক্তিশালী হতে পারে সেটা বুঝাতে মান্দেলস্তাম অন্যত্র বলেছিলেন, “একমাত্র রাশিয়াই জানে কবিতাকে সন্মান দিতে, কবিতার কারণে এখানে মানুষ হত্যা হয়। পৃথিবীতে আর কোনও দেশ আছে, যেখানে কবিতা হয়ে ওঠে হত্যার কারণ?”

সেদিন আন্নার কাছ থেকে খবর পেয়েই পাস্তেরনাক ইজভেসতিয়া কাগজের অফিসে গিয়ে সম্পাদক ও স্তালিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু নিকোলাই বুখারিনকে বারবার সনির্বন্ধ অনুরোধ করেন, কবির হয়ে স্তালিনের সঙ্গে কথা বলতে। বুখারিন স্তালিনকে একটি চিরকূট লেখেন।

এর কয়েকদিন পরে স্তালিনের ফোন আসে পাস্তেরনাকের অ্যাাপার্টমেন্টে এবং স্তালিন কোনোরকম সৌজন্য বিনিময় ছাড়াই তাঁকে বলেন যে, ওসিপের মামলাটা রিভিউ করা হচ্ছে এবং বিষয়টা ঠিক হয়ে যাবে। তারপরেই স্তালিন বিস্ময়করভাবে তাঁকে বলেন—সে কেন লেখক সংঘকে বা তাকে (স্তালিন) বিষয়টি জানায়নি, পাস্তেরনাক সেসময় চুপ ছিলেন। স্তালিন তখন প্রশ্ন করেন, ‘বরিস, ওসিপ তোমার বন্ধু, তাই না?’ পাস্তেরনাক কি উত্তর দেবেন সেটা নিয়ে তখন দ্বিধাগ্রস্ত। তিনি বুঝতে পারলেন না কী উত্তর করবেন। তিনি মিনমিন করছেন দেখে স্তালিন তখন বলেন, ‘আমি যদি কবি হতাম (বাস্তবে যৌবনে জর্জিয়ায় স্তালিনের কবিখ্যাতি ছিল), আর আমার কোনো কবিবন্ধু যদি বিপদে থাকত, তার জন্য আমি কিন্তু যা-যা করার সব করতাম।’ আত্মপক্ষ সমর্থনে মিনমিন করে পাস্তেরনাক কিছু বলতে গেলে স্তালিন আবার জানতে চাইলেন, ‘সে তো জিনিয়াস, বড় মাপের জিনিয়াস, তাই না?’ গলায় সবটুকু জোর এনে তখন পাস্তেরনাক উত্তর দিলেন, ‘কিন্তু সেটা কোনো বিষয় না।’ ‘তাহলে কোনটা বিষয়?’ স্তালিন আবার প্রশ্ন করেন। পাস্তেরনাক তখন বলেন, ‘আমি আপনার সাথে দেখা করে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।’

‘কী বিষয়ে?’ স্তালিন বললেন। ‘জীবন ও মৃত্যু’, উত্তর দিলেন পাস্তেরনাক।

এই ফোন আলাপের কথা জানাজানি হলে কবি লেখকেরা অনেকে পাস্তেরনাককে কাপুরুষ বলে নিন্দা করেন। কিন্তু মান্দেলশ্তাম নিজে অথবা তাঁর স্ত্রী নাদেঝদা সেটা কোনোদিন করেননি। বরং পাস্তেরনাক স্তালিনের সাথে এবিষয়ে কথা বলেছেন শুনে ওসিপ বলেছিলেন, ‘পাস্তেরনাক নিজেকে এর মধ্যে জড়ালো কেন? আমি নিজেই এটা থেকে বের হতে পারতাম। তাঁর এটা নিয়ে কিছুই করার ছিল না।’ মান্দেলশ্তাম জিনিয়াস কিনা স্তালিনের এই প্রশ্নের উত্তরে পাস্তেরনাক কিছু না বলায় ওসিপ বরং খুশি হয়ে বলেন, ‘স্তালিন জিনিয়াসদের ভয় পায় কেন?’

তবে পাস্তেরনাক কী সত্যিই স্তালিনের সাথে ‘জীবন ও মৃত্যু’ নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিলেন, নাকি একজন কবি, যে কিনা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে তাকে নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিলেন? কবি পাস্তেরনাক কি জর্জিয়ান কবি স্তালিনের সাথে ‘জীবন ও মৃত্যু’ নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিলেন, নাকি রাশিয়ার ভাগ্যবিধাতা শাসক স্তালিনের কাছে একজন কবির জীবন বাঁচাতে অনুরোধ করতে চেয়েছিলেন?

এখানে যে গল্পটা আমি বললাম, তার অল্প কিছুটা পাঠক পাবেন মাসরুর আরেফিনের উপন্যাসে। তাতেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, লেখক কবিকে শাসকেরা ভয় পায় কেন?

আট। উপন্যাসের গদ্যশৈলী ও মাসরুর আরেফিনের মুন্সিয়ানা

লেখকের প্রথম উপন্যাস ‘আগস্ট আবছায়া’ পড়ে প্রতিক্রিয়ায় লেখকের গদ্যশৈলী নিয়ে বলেছিলাম: “লেখকের এই উপন্যাসটি টুক করে গিলে ফেলার নয়, উপন্যাসটি পাঠ করতে পাঠককে হয়তো চিবানোর প্রস্তুতি লাগতে পারে, চোয়াল ব্যথা হতে পারে তবে পাঠ শেষে পাঠক ডালিম খাওয়ার পরিপূর্ণ আনন্দ পাবেন বলেই বিশ্বাস করি।”

তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘আলথুসার’ পড়ে লিখেছিলাম: ‘…লেখকের গদ্যরীতি যেন তাঁর একান্ত নিজস্বতা নিয়েই আরো সাবলীল, মজবুত এবং শক্তিশালী একটি ধারা হয়ে উঠেছে। এই উপন্যাসেও সেই একই দীর্ঘ লাইনে, কমা, সেমিকোলন যোগে অসাধারণ সব উপমায় লেখক ভাষার ওপর মুন্সিয়ানা দেখাতে পেরেছেন। তাঁর ভাষা এখানে আরো সংহত এবং গল্পের ঠাসবুননে অনন্য হয়ে উঠেছে। কোনো কোনো জায়গায় ‘কবি’ এবং ‘ঔপন্যাসিক’ মাসরুর আরেফিন যেন এক সঙ্গে হাত ধরাধরি করে এগিয়ে গেছেন এক নতুন এবং চমকানো গদ্যরীতির দিকে।’

এবার লেখকের তৃতীয় উপন্যাস পড়ে মনে হল, লেখক হিসেবে মাসরুর আরেফিনের ক্ষমতা বা সবচেয়ে শক্তির জায়গাটাই হচ্ছে তাঁর এক নিজস্ব গদ্যশৈলী, যা একই সাথে সাবলীল, উপমাবহুল এবং কাব্যিক। মাসরুরের গদ্যের এই কাব্যিক ক্ষমতাকে তুলনা করা চলে একমাত্র বুদ্ধদেব বসুর সাথে। ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ উপন্যাস থেকে লেখকের গদ্যরীতির কিছু অসাধারণ উদাহরণ এখানে তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি না। নায়কের বন্ধুর ছোট ভাইয়ের স্ত্রী ভ্যালেন্তিনার সাথে মস্কোর মানেঝনায়া স্কয়ারের সামনে ঢালে বসে আকাশের স্বচ্ছ নীল দেখে লেখক বলছেন:

“আবার সব চুপ। আবারও আকাশ বেশি নীল, এমন যে সেটা প্রশান্তি ও স্বচ্ছ-শান্ত-স্থিরতার নীলকে ছাড়িয়ে কেমন এক দূরত্বসূচক, বরফ-শীতল ধরনের নীল। কোনো সন্দেহ নেই এই নীলের মধ্যে সব রকমের হুমকিধামকি অনুপস্থিত, যেমন থাকে লালে বা পারপলে, এমনকি সাদায়ও। কিন্তু তারপরও সে তার রক্ষণশীলতা, তার ভেতরের প্রাচীনগন্ধী নিরাপত্তার বোধ ও গোছানো ব্যাপারটা নিয়ে মাথা এলোমেলো করে দেবার জন্য যথেষ্ট। সবটা মিলে এখানকার আকাশের এই নীল, ফ্যাকাশে নীলের বিপরীতে ময়ূরের পাখনায় বসে থাকা এই নীল, পিকাসোর ব্লু-পিরিয়ডের নীলেরই মতো—দুঃখী ও দূরের, গা ছাড়া ও মনখারাপের আত্মগত সংলাপের।”

কিংবা লেখক পরক্ষণেই বলছেন:

“আমি ভাবলাম, আর একটু যদি ধরা যাক ব্লুবেরি ব্লু-টা হতো এই আকাশ, আর মাত্র এক শেড বেশি ব্লু, তা হলেই সবটা লাগতো বিষের মতো—বিষের রং যেহেতু নীল; ওজন কমানোর জন্য যেহেতু নীল রঙের প্লেটে খেতে বলা হয় মোটা মানুষদের। আমার মনে হলো ভ্যালেন্তিনাকে জানাই যে, সাদাতকে নিয়ে এমন আজগুবি সব কথা তার মনে হচ্ছে একটা কারণেই—কারণ আকাশ এত নীল; আর নীল হচ্ছে সেই রঙ যা ঢেউ-ওঠা সমুদ্র, যা তড়পিয়ে ওঠা ঘুম এবং যা অমঙ্গলেচ্ছায় ভরা সন্ধ্যা। নীল আকাশেই তো কেমন হঠাৎ হঠাৎ ঝড় ওঠে, আবার নীল পানিই গজরায় সামান্য দূরের ওই কাস্পিয়ান সাগরেও, এমনভাবে যে পৃথিবী যেন সে সময় বলতে থাকে, ‘কিছুই বুঝছি না, কে কী চাইছে কিছুই আর ধরে ওঠা যাচ্ছে না গো।’ (পৃষ্ঠা – ৪৬)

লেখক গোটা উপন্যাস জুড়ে এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করেছেন যেগুলো ক্ষেত্র বিশেষে নতুন, অভিনবও বটে এবং একই সাথে ভীষণ কাব্যিক। যেমন বার্চ গাছের বর্ণনায় লেখক বলছেন, ‘…ওদের কাণ্ডের সাদা রং আসলে রূপালি। ওদের গড়ন কমনীয়, হাত-পা মেয়েদের মতো দীঘল, ভাবভঙ্গিতে তীব্র বায়ু চলাচলের সামনে দাঁড়ানোর অস্থিরতা আর পাতাগুলো অনবরত ফির-ফির।’ (পৃষ্ঠা -১১)

কী অপূর্ব বাংলা গদ্য!

নয়। মিকি ও সেবাস্তিয়ান—’আন্ডারগ্রাউন্ড’ উপন্যাসের অভিনব দু’টি চরিত্র

‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ উপন্যাসে অদ্ভুত এবং একইসাথে সুন্দর দু’টো চরিত্রের কথা উল্লেখ না করলে উপন্যাসটির এবং লেখকের ক্ষমতার প্রতি অবিচার করা হবে।

এর একজন হলো মিকি। কে এই মিকি? উপন্যাসের কোথাও মিকির পরিচয় স্পষ্ট করা হয়নি। মিকিকে সিম্বলই বলা যায়। এই পৃথিবী বিপদের। হতভম্ব মানুষের মুখে আর যখন কোনো ভাষা নেই তাদের রাগ-দুঃখ-ক্ষোভ প্রকাশের, তারা তখনই মিকিকে খোঁজে। মিকি যেন তাদের কাছে কোনো একটা আশ্রয়। আবার শক্তিমানদের কাছে মিকি তাদের পোষা পশু, যাকে দিয়ে অন্যদের হুমকিও দেয়া হয়। মিকি তখন বিপদেরও প্রতীক, বিপদ উত্তরণেরও। মিকি আবার একটা গালিও। মিকি এক ধরনের চোখের ঠুলি বা সানগ্লাস, যা পরে থাকলে দুনিয়াকে শুধুই রঙিন মনে হয়। কামালের ভাষায়: “পভার্টি-ব্লকিং আইগ্লাস, যা পরে থাকলে দুনিয়ার কোনো সমস্যাকেই চোখে দেখতে হয় না…পৃথিবী তখন যেন বড্ড সুন্দর এক রজনীগন্ধা”। তাই মিকি যেন মেকি অথবা মিকিমাউসের একটা ঠাট্টাও। মিকি দুনিয়ার অনেক কিছুর অর্থহীনতা।

ঠিক তেমনিভাবে এসেছে সেবাস্তিয়ান চরিত্রটি। বাস্তবে সেবাস্তিয়ানদের কোনো অস্তিত্ব নেই। ছোটবেলায় যাত্রাপালা যারা দেখেছেন, তারা জানেন যে, সেখানে ‘বিবেক’ বলে একটা চরিত্র থাকে ৷ সেবাস্তিয়ান এ উপন্যাসে অনেকটা নায়কের বিবেক, নায়কের নিজের সঙ্গে নিজে বিড়বিড় করে কথা বলার সঙ্গী। বোঝাই যায়, সে আসলে ঘরের টিকটিকি। নায়ক বলে, ড্রাগন (টিকটিকি যেহেতু ড্রাগনের মিনিয়েচার রূপ) । এরই সঙ্গে নায়ক কথা বলে একা একা। সেবাস্তিয়ান তাই বিবেকহীন এই সময়ে আমাদের বিবেকের কল্পনা।

দশ। উপন্যাসের পরিশিষ্ট ও পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের দলিল নিয়ে কয়েকটা কথা

উপন্যাসে লেখক ১৮১ থেকে ১৯০ পৃষ্ঠা পর্যন্ত ‘দি মান্দেলশ্তাম ফাইল’ নিয়ে পূঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করেছেন এবং আবার মান্দেলশ্তামের কেসের ডকুমেন্টগুলো উপন্যাসের পরিশিষ্ট হিসাবে ২০৯ থেকে ২৩৮ পৃষ্ঠা পর্যন্ত জুড়ে দিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে ঔপন্যাসিক মাসরুর আরেফিন এই কাজটি কেন করলেন? এটা কি জরুরি ছিল?

এই প্রশ্নের উত্তর ওসিপের স্ত্রী নাদেঝদা মান্দেলশ্তামের জবানিতে শোনা যাক: “কে আছে যে স্রেফ কবি ওসিপ মান্দেলশ্তামের এই বীভৎস আর্কাইভের পাতাগুলো ছেনেছুনে দেখবে? তবে যে দেখবে সে জানতে পারবে এই পৃথিবীকে কী করে চালানো হয়ে থাকে।” (পৃষ্ঠা -১৮১)

সেই ফাইলের পরের পৃষ্ঠায় ছোট ফন্টে লেখা, “…আপনারা এর মাধ্যমে (ডকুমেন্টগুলো) শুধু জানবেন, বন্দিদের কী করে প্রসেস করা হতো, আর কি করে কাউকে মৃত্যুর দিকে ধেয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কেন তা হয়, তা অবশ্য ওই ‘কী করে’-র মধ্যেই নিহিত, যেহেতু কী-কেন-কীভাবে মিলে একটাই সর্বক্ষমতাধর সিস্টেম।”

পাঠকদের পড়ার আনন্দ যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য এ বিষয়ে এখানে বিস্তারিত আলাপে যাচ্ছি না। শুধু এটুকু বলি, এই ডকুমেন্টস্ প্রমাণ করে যে, একজন মানুষকে অর্থাৎ একজন কবি মান্দেলশ্তামকে হত্যার করার যে অফিসিয়াল রাষ্ট্রীয় আয়োজন, স্তরে স্তরে নানান মানুষের স্বাক্ষর, অনুমোদন, অথবা যাকে শাস্তি দেয়া হয়, সাজার আদেশপত্রে সেই মান্দেলশ্তামের স্বাক্ষর নিয়ে কনফার্ম করা হয় যে, সাজার আদেশপত্র তিনি পড়েছেন বা তাকে পড়ানো হয়েছে, আবার এটার অর্থ এটাও হতে পারে যে, কোর্টরুমে তাকে রায় শোনানো হয়নি। এই সবকিছুর মধ্য দিয়ে সেই একটা জিনিসেরই জানান দেয়া হয় যে, সবকিছুই ঘটছে নিয়ম মেনে, আর  রাষ্ট্রের তরফে এই নিয়ম মেনে ঘটনা ঘটাবার নামই ন্যায়বিচার।

এগারো। উপসংহার

প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রে কবিদের কোনো স্থান রাখেননি, তাদেরকে নির্বাসনে পাঠাতে চেয়েছেন। কেন? প্লেটোর নিজের ভাষাও তো কাব্যিক। স্বভাবে কবি হয়েও কবিদের ওপর তাঁর এতটা রাগ কেন? সেটা কি এই কারণে যে, কবি ও কবিতা একটা দৈবসত্তা এবং তা সবকিছুর উর্দ্ধে, যা কিনা প্লেটোর স্বাধীন চিন্তার বিরোধী? না, সেসব কিছু নয়। আসল কথা হলো, এত বড় পণ্ডিত যে প্লেটো, গণতন্ত্রের ওপরে তাঁর আস্থা ছিল না। তাই তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রটিও আসলে একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র। আর সেই রাষ্ট্র ছিল শ্রম বিভাজনের—দার্শনিকরা সেখানে শাসন করবে, সৈনিকরা করবে যুদ্ধ; এবং শ্রমজীবী মানুষ, যাদেরকে আমরা আমজনতা বলি, তারা করবে উৎপাদন। ফলে সেখানে কবিদের স্থান কোথায়? তারা তো সব ‘imitator’—প্লেটোর ভাষায়।

বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নায়ক লেনিন জীবনে একটি মাত্র কবিতা লিখেছেন, সেই কবিতার একটা বাংলা অনুবাদও পাওয়া যায়। কবিতা না লিখলেও লেনিনের সাহিত্যপ্রীতি ছিল অসাধারণ। তিনি ‘প্রলেতেরিয়ান সাহিত্য ও শিল্প’ ধারণার বিরোধী ছিলেন, আর এই কারণে কবি মায়াকোভস্কির কবিতা তিনি অপছন্দ করতেন, যদিও লেনিনকে নিয়ে মায়াকোভস্কি ৫টি কবিতা লিখেছিলেন। সেই লেনিনও গৃহযুদ্ধ চলাকালে কাগজের ঘাটতির কারণে মায়াকোভস্কির নতুন কবিতার বদলে প্রচারণামূলক লিফলেট ছাপানোর পক্ষে ছিলেন। যদিও লুনাচারস্কির কারণে শেষতক কবিতাই ছাপা হয়েছিল।

স্তালিন যৌবনে কবি ছিলেন। তাঁর কবিতা একেবারে যেনতেন ছিল, তা-ও না। সেই স্তালিনের আমলেই অসংখ্য কবি, সাহিত্যিকের জীবন কাটলো গুলাগে, তিলে তিলে মৃত্যু ঘটল কারো, কারো কারো মৃত্যুদণ্ড হলো। কবিদের ওপর রাষ্ট্রনায়ক বা রাষ্ট্রের এত ঘৃণা বা বিদ্বেষ কেন? কারণ কী এই যে, কবি সত্যদ্রষ্টা হয় ওসিপ মান্দেলশ্তামের মতো? কারণ কী এই যে, কবি তার লেখনির মাধ্যমে রাষ্ট্রনায়কের সমান হয়ে ওঠে বা আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে, যেমন ওসিপ হয়ে উঠেছিলেন? সবাই তো স্তাবক হয় না, যেমনটা স্তালিনের সময়েও ছিল, এখনও আছে। এদের অনেকে স্তাবক হয় সংস্কারে বা বিশ্বাসে, কেউ কেউ ভয়ে, কেউবা নিজের বিবেক-বুদ্ধি সব বন্ধক দিয়ে; আবার অনেকেই স্বার্থপরতায় ও আত্মপ্রবঞ্চনায়। অন্যদিকে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘উলঙ্গ রাজা’ কবিতার মতো ‘সত্যবাদী, সরল এবং সাহসী শিশুও’ থাকে। ওসিপ মান্দেলশ্তাম সেই শিশু। যুগে যুগে শাসকদের, রাষ্ট্রের একটাই ভয়, কখন কোন সত্যবাদী শিশু বলে ওঠে, “রাজা, তোর কাপড় কোথায়?”

মাসরুর আরেফিনের ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ উপন্যাস তাই বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেবার রহস্য বোঝার পাশাপাশি ইতিহাসের ‘সত্যবাদী শিশুদের’ প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের এক অনন্য দলিলও বটে।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top