পার্পল হিবিস্কাস (৭ম পর্ব)// চিমামান্ডা নগোজি আদিচে // ভাষান্তর: দিলশাদ চৌধুরী 

দুপুরের খাবারে ছিলো জোলোফ পোলাউ, হাড় কড়কড়ে না হওয়া অব্দি ভাজা মুঠোর সমান আজুর টুকরো আর নগউনগউ বা ছাগলের মাংসের স্যুপ। নগউনগউয়ের বেশিরভাগই বাবা খেলো, কাছের বাটির ওই মশলাদার তরলে চামচ ডুবিয়ে। মধ্যবর্ষার নীলচে ঘন মেঘের মত এক নিস্তব্ধতা খাবার টেবিল ঘিরে রইলো। একমাত্র বাইরের ওচিরি পাখির ডাকাডাকিই স্তব্ধতায় আঘাত হানছিল। প্রতিবছর বৃষ্টি শুরুর প্রথমদিকেই ওরা আসে আর খাবার ঘরের সোজা বাইরের আভোকাডো গাছটায় বাসা বাঁধে। আমি আর জাজা মাঝেমধ্যেই মাটিতে পড়ে থাকা পাখির বাসা পেতাম যেগুলো তৈরি হতো জড়ানো ডালপালা, শুকনো ঘাস আর সুতার টুকরো যেগুলো মা ব্যবহার করত আমার চুল বেণি করতে, ওচিরিটা সেগুলো তুলে আনে পেছনের ময়লার ঝুড়ি থেকে।
সবার প্রথমেই আমি দুপুরের খাবার শেষ করলাম। “ধন্যবাদ ঈশ্বর, ধন্যবাদ বাবা, ধন্যবাদ মা।”  হাত গুটিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম সবার খাওয়া শেষ হবার জন্য যাতে আমরা প্রার্থনা করতে পারি। কারো মুখের দিকে তাকালাম না, তার বদলে বিপরীত দেয়ালে টাঙানো দাদাজানের ছবিটার দিকে মনোযোগ দিলাম। বাবা যখন প্রার্থনা শুরু করলো তার গলা প্রতিদিনের চেয়েও অনেক কাঁপা কাঁপা শোনাচ্ছিল। সে প্রথমে খাবারের জন্য ধন্যবাদ জানাল, তারপর সে ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চাইলো তাদের জন্য যারা ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধাচারণ করার চেষ্টা করেছে, যারা নিজেদের স্বার্থপর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়েছে এবং ধর্মসভার পর ঈশ্বরের পরম ভৃত্যের সাথে দেখা করতে যেতে চায়নি। মায়ের “আমিন” সারা ঘরে প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে পড়লো।
দুপুরের খাবারের পর নিজের ঘরেই ছিলাম, জেমসের অধ্যায় পাঁচ পড়ছিলাম কারণ পারিবারিক সময়ে আমি পীড়িতের সেবার বাইবেলীয় উৎস সম্পর্কে বলব, তখনই শব্দটা শুনলাম। দ্রুতগতির ধুপধাপ শব্দ যেটা মা বাবার ঘরের হাতে খোদাই করা দরজার ওপর আছড়ে পড়ছিলো।  প্রাণপণে ভাবার চেষ্টা করলাম যে ঘরের দরজা হয়ত আটকে গেছে আর বাবা সেটা খোলার চেষ্টা করছে। ব্যাপারটা এমন ছিলো যেন আমি যদি একটু বেশি শক্তি লাগিয়ে চিন্তা করি তাহলে আমার ধারণাটাই যেন সত্যি হয়ে যাবে। আমি নিচে বসলাম, চোখ বন্ধ করে গুনতে শুরু করলাম। গুনাগুনির জন্য সময়টা তত দীর্ঘ মনে হচ্ছিলো না, ব্যাপারটাকে ততটা খারাপ মনে হচ্ছিলো না। কখনো কখনো তো ব্যাপারটা আমি বিশ অব্দি পৌঁছানোর আগেই শেষ হয়ে যেত। আজ উনিশেই শব্দ থেমে গেলো। দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেলাম। সিঁড়িতে বাবার পদক্ষেপ প্রতিদিনের চেয়ে অনেক বেশি ভারী আর অদ্ভুত শোনাচ্ছিল। আমি নিজের ঘরের বাইরে বের হলাম, ঠিক যেমনটা জাজাও করলো। আমরা সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে বাবাকে নামতে দেখলাম। মা তার কাঁধের ওপর পড়ে ছিলো এমনভাবে ঠিক যেভাবে তার ফ্যাক্টরির কর্মচারীরা চালের জন্য পাটের বস্তাগুলোকে কাঁধে ডাই করে সেমে সীমান্তে নিয়ে আসতো। বাবা খাবার ঘরের দরজা খুললো। তারপর মূল দরজা খোলার শব্দ শুনলাম আর শুনলাম দারোয়ান আদামুকে কিছু বলতে।
” মেঝেতে রক্ত,” জাজা বললো, “আমি বাথরুম থেকে বুরুশ নিয়ে আসছি।”
আমরা রক্তের রেখাগুলো পরিষ্কার করে ফেললাম। দেখে মনে হচ্ছিলো যেন কেউ একটা ভাঙা লাল জলরঙের কৌটো নিয়ে রঙ ফেলতে ফেলতে নিচে নেমে গেছে। জাজা ঘষলো, আমি মুছে দিলাম।
মা ওইদিন রাতে আর বাড়ি ফিরলো না, আমি আর জাজা একাই রাতের খাবার খেলাম। আমরা মায়ের ব্যাপারে কোনো কথা বললাম না। তার বদলে কথা বললাম ওই তিন লোককে নিয়ে, দুদিন আগে মাদক ব্যবসার অপরাধে যাদের প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। জাজা কিছু ছেলেকে স্কুলে এটা নিয়ে কথা বলতে শুনেছে। এই ঘটনা নাকি টিভিতেও দেখিয়েছে। লোকগুলোকে খুঁটির সাথে বাঁধা হয়েছিলো, গুলির প্রবেশ বন্ধ হবার পরেও তাদের শরীর সমানভাবে কাঁপছিলো। আমি জাজাকে বললাম আমার ক্লাসের একটা মেয়ে কি বলেছে, ওর মা নাকি টিভি বন্ধ করে দিয়েছিল, তারপর বলছিল কেন সে এভাবে স্বজাতির মানুষদের মৃত্যু দেখবে, আর যেসব লোক মৃত্যুদণ্ড দেখতে ওই জায়গায় উপস্থিত হয়েছে, তাদেরই বা কি সমস্যা!
রাতের খাবারের পর জাজা প্রার্থনা করলো আর শেষে মায়ের জন্য একটা বিশেষ ছোট প্রার্থনাও যোগ করলো। বাবা যখন ফিরলো তখন আমরা পড়ছিলাম, আমাদের সময়সূচির তালিকা অনুযায়ী। বাবা যখন আমার ঘরে এলো তখন আমি আমার জুনিয়র মাধ্যমিক স্কুলের কৃষি পরিচিতি বইয়ের ভেতরের পাতায় দাগ টেনে গর্ভবতীর ছবি আঁকছিলাম। বাবার চোখ ছিলো গর্তে বসা, লালচে, আর সে কারণেই যেন বাবাকে কম বয়সী লাগছিল, সাথে দুর্বলও।
” তোমার মা কাল চলে আসবে, তোমরা স্কুল থেকে ফিরে আসার আগেই। সে ভালো হয়ে যাবে,” বাবা বললো।
” আচ্ছা বাবা,” আমি তার মুখের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বইয়ে মনোযোগ দিলাম।
সে আমার কাঁধ স্পর্শ করলো, হালকা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পালিশ করে দিল। তারপর বললো, “দাঁড়াও।”
আমি উঠে দাঁড়ালে বাবা আমায় জড়িয়ে ধরলো, বুকের সাথে মিশে গিয়ে তার নরম চামড়ার নিচের হৃদকম্পন আমি শুনতে পেলাম।
মা পরেরদিন বিকেলে বাড়ি ফিরলো। কেভিন তাকে পগেট ৫০৫ গাড়িটায় নিয়ে এলো যেটার প্যাসেঞ্জার দরজায় বাবার কোম্পানির নাম খোদাই করা ছিল, যেটা আমাদের স্কুলে যাতায়াতে ব্যবহৃত হত। জাজা আর আমি প্রায় কাঁধে কাঁধ ছুঁইয়ে পাশাপাশি সদর দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম, আর মা দরজা অব্দি আসার আগেই দরজা খুলে দিলাম। “উমু ম,” সে আমাদের জড়িয়ে ধরে বললো, “আমার বাচ্চারা।”
তার পরনে ছিলো সেই একই ‘ঈশ্বর এক ভালোবাসা’ লেখা টিশার্ট। তার সবুজ ঘাঘরা তার কোমরের কিছুটা নিচে ঝুলছিল, প্রতিদিনের চেয়ে একটু বেশি নিচে ; ওটাকে পাশের দিকে এক অলস গিঁটের সাহায্যে কোনরকমে আটকে রাখা হয়েছে। তার চোখদুটো ছিলো শুন্য, সেসব পাগল লোকদের মত যারা রাস্তার পাশের ময়লার স্তুপ ঘেটে বেড়ায়, স্তুপের মধ্যে থেকে ছেঁড়া ময়লা ক্যানভাস ব্যাগ টেনে বের করে আনে যেন ওগুলোর মধ্যে তাদের এক টুকরো জীবন আটকে আছে। ” একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে সোনা, বাচ্চাটা আর নেই,” সে বললো।
আমি একটু পেছনে সরে এলাম। মায়ের পেটটার দিকে তাকালাম, ওটা এখনও ফোলা লাগছিল, এখনও ওটা তার ঘাঘরাটাকে সামান্য ফুলিয়ে রেখেছিল। মা কি নিশ্চিত যে বাচ্চাটা আর নেই?
আমি তখনও মায়ের পেটের দিকে তাকিয়েছিলাম যখন সিসি ভেতরে এলো। সিসির গালের হাড় এতটাই উঁচু ছিলো যে ওর মুখভঙ্গিতে সবসময় একটা লালিত্যহীন ভয়ানক আমুদে ভাব থাকতো, যেন ও তোমায় ব্যঙ্গ করছে, তোমায় নিয়ে ঠাট্টা করছে, কিন্তু তুমি বুঝতেই পারছো না কেন। “শুভ অপরাহ্ন প্রিয় ম্যাডাম,” সে বললো। “আপনি কি এখন খাবেন নাকি গোসলের পরে?”
“হ্যাঁ?” এক মুহুর্তের জন্য মা এমনভাবে তাকালো যেন সে শোনেইনি সিসি কি বলেছে। “এখন না সিসি, এখন না। আমাকে পানি আর একটা তোয়ালে এনে দাও।” যতক্ষণ না সিসি একটা প্লাস্টিকের বাটিতে পানি আর ছোট তোয়ালে এনে দিলো, মা বসার ঘরের ঠিক মাঝখানে নিজেকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো।
তাকটাতে তিনটি ধাপ ছিলো নাজুক কাঁচের তৈরি, আর প্রত্যেকটা ধাপে ছিল একটা করে হলদে বাদামি রঙের ব্যালে নাচিয়ের মূর্তি। মা নিচের ধাপ থেকে শুরু করলো, তাক আর মূর্তি দুটোই মোছা। আমি তার সবচেয়ে কাছের চামড়ার সোফাটায় বসলাম, ততটাই কাছে যতটায় হাত দিয়ে তার ঘাঘরা ঠিক করে দেয়া যায়। ” সোনা, এটা তোমার পড়ার সময়। ওপরে যাও,” সে বললো।
“আমি এখানে থাকতে চাই।”
(চলবে….)

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top