মান্টোর ‘কালো সীমানা’ : দেশভাগের ছায়াচিত্র // নূর সালমা জুলি

সাদত হাসান মান্টো(১৯১২-১৯৫৫) উর্দু সাহিত্যের যশস্বী লেখক । দেশভাগ গভীরভাবে তাঁর লেখায় ফুটে উঠেছে । নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে দেখেছেন ইতিহাসের এই নির্মম সত্য ঘটনাকে । বারবার সেই রক্তাক্ত সময় তার সমস্ত কাঁটাছেঁড়া নিয়ে মান্টোর কলমে জায়গা করে নিয়েছে । আর জাত শিল্পীর মতো অক্ষরের বিন্যাসে সেই অন্ধকারদিনের ছায়াচিত্র এঁকেছেন মান্টো । কোথাও বাড়াবাড়ি নেই এ যেন বাস্তবতার আরেক রূপায়ণ । বিষণ্ন ইতিহাস কথা বলে মান্টোর লেখায় । ‘সিয়াহ হাশিয়ে’ বা ‘কালো সীমানা’ গল্পগ্রন্থটি ১৯৪৮ সালে বেরোয় । উর্দু থেকে ভাষান্তর করেন জাভেদ হুসেন । মোট ৩২টি গল্প রয়েছে । প্রায় সবগুলোই এই উপমহাদেশের অত্যন্ত মর্মপীড়াদায়ক ঐতিহাসিক ঘটনা দেশভাগ নিয়ে । রাজনীতির চুলচেরা বিশ্লেষণে মান্টোর আগ্রহ নেই বরং তিনি দেখান রাজনীতির পাশাখেলায় ব্যক্তিমানুষ কতটা ক্ষত-বিক্ষত হয় । তাদের রক্তক্ষরণের লেখচিত্র আঁকেন মান্টো । এই গ্রন্থের কয়েকটি গল্প(সহযোগিতা, বাঁটোয়ারা, যথার্থ ব্যবহার, কেরামতি, লোকসান, পাশবিক,  আতিথেয়তা, জুতো) ‘টোবাটেক সিং ও অন্যান্য গল্প’ গ্রন্থেও আছে । নিজ বাসভূমে পরবাসী হওয়ার যন্ত্রণা বারবার সভ্যতাগর্বী মানুষকে পেতে হয় । মানুষই সভ্যতা বিনির্মাণ করে আবার চূড়ান্ত পশুত্বও দেখায় । আর এসবের শিকার মানুষই ভালো এবং মন্দ দুই অর্থেই । মান্টো ইতিহাসের ধ্বংসাত্মক ঘটনার চিত্রায়ন করেছেন নিজস্ব ভঙ্গিতে । গল্প বলার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর । “মৃত্যুর এক বছর আগে লেখা নিজের এপিটাফে তিনি বলে গেছেন, ‘এখানে সমাধিতলে শুয়ে আছে মান্টো আর তাঁর বুকে সমাহিত হয়ে আছে গল্প বলার সব কৌশল আর রহস্য ।'” কখনও এক বাক্যে কখনও দুচার বাক্যে আর কখনওবা এক দেড় পৃষ্ঠায় জীবনের বয়ান করেন নির্মেদ গদ্যে মান্টো । তিনি যে নগ্ন বাস্তবতার রূপায়ণ করেন সেখানে আসলে ইমেজারি গদ্যের খুব বেশি প্রয়োজন পড়ে না । তাঁর ভাষা শানিত, ধারালো, চাঁছাছোলা । আর তাঁর নর-নারীরা মাটিঘেঁষা । কেউ প্রতিক্রিয়াশীল আর কেউবা প্রতিক্রিয়ার শিকার ।

গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘মিষ্টি খাওয়া’। এক বাক্যের গল্প । মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুতে অমৃতসর, গোয়ালিয়র আর বম্বেতে মিষ্টি বিতরণ হয়েছে । এর বেশি আর কিছু বলেন না লেখক । বুঝে নেওয়া পাঠকের কাজ । ‘মজুরি’ গল্পে দাঙ্গার সময় লুটের চিত্র আছে সাথে এক গরিব কাশ্মীরির চালের বস্তা নিয়ে পালানোর মর্মন্তুদ আলেখ্য । ‘সহযোগিতা’ গল্পটি আরেক গ্রন্থে ‘ধৈর্য’ নামে আছে । এখানে গৃ্হকর্তা লুটেরাদের নিজের পোষা কুকুর দিয়ে শাস্তি দেয় । ‘বাটোয়ারা’ ও অন্য গ্রন্থে আছে । লুটের মাল ভাগ করার করুণ পরিণতি দেখানো হয়েছে । ‘যথার্থ ব্যবহার’ অন্য গ্রন্থে আছে এবং বিষয়ও প্রায় আগের গল্পটির কাছাকাছি । ‘বেখবর থাকার সুবিধা’ গল্পে মান্টো তাঁর স্বভাবসুলভ ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে বয়ান করেন জীবনকে । বিষয় দাঙ্গাকারীদের নির্মমতা । ‘যথাযথ পদক্ষেপ’ এ দেখা যায় অনেকটা ‘গুরুমুখ সিংয়ের অঙ্গীকার’ গল্পের মতো বিষয় । মানুষ হত্যা হবে সে যেভাবেই হোক । রিউমার মানুষকে পশু বানিয়ে দেয় কিংবা হুজুগ বুদ্ধিকে নাশ করে । ‘কেরামতি’ গল্পটি ‘অলৌকিক’ নামে আছে অন্যত্র । দাঙ্গা আর সংস্কার একাকার হয়ে গেছে এখানে । ‘সংশোধন’ গল্পে দাঙ্গাকারীরা ধরম চাঁদের পাজামা নামিয়ে দেখে এবং তাকে খুন করে । একাত্তরে এই নাটকের অভিনয় বাংলাদেশে হয়েছে । তাই বলছিলাম মান্টো এবং মান্টোর বিষয় সবসময় প্রাসঙ্গিক । ‘জেলি’ গল্পে রক্ত আর বরফ জেলি হয়ে ধরা পড়ে এক বাচ্চা ছেলের কাছে । সমাজবাস্তবতার এও এক রূপ । জীবনের পরাজয় হিংসার কাছে ।
‘চ্যালেঞ্জ’ এক বাক্যের গল্প । দাঙ্গায় সব পুড়ে শেষ । শুধু একটা সাইনবোর্ড, “‘এখানে বাড়ি বানানোর মাল-সামান পাওয়া যায়।'” অনেকটা দুর্ঘটনায় গাড়ি দুমড়েমুচড়ে গেলেও জ্বলজ্বল করা ঐ স্টিকারের মতো ‘সাবধানে গাড়ি চালাবেন । একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না’ । ‘পাঠানিস্তান’, ‘খবরদার’, ‘একেবারে ছুটি’, ‘জবাই আর কোপ’ গল্পগুলোতে দাঙ্গাকারীদের হঠকারী কাজগুলো ব্যঙ্গাত্মকভাবে দেখানো হয়েছে । ‘লোকসান’ গল্পটি অন্য গ্রন্থে ‘ঘাটের সওদা’ নামে আছে । বেয়াল্লিশ টাকায় কেনা মেয়েটিকে ব্যবহার করার পর যখন জানতে পারে যে সে নিজের ধর্মের তখন তাকে ফেরত দিয়ে যায় দুই বন্ধু । অন্য ধর্মের  হলে কোন সমস্যা ছিল না । আর ‘পাশবিক’ গল্প যার আরেক নাম ‘পশু’ তে বুদ্ধিদীপ্তভাবে দাঙ্গার সময়ের মানুষের সংকটকে তুলে ধরা হয়েছে । ‘সার’ গল্পেও এমনটা আছে । ‘আতিথেয়তা’ গল্পের আরেক নাম ‘আপ্যায়ন’ এখানেও দাঙ্গাকারীদের নির্মমতাকে রূপায়ণ করা হয়েছে । এক বাক্যের গল্প ‘দৃঢ়তা’ । একজনের শিখ হতে না চাওয়ার ইচ্ছেই এই গল্পের বিষয় । যা বুঝার তা পাঠক বুঝে নেয় । ‘নজরদারি’তে দেখা যায় দাঙ্গায় মানুষের মৃত্যুকে কুকুরের বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে ।
‘জুতো’ গল্পের আরেক নাম ‘জুতার মালা’। স্যার গঙ্গারামের মূর্তিকে অপমান করে আবার তাঁর নামের হাসপাতালে দাঙ্গাকারীরা চিকিৎসার জন্য যায়। ‘দূরদৃষ্টি’, ‘সরি’, ‘দয়া’ এবং ‘পরিচ্ছন্নতা’ গল্পে দাঙ্গাকারীদের নির্মম রসিকতাকে অত্যন্ত পরিমিত বয়ানে তুলে ধরা হয়েছে । যেমন : দয়া করে বাপের সামনে না মেরে মেয়েকে আড়ালে গিয়ে মারে দাঙ্গাকারীরা । এটাই দাঙ্গাকারীদের অসহায় বাপের প্রতি দয়া । ‘সব তার দয়া’ দুই বাক্যের গল্প । কেউ উপকৃতও হয় সহিংসতার মধ্যে । ‘সাম্যবাদ’ এ লুটেরাদের প্রসঙ্গ এসেছে । ‘ভর্ৎসনা’ দুই বাক্যের গল্প । ব্ল্যাকের দুই নম্বর পেট্রলে দোকান না পোড়াতে পারার আক্ষেপ দাঙ্গাকারীর । ‘বিশ্রাম’ও দুই বাক্যের গল্প । গল্পটি এমন :
 ‘আরে মরেনি! এখনো বেঁচে আছে! ‘
 ‘থাক দোস্ত…খুব ক্লান্ত হয়ে গেছি!’
আর কিছুর দরকারও পড়ে না । তুলির একটা আঁচড়ে দাঙ্গার নিষ্ঠুরতার চিত্র এঁকেছেন মান্টো । ‘কপাল’ও দুই বাক্যের গল্প । লুটেরার দল মেহনত করে বাক্স খুলে দেখে ভেতরে শুয়োরের মাংস । এমন বিষয় গ্রন্থের শেষ গল্প ‘ধরাকে সরা’তে রয়েছে । তিন বাক্যের এই গল্পে দেখা যায় মসজিদে শুয়োর আর মন্দিরে গরু জবাই । প্রতিক্রিয়াশীলতা কোন পর্যায়ে যায় মান্টোর কলম তার নিঁখুত ছবি আঁকে । একএকটা গল্প স্কেচের মতো ইতিহাসের অন্ধকারকে রূপায়িত করেছে ।
উর্দু ভাষা ও সাহিত্যে বিষয়ে বিজ্ঞ অনুবাদক জাভেদ হুসেনের ভাষাও চমৎকার । তাঁর যথাযথ শব্দচয়ন আর সাহিত্যবোধ অনুবাদকর্মটিকে পাঠকের মনের অন্দরে সহজ প্রবেশের পথ করে দিয়েছে । মান্টোর সেন্স অব হিউমারকে রূপায়ণে অনুবাদকের মুন্সিয়ানা তারিফযোগ্য । সাথে আছে ‘মান্টোর বিভীষিকার নন্দনতত্ত্ব’ শিরোনামে মান্টোর দেশকাল আর শিল্পিমানস নিয়ে অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত এবং গভীরতলসঞ্চারী আলোচনা । যা পাঠককে মান্টোবিশ্বে স্বচ্ছন্দ বিচরণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে । অনুবাদকর্মও বড় রকমের শিল্প । যদি তা কুশলী কারিগরের হাতে পড়ে । আর এক্ষেত্রে অনুবাদক জাভেদ হুসেনের পারঙ্গমতা বলার অপেক্ষা রাখে না ।
মান্টোর ‘টোবাটেক সিং ও অন্যান্য’ গল্পগ্রন্থে বিচিত্রভাবনার গল্প জায়গা পেয়েছে দেশভাগের পাশাপাশি । শৈলীগত পরিচর্যার ক্ষেত্রে একটু বেশি মনোযোগ লক্ষ করা যায় ‘কালো সীমানা’র চেয়ে । আমরা ‘কালো সীমানা’ লেখার প্রেক্ষাপট জানি । দেশভাগের শিকার মান্টো অভ্যস্ত জীবন ছেড়ে লাহোরে গিয়ে নতুন পরিবেশে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে যখন অনেকটা পর্যুদস্ত তখন জীবন আর জীবিকার জন্য কলম ধরতে হয় । বিভীষিকাময় অনুভবের সাথে বিশ্বাসভঙ্গের যন্ত্রণা আর বুকের অনিঃশেষ ক্ষরণ মিলেমিশে একাকার হয়ে অক্ষরের রূপ পেয়েছে ‘কালো সীমানা’য় । তাই শৈলীগত দিকটা হয়তো দুএকটা ক্ষেত্রে উপেক্ষিত হয়েছে । অতি সংক্ষেপিত হওয়ায় কিছু লেখা রিপোর্টসদৃশ হয়েছে । যেমন : ‘ধরাকে সরা’ । অবশ্য মেসেজ নেই এই গল্পে এমনটা বলা যাবে না । আবার ‘বিশ্রাম’ এর মতো দুই বাক্যের গল্পটি উৎরে গেছে । এর অতি পরিমিত বয়ানও পাঠকের চেতনাকে ঘা দিতে সক্ষম । ব্যক্তির নিষ্ঠুরতা অনুভূতিকে অসাড় করে দেয় যেন । তারপরেও নন্দনতাত্ত্বিকবিচারে ‘কালো সীমানা’ ছোটখাটো দুএকটা কিন্তুর জন্ম দিলেও বিষয়ের গভীরতার ব্যাপকতায় তা কাটিয়ে উঠবে স্বচ্ছন্দে ।
মান্টোর ‘কালো সীমানা’য় প্রকরণগত পরিচর্যায় অভিনবত্ব আছে । কিছুটা নিরীক্ষাপ্রবণতাও গোচরীভূত হয় । অবশ্য গল্প বয়ানে মান্টো মোপাসাঁ বা হেনরির মতো শেষে চমক দিতে পছন্দ করেন । আর সাথে রয়েছে তাঁর স্বভাবসুলভ স্যাটায়ার আর হিউম্যার এর প্রয়োগ । দাঙ্গাকারী আর লুটেরাদের নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা এবং সাধারণ মানুষের অসহায়তার বাস্তবঘন ছায়াচিত্র ‘কালো সীমানা’র ক্ষুদে শরীরখানি । ক্ষুদে কিন্তু ভাবনার রাজ্যে ঝড় তুলতে, চেতনাকে ঘা দিতে অদ্বিতীয় এই গভীরতলসঞ্চারী গল্পগ্রন্থটি । রাজনীতি আর তার জটিল সমীকরণ ব্যক্তিমানুষের জীবনকে কতটা অনিশ্চয়তায় ভরিয়ে তুলেছিল আর তার সাথে বিশ্বাসভঙ্গের যন্ত্রণা হৃদয়ে যে অনিঃশেষ ক্ষরণের জন্ম দিয়েছিল তা নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছিলেন মান্টো । তাই এত নিঁখুত আর জীবন্ত তাঁর বয়ান । সঙ্গে অবশ্যই বড় গল্পকারের মুন্সিয়ানা শতধারায় দীপ্যমান । মান্টোর প্রকাশভঙ্গির স্বাতন্ত্র্য তাঁর গল্পকে বিশিষ্টতা দান করেছে । দাঙ্গার সময়ের ঘটনা এবং ব্যক্তির মনস্তত্ত্বের চুলচেরা বিশ্লেষণে অনন্য সাদত হাসান মান্টোর ‘কালো সীমানা’ গল্পগ্রন্থটি ।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top