৩৭ নাম্বার জেনিং স্ট্রিটের বাড়িতে (পর্ব- এক) // লুনা রাহনুমা

এক

সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ চলছে। ব্রিটিশ আবহাওয়ার নিয়ম অনুযায়ী বাইরে এখনো হালকা গরম থাকার কথা। কিন্তু একটানা পাঁচদিন গুড়িগুড়ি বৃষ্টি আর যখন তখন দমকা বাতাসে গাছপালা নাড়িয়ে দিয়ে এক্কেবারে ঠান্ডা নামিয়ে ফেলেছে যেন। পাতলা একটা গরম কাপড় গায়ে না চাপালে ঘর থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। চকলেট কালারের ফ্লিসের কোটটি আলমারি থেকে বের করে চেয়ারের উপর রাখে মারিয়া। জন কাজ থেকে ফিরলে বের হবে তারা দুজন।

টিভির সামনে রাখা কালো রঙের টু-সিটার সোফাতে গিয়ে বসলো ও। হাতে কফির মগ। কলিগের কাছে বুলেট কফি বানানো শিখেছে কিছুদিন আগে। দুই চামচ নারিকেল তেল, দুই চামচ কফি গুঁড়ো, দুই চামচ বাটার আর এক মগ গরম পানি ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করে নিলেই তৈরি হয়ে যায় বুলেট কফি। বানানো সহজ হলেও কফিটি খেতে হয় দ্রুত। খুব জলদি ঠান্ডা হয়ে তেল জমে যায় মগে। কিছুক্ষণ আগে শখ করে বানানো কফির অর্ধেক এখনো পড়ে আছে মগেই। এমন সময় মারিয়ার মোবাইলে রিং বেজে উঠলো।

– হ্যালো।
: তুমি বাড়ি ফিরেছো নাকি?
– আমি বাড়িতেই আছি। আজ আর কাজে যাইনি। আমার একজন কলিগের সাথে সোয়াপ করেছি আজকের কাজ। তুমি আসছো তো পাঁচটার মধ্যে!
: যাবে বাড়ি দেখতে? নাকি ক্যানসেল করে দিবো! পছন্দ হয় কিনা তার ঠিক নেই। শুধু শুধু এই ঠান্ডার মধ্যে কষ্ট করা।
– না। যাবো। আমি কনফার্ম করে রেখেছি। দেরি করো না। তৈরি হয়ে বসে আছি।

আজ বিকেল ছয়টায় বাড়ি দেখতে যাবার এপয়েন্টমেন্ট করা আছে স্টেট এজেন্টের সাথে। চার্লস হার্ডিং এর একটি বাড়ি মার্কেটে এসেছে দুদিন আগে। তিন বেডরুমের মিড টেরাস হাউস। অনলাইনে বাড়ির ম্যাপ আর গ্রাফ দেখে বাসাটি খুব পছন্দ হয়েছে মারিয়ার। উপর তলায় ভালো সাইজের দুটি বেডরুম। তৃতীয় বেডরুমটি একটু ছোট। ওটাকে স্টাডি রুম বানানো যাবে। নিচতলায় ড্রয়িংরুম, আলাদা ডাইনিং, রান্নাঘরের ভেতর দিয়ে গেলে টয়লেট আর শাওয়ার রুম একসাথে। সিঁড়ির নিচটা দরজা লাগিয়ে সুন্দর একটি কাপবোর্ড বানানো হয়েছে। অনেক জিনিসপত্র রাখা যাবে ওখানে। এজেন্সির ম্যাপ অনুযায়ী, উপরতলায় মাস্টার বেডরুমের সাথে একটি আনসুইট আছে। এদেশে যত বড় বাড়িই হউক না কেন একটির বেশি বাথরুম পাওয়া খুব কঠিন। তাই দুটো বাথরুমের কারণে এই বাড়িটির প্রতি মারিয়ার আগ্রহটা খুব বেশি হচ্ছে। মারিয়া নিজে এজেন্সিকে ফোন করে এপয়েন্টমেন্ট বুক করেছে। এক বছরের উপরে হলো তারা বাড়ি খুঁজছে। বাজেটের ভেতর পছন্দ মতো বাড়ি মার্কেটে আসতেই হুট্ করে বিক্রি হয়ে যায়। ওরা এখন প্রতি মাসে যত টাকা বাড়ি ভাড়া দিয়ে যাচ্ছে, মর্টগেজ নিলে তার থেকে কমে মান্থলি রিপেইমেন্ট হতো। আবার বিশ বাইশ বছরের মধ্যে বাড়িও নিজের হয়ে যেত।

কফির মগটি নিয়ে মারিয়া উঠে দাঁড়ায়। ঠান্ডা হয়ে গেছে। মাইক্রোওয়েভে গরম করতে হবে। ঠান্ডা চা, কফি ওর পছন্দ না। রান্নাঘরের ছোট জানালাটি বন্ধ করে দিলো একহাতে। আবার ঝরতে আরম্ভ করেছে বাইরে। ঝিরঝির বৃষ্টির ছাঁট ভিজিয়ে দিয়েছে জানালার পর্দার কোণ। এই দেশে সামার বলে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। সারা বছরই শীতকাল। অল্প শীত। মাঝারি শীত। কনকনে শীত। না হয় অসহ্য শীত।

ছয়টা বাজার আগেই ওরা ঠিকানা অনুযায়ী `ফর সেল` বাড়িটির সামনে এসে দাঁড়িয়ে রইলো। ৩৭ নাম্বার জেনিং স্ট্রিট। এজেন্সির ছেলেটি ওরা পৌঁছানোর আগেই পৌঁছে গিয়েছে সেখানে। ছয়টা বাজতে এখনো দশ মিনিট বাকি, তাই ছেলেটি গাড়িতে বসে আছে। মারিয়া ও জন বাড়ির সামনে পিছনে ঘুরে ঘুরে দেখলো। এই লাইনের বাড়িগুলো বেশ লম্বা এরিয়া নিয়ে তৈরি। বাড়ির পেছনে গাড়ি রাখার জায়গা আছে সবার। রেসিডেন্সিয়াল এলাকা, তাই বাড়ির সামনে রাস্তায় ফ্রি পার্কিং। মারিয়া অবশ্য পার্কিং নিয়ে মাথা ঘামায় না। কারণ ওরা এখনো গাড়ি কেনেনি। বাড়িটা কেনা হয়ে গেলেই জন ড্রাইভিং লেসন নিতে শুরু করবে। আপাতত গাড়ির চেয়ে বাড়িটা বেশি জরুরি। দুজনেরই খুব ইচ্ছে, ওদের সন্তানটি জন্মানোর আগেই তারা নিজেদের বাড়িতে উঠবে। মারিয়া এখন তিন মাসের প্রেগন্যান্ট।

চাবি দিয়ে দরজা খুলে বাড়ির ভেতরটি ঘুরিয়ে দেখানো সময় এজেন্সির ছেলেটি জানায় যে আগের মালিক বেশ কয়েক মাস ধরে বাড়ির মাসিক কিস্তি(মর্টগেজ) সময়মতো দিতে পারছিলো না। ব্যাঙ্ক অব ইংল্যান্ডের নিয়ম অনুযায়ী গ্রাহক পর পর তিন মাস বাড়ির মর্টগেজ দিতে ব্যর্থ হলে ঋণদানকারী ব্যাংক তাদেরকে কোর্ট নোটিশ পাঠায়। তারপর আরো তিন মাস অপেক্ষা করে ব্যাংক বাড়িটিকে নিজের দায়িত্বে মার্কেটে বিক্রি করে দেয়। পুরোনো বাড়ির মালিকদের হয়তো তেমনই কিছু হয়েছিল। ব্যাংক জব্দ করে নিয়েছে তাদের কাছ থেকে এই বাড়ি। এখন এটিকে বিক্রি করে ব্যাংক কাস্টমারকে দেয়া লোনের টাকা তুলবে।

ঘর ভর্তি হয়ে পড়ে রয়েছে আগের বাড়িওয়ালার ব্যবহার্য জিনিসপত্র। খাট, সোফা, টিভি, ফ্রিজ থেকে শুরু করে থালা, বাটি, চামচ এমনকি ঘড়ি, জামা, জুতা, ব্যাগ সব কিছু ছড়ানো ছিটানো রয়েছে পুরো বাড়িতে। এর আগে ওরা যতগুলো বাড়ি দেখতে গিয়েছিলো সবগুলো বাড়ি ছিল ফাঁকা। ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে রাখা। এই বাড়িটিকে দেখে মনে হচ্ছে, বাড়ির মালকিন যেন একটু আগে শাওয়ার করছিলো। বাথরুমে ভেজা তোয়ালে রেখে মোড়ের দোকানে সিগারেট কিনতে গিয়েছে এইমাত্র।

বাড়ির ভেতরটাতে দেয়ালে আর মেঝেতে একটা আভিজাত্যের ছোঁয়া আছে। মেঝেতে প্রায় ২৪ বাই ২৪ ইঞ্চির বড় টাইলস বসানো। ড্রয়িং আর ডাইনিংয়ের মাঝে ভারী কাঁচের স্লাইডিং ডোর। রান্নাঘরের ফিটিংসগুলো দেখে মনে হচ্ছে কয়েক মাস আগে নতুন লাগানো হয়েছিল। মাস্টার বেডরুমের এটাচড নীল শাওয়ার রুমটি দারুণ রোমান্টিক লাগলো মারিয়ার চোখে। এলাকাটি খুব শান্ত। নিরিবিলি। প্রতিবেশীরাও সজ্জন হবে বলেই মনে হচ্ছে।

সবকিছু বিবেচনা করে জন আর মারিয়া দুজনেরই বাড়িটি ভীষণ পছন্দ হয়েছে। মার্কেট প্রাইস থেকে আস্কিং প্রাইস কম। কারণটা ঠিক পরিষ্কার না হলেও ওরা সেটা নিয়ে বেশি ভাবতে রাজি না এই মুহূর্তে। এতো চমৎকার সম্পূর্ণ তৈরি একটি বাসা। আপাতত যত জলদি বাড়িটির চাবি পেয়ে যায়, ওরা ততই খুশি। এজেন্সি জানালো, বিক্রির প্রসেস শুরু থেকে বাড়ির চাবি পেতে প্রায় দশ থেকে বারো সপ্তাহ লেগে যাবে। কখনো কখনো আরো দু`তিন সপ্তাহ সময় বেশি লাগতে পারে যদি বাড়ির ল্যান্ড রেজিস্ট্রি বা বাড়ির প্লানিং পার্মিশনের কোন রিপোর্ট আসতে দেরি হয়। নিজেদের ভেতর হিসেবে করে দেখলো, মারিয়ার পেটের বাচ্চাটির জন্ম হবার আগেই ওরা নিজের বাড়িতে উঠে যেতে পারবে।

এরপরের তিনটি মাস, বাড়ির ক্রেতা ও বিক্রেতার দুই সলিসিটর বিক্রির সব কাজ করতে থাকে। মারিয়া ও জন নিজেদের কাজে কর্মে আগের মতোই ব্যস্ত থাকে। মারিয়ার শরীরে গর্ভধারণের ছাপ ফুটে উঠেছে এতদিনে । হাসপাতালে ওর দ্বিতীয় স্ক্যান হয়েছে। স্ক্যান দেখে মিড ওয়াইফ বলেছে ছেলে হবে। বাচ্চা ও মা দুজনের সবকিছু স্বাভাবিক আছে। প্রতিদিন অল্প অল্প করে মারিয়া ওদের ভাড়া বাড়ির সব জিনিসপত্র গুছিয়ে প্যাকিং করে রেখেছে। জেনিং স্ট্রিটের এই বাড়িটিতে যেহেতু আগের বাড়িওয়ালার আসবাবপত্র সবই আছে তাই নতুন করে ফার্নিচার কেনার ঝামেলা করতে হবে না। ঝামেলা ও খরচ দুটোই বেঁচে যাবে। খুব লাকি মনে হয় নিজেদেরকে ওদের।

তেরো সপ্তাহ পর সব অপেক্ষার অবসান ঘটে। বাড়ির চাবি হাতে পায় ওরা। আনন্দে আপ্লুত হলেও বাড়ি বদলের ঝক্কিতে দুজনেই খুব কাবু হয়ে গেছে। নতুন বাড়িতে প্রথম দুটি রাত মারিয়া ও জন মাস্টার বেডরুমে ঘুমালো। টায়ার্ড থাকার কারণে অন্য রুমগুলোতে এলোমেলো হয়ে থাকা জিনিসপত্রগুলো পরিষ্কারে হাত লাগাতে পারেনি একদম।

তৃতীয়দিন সকালে, দুজনই তারা সেদিন বাড়িতে। জনের কাজ বিকেলে। মারিয়ার কাজ নেই, ডে অফ। সকালে চা খেয়ে জন প্রস্তাব করে, চলো আজ সেকেন্ড বেডরুমটি ক্লিয়ার করে ফেলি আমরা।

মারিয়াও সম্মত হলো। ভালো চিন্তা।

সেকেন্ড বেডরুমে একটি ডাবল খাট, খাটের উপর সুন্দর পরিপাটি চাদর আর লেপ বিছানো আছে। লেপের কভারের সাথে ম্যাচিং করা বালিশ ও বেশ অনেকগুলো কুশন রাখা। খাটের পাশে সাইড টেবিলে ল্যাম্প রাখা। একটা ফটোফ্রেম আছে টেবিলের উপর। কিন্তু কারো ছবি নেই সেখানে। দেয়ালের সাথে লাগানো বড় দুইটি আলমারি। জন সাবধানে আলমারির দরজা খুললো। ভেতরে সব ছেলেদের কাপড়। শার্ট, টাই, ব্লেজার, নতুন ব্র্যান্ডেড টি-শার্ট, বারো তেরো জোড়া জুতো।

– একটা বিন ব্যাগ দাও তো। এগুলো সব বিন ব্যাগে ভরে ফেলি। চ্যারিটি শপে ফোন দিতে হবে আবার। এতো জিনিস ফেলতেও অনেক খরচা আছে।

মারিয়া বিন ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বিছানার উপরে বসে।

জন চিৎকার করে উঠলো, বসো না, বসো না এখনই। ময়লা খাট। কতদিন তালা বন্ধ ছিল এই বাড়ি কে জানে? এই বাড়ির সবকিছু চেঞ্জ করতে হবে। ভালো করে ডেটল দিয়ে মুছে তারপর ব্যবহার করতে হবে।

: তুমি তাহলে আলমারির জিনিসগুলো ব্যাগে ঢুকাও। আমি বিছানাটা খালি করি।

খাটের উপর টান টান করে বিছিয়ে রাখা লেপটা টেনে নামাতেই মারিয়ার চোখ স্থির হয়ে গেলো। খাটের ঠিক মাঝখানে অনেকখানি জায়গার চাদরে আর দুই বালিশের কোনায় বিদঘুটে লাল দাগ।

: জন, দেখো।
– কী?

মাথা ঘুরিয়ে খাটের দিকে তাকিয়ে জন হা হয়ে যায়। মারিয়ার পাশে এসে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। দুজনেরই চোখ খাটের চাদরের উপর। দুজনেরই বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠেছে ভীষণ।

: এগুলো কিসের দাগ? রক্ত?

জন মারিয়ার কথার কোন উত্তর দেয় না সাথে সাথে। আরেকটা বিন ব্যাগ হাতে করে আগায় খাটের দিকে।

-আমি তুলছি চাদরটা। তুমি চেয়ারে বসো।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top