৩৭ নাম্বার জেনিং স্ট্রিটের বাড়িতে (পর্ব-দুই) // লুনা রাহনুমা

দুই

জন বিছানার চাদরটি তুলে দেখলো, চাদরের নিচে ফিটেড শিটেও একই অবস্থা। বেডশিটের নিচে সাত ইঞ্চি পুরো ক্রিম কালারের মেমোরি ফোমের মেট্ট্রেসের উপরে দাগটি আরো প্রকট হয়ে ফুটে রয়েছে। লাল, ফ্যাকাশে লাল আর কালচে লাল এখানে সেখানে। জন দুই হাতে মেট্ট্রেসটি তুলে খাট থেকে নামায়। মেট্ট্রেসের উল্টো দিকেও লাল দাগ রয়েছে। জনের কপালে ভাঁজ পড়ে। এটা যদি রক্তের দাগ হয় তাহলে তো অনেক রক্ত পড়েছে এখানে। এতো মোটা মেট্ট্রেসটি চুষে নিচ পর্যন্ত চলে এসেছে!

: এতো দাগ আসলো কিভাবে এই মেট্ট্রেসে?

– কী জানি! বাদ দাও। এই মেট্ট্রেসটা ফেলে দিতে হবে। একটা নতুন কিনে নিলে হবে। আপাতত এই খাটটি খালিই থাকুক। স্বাভাবিক স্বরে কথা বলতে চেষ্টা করে জন।

: ঠিক আছে। মারিয়া সম্মতি জানায় ক্ষীণ স্বরে।

রুমের অন্য জিনিসপত্র গোছানো শুরু করে মারিয়া। ঘরের কোণে একটি ছোট বিন আছে। সেটাকে বড় বিন ব্যাগে নিয়ে উপুড় করে ভেতরের কাটাকাটি কাগজপত্রগুলো ফেলে দিলো। ছোট বিনটি সুন্দর। ব্যবহার করা যাবে, ভাবে মারিয়া। ঘন্টাখানেক পর রুমটি মোটামোটি খালি করে ফেলেছে ওরা। স্প্রে আর কাপড় দিয়ে জানালা দরজাগুলো মুছে দিয়েছে। খাটের পাশের দেয়ালে মেঝের উপর একটি বড় ছবির ফ্রেম লম্বা করে রাখা। কোনো ইংলিশ গায়ক হবে। এই ছবিটি দেখে বোঝা যাচ্ছে, আগের বাড়িওয়ালার গানের শখ ছিল। বাড়িতে প্রচুর গানের সিডি ও ক্যাসেট পেয়েছে ওরা।

মারিয়া ইংলিশ গায়কের ছবিটিতে হাত রাখতেই কাত হয়ে পরে গেল বড় ছবির ফ্রেমটা। ওটা দেয়ালের সাথে লাগানো ছিল না। এমনিতেই পাশে রাখা ছিল। ছবির নিচে মেগনোলিয়া রঙের দেয়ালে অনেকখানি লালচে দাগ। বুঝতে পারে সেখানে একটি হাতের ছাপ। আর মারিয়ার মতো যে কেউই বুঝতে পারবে যে, এই লাল দাগটি আসলে রক্তের দাগ। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের রক্তমাখা একটি হাতের ছাপ রয়েছে এই দেয়ালে। হাতের দাগ বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়েছে হালকা রক্তের ধারা। এখন সেই ধারাটি শুকনো। পুরোনো। কালচে হয়ে গিয়েছে। কিন্তু রক্ত লেগে আছে। খাটের পাশে কাঠের ফ্রেমে। খাটের পাশে দেয়ালে। খাটের পাশের মেঝেতেও জমে শুকিয়ে আছে কারো শরীরের রক্ত।

জন ও মারিয়া দুজনেই হালকা আন্দাজ করতে পারছে এখন, বাড়িটি কেন মার্কেট রেটের চেয়ে কম দামে বিক্রি করে দিয়েছে ব্যাংক। কোনো বাড়িতে খুন হলে সেই বাড়ি কেউ কিনতে চায় না। মানুষ সে ঘরে বাস করতে ভয় পায়। আর এজেন্সির লোকেরাও এই রুমের খাটটি লেপ বিছিয়ে সুন্দর করে ঢেকে রেখেছিল, যাতে বাড়ি দেখতে এসে ক্রেতার চোখে কিছুই ধরা না পড়ে। দেয়ালের হাতের ছাপটিও বুদ্ধি করে ইংলিশ গায়কের ছবি দিয়ে ঢাকা দিয়ে রেখেছিল।

মারিয়ার মুখে আতঙ্কের ছায়া ফুটে উঠলো। মাথাটা ঝিমিয়ে উঠে একটুখানি। প্রেগন্যান্সির এই সময়টাতে মারিয়ার মনে ভয় ঢুকে গেলে বাচ্চার সমস্যা হতে পারে। তাই জন মারিয়াকে তার এক বান্ধবীর বাড়িতে রেখে আসে কয়েক ঘন্টার জন্য। তারপর সে খাটের রক্তমাখা মেটট্রেসটি বাড়ির পিছনের গ্যারেজে নিয়ে রেখে আসলো। দেয়ালের লাল দাগগুলো ঘষে তুলে কয়েক পরত রঙের প্রলেপ দিয়ে দেয়ালটিকে নতুনের মতো চকচকে করে ফেললো। মারিয়াকে এখন আরো কয়েকটি মাস খুব সাবধানে রাখতে হবে। এমনিতেই এই সময়টা খুব বিপদজনক। তার উপর অতি উৎসাহে নতুন কেনা এই বাড়িটির ভেতর উদ্ভট কি সব দেখবে আরো, কেই বা জানে! ওদের অনাগত সন্তানের জন্য সামান্য চিন্তা হচ্ছে জনের।

বান্ধবীর বাড়ি থেকে রাতে মারিয়া যখন বাসায় ফিরলো, তখন তার মন খুব ভালো। ফুরফুরে মেজাজ। সেদিন জনের মামাতো ভাই টনি ও তার বৌ এসেছে হঠাৎ করে, লন্ডন থেকে। বাড়ি কেনা হয়েছে এই খুশিতে টনি দম্পত্তি আর দেরি করতে পারছিলো না। তারা জনদের সাথে থাকলো পুরো চারটি দিন। ভীষণ হাসি আড্ডায় কেটে গেলো দিন চারটি। অনেক আনন্দ। অনেক হা হা হি হি। ঝলমলে খুশির আমেজে মারিয়ার মন থেকে পাশের ঘরের রক্তের দাগ মুছে গিয়েছে যেন একেবারেই।

টনিরা চলে যাবার পরদিন দুপুরে, মারিয়া বাড়িতে একা। জন গিয়েছে কাজে। নিচতলার বাথরুমে বাথটাব উষ্ণ পানিতে ভরে শাওয়ার জেলের মন মাতানো সুঘ্রাণে চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল মারিয়া বাথটাবে। হঠাৎ করে মনে হলো, একুশ কি বাইশ বছরের একটি মেয়ে ওর পাশেই বাথটাবে শুয়ে আছে। পাশাপাশি ওরা দুজন, কিন্তু মেয়েটির গা স্পর্শ হচ্ছে না মারিয়ার গায়ে। কিছুক্ষণ পর মনে হলো, মেয়েটির খুব শ্বাস কষ্ট শুরু হয়েছে। অক্সিজেনের অভাবে ছটফট করছে মেয়েটির সারা শরীর। বাথটাবের পাশে পাঁচটি ড্রয়ার দেয়া বেতের একটি ছোট্ট চেস্ট। মেয়েটি পাগলের মতো একটি একটি করে সবগুলো ড্রয়ার খুলে কিছু খুঁজছে। কি খুঁজছে? মারিয়ার মনে হলো, মেয়েটা ইনহেলার খুঁজছে। মেয়েটাও তার মতো এজমাটিক!

গরম পানির ধোঁয়ায় ঘোলা হয়ে থাকা বাথরুমে মেয়েটির মুখ পরিষ্কার বোঝা যায় না। আবছায়া। ধোঁয়াটে। অবয়বে মনে হয়, মেয়েটি বেশ লম্বা। স্বাস্থ্য ভালো। নগ্ন মেয়েটির শরীরের দিকে তাকিয়ে মারিয়ার পিঠ দিয়ে ভীষণ ঠান্ডা একটি স্রোত বয়ে গেল। মেয়েটি প্রেগন্যান্ট। ছয় সাত মাসের প্রেগন্যান্ট মেয়ের পেটের মতো লাগছে। মারিয়া সেন্সলেস হবার আগ মুহূর্তে, মনে আছে, কোনরকমে বাথটাব থেকে নিজেকে সে বাথরুমের মেঝেতে ফেলতে পেরেছিল। তারপর যখন জ্ঞান ফিরে আসে, জন ওকে ড্রয়িংরুমের সোফাতে মোটা কম্বল পেঁচিয়ে শুইয়ে রেখেছে। কম্বলের উষ্ণতায় আবার চোখ বুজে আসে মারিয়ার। মনে ভয় লাগে, বাস্তব আর অবাস্তব এই দুই জগৎ কি গুলিয়ে যাচ্ছে তার ভেতর!

এই ঘটনার পর থেকে, মারিয়াকে নিয়ে সত্যি খুব চিন্তায় পড়লো জন। মারিয়া নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না কি ঘটছে ওর চারপাশে। জন বাড়িতে থাকলে সবকিছুই স্বাভাবিক। একা থাকলেও ঠিক আছে। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ কেউ যেন কিছু দেখাতে চাইছে ওকে। বাথরুমে যার ছায়া দেখেছে সেদিন, সে কে? এতো জীবন্ত! এই কি আগের বাড়িওয়ালাটির বৌ? বান্ধবী? সেও কি প্রেগন্যান্ট ছিল? কি ঘটেছিল মেয়েটির সাথে?

মারিয়ার অনুরোধে জন আগের বাড়িওয়ালার খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করে। এলাকার কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে কোনো তথ্য পেল না। বাড়ি কিনেছিল যে এস্টেট এজেন্সির কাছ থেকে, তাদেরকেও ফোন করে কিছু লাভ হলো না। এই দেশে বাড়ি বিক্রির এজেন্সির লোকেরা খুব প্রফেশনাল। অনুমতি ছাড়া কারো নাম, ঠিকানা বা কোনো তথ্য তাদের কাছে থেকে বের করা যায় না। পার্সোনাল ডাটা ইনফরমেশন এক্ট মানে কঠোর ভাবে। মারিয়া সমস্ত ব্যাপারটিকে নিজের মাথা থেকে তাড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে আপ্রাণ। নিজের কাজ আর কয়েকমাস পর জন্ম নেবে যে বাচ্চাটি, তার জন্য ঘর সাজাতে ব্যস্ত হবার চেষ্টা করে।

এভাবে একদিন একদিন করে নতুন বাড়িতে ওদের প্রথম দুটি মাস কেটে গেলো দেখতে দেখতে। বাড়ির ভেতরে বাইরে মোটামোটি সবকিছু সাজিয়ে ফেলেছে ওরা নিজেদের পছন্দ মতো। বাগানের কোণায় একটি বড় স্টোরেজ রুম আছে। তালা বন্ধ করা ছিল রুমটি। জন চাবি খুঁজে না পেয়ে হাতুড়ি দিয়ে তালা ভেঙে ফেললো। ভেতরে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা অনেক জিনিসপত্র। একপাশে চিকন কাঠের টেবিল বানানো। যন্ত্রপাতি দেখে মনে হচ্ছে এখানে যে আগে থাকতো সে কাঠের কাজ করতো। কাঠ কাটার ইলেক্ট্রিক মেশিন আছে। বাগানের চেয়ার টেবিল, ছাতা, গাছ পরিচর্যার সরঞ্জামাদি, কোণায় একটি কার্পেট পেঁচিয়ে লম্বা করে রাখা। টেবিলের নিচে জিনিসপত্রে ঠাসা কয়েকটি কালো বিন ব্যাগ। মারিয়া একটি ব্যাগ খুললো। ভেতরে কিছু পাতিল, থালাবাটি, রান্নাঘরের জিনিসপত্র। আরেকটি ব্যাগ খুললো। সেখানে বাগানের টুকিটাকি ডেকোরেশন আইটেম। আরেকটি ব্যাগে খ্রিস্টমাসের ডেকোরেশনের জিনিসপত্র রাখা। আগের বাড়িওয়ালা সৌখিন ছিলেন। নানারকমের জিনিসপত্র দিয়ে বাড়ি ভর্তি হয়ে আছে। অথচ সব কিছুই ফেলে চলে গেলো! কেন, কে জানে?

১ম পর্ব: ৩৭ নাম্বার জেনিং স্ট্রিটের বাড়িতে (পর্ব- এক) // লুনা রাহনুমা

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top