৩৭ নাম্বার জেনিং স্ট্রিটের বাড়িতে (শেষ পর্ব) // লুনা রাহনুমা

তিন

এক সন্ধ্যায়, জন স্টাডি রুমের দেয়াল থেকে ওয়াল পেপার টেনে তুলছিল। স্টাডি রুমে নতুন ওয়ালপেপার লাগানো হবে। মারিয়া মাস্টার বেডরুমের বক্স খাটের নিচের ড্রয়ারটি টেনে বের করলো সাবধানে। ওর এখন আট মাস চলছে প্রেগন্যান্সির। উঠাবসা করতে হয় খুব সাবধানে। খাটের নিচের ড্রয়ারে একটি ছোট্ট কাগজের সুটকেসের মত বাক্স পেল। বাক্সটির উপরে হালকা বেগুনি আর নীল রঙের ছাপানো ফুলের প্রিন্ট। বাক্সের ভেতর ০-৩ সাইজের নিউ-বর্ন বাচ্চার একসেট কাপড়। কাপড়ের সাথে ট্যাগ লাগানো আছে তখনো। টমি টিপির ছোট্ট একটি ফিডার। দুটি চুষনি। নীল হাতির ছবি আঁকা চুষনির গায়ে। ছেলে বাচ্চাদের জন্য কেনা হয় এই রঙের চুষনি। আর একটি ঝুনঝুনির মতো খেলনা। ঝুনঝুনিটি বেগুনি আর হলুদ রঙের স্ট্রাইপ্ড। মারিয়া ওটাকে নিজের হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে শব্দ শুনলো। তেমন জোরালো শব্দ না। খুব হালকা একটা শব্দ হয় ঝুনঝুনিতে। মিষ্টি শব্দটি ভালো করে শুনতে মারিয়া ঝুনঝুনিটিকে কানের কাছে নিয়ে বাজালো। ঝুনঝুনির শব্দ ছাপিয়ে মারিয়া শুনতে পেল, ওর কানের পাশে ফিসফিস করে কে যেন বলছে, “Baby, It`s a Boy!”

মারিয়া ভয়ংকর একটা চিৎকার করে ছুড়ে ফেলে দিলো হাতের ঝুনঝুনি। জন দৌড়ে এসে পাশে বসে।

-কী হলো?

:কে যেন কথা বললো!

-আবারো! কেউ কথা বলবে কোত্থেকে। তোমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।

: ফিসফিস করে বললো। পরিষ্কার শুনলাম। It`s a Boy।

জন জড়িয়ে ধরে মারিয়াকে। নিজের বুকের উপর মারিয়ার মাথাটি রেখে চুলে হাত বুলায়। এই বাড়ির ভেতরটা ইদানীং খুব ভুতুড়ে লাগে তার নিজের কাছেও।

-কেউ কিছু বলেনি। তোমার মনের চিন্তা এসব। তুমি আর আমি ছাড়া এই বাড়িতে আর কেউ নেই।

মারিয়া কথা বলে না। ওর কানে লেগে আছে কণ্ঠস্বরটি। ভীষণ আদুরে মেয়ে কণ্ঠ। মনে হলো, কোন মেয়ে ওর বরের কানে কানে বলছিল কথাগুলো।

মারিয়ার হাত থেকে কাগজের সুটকেসটি নিয়ে আবার খাটের নিচের ড্রয়ারে রেখে দিল জন। এবার সত্যি খুব চিন্তা হচ্ছে। আসলে চিন্তা নয়, দুশ্চিন্তা। মারিয়া এতো বাস্তববাদী মেয়ে, হঠাৎ করে কি শুরু হলো? নিশ্চয়ই প্রেগন্যান্সির উপসর্গ। ডেলিভারির দিন এগিয়ে আসছে, তার জন্য একটা প্রচণ্ড টেনশন আছে এমনিতেই। কিন্তু, এই বাড়িতে খুব খারাপ কিছু ঘটেছিল ওরা আসার আগে, তার প্রমাণ জন নিজেও দেখেছে সেকেন্ড রুমটি ক্লিয়ার আউট করার সময়। তবে এখন ওসব ভেবে ভয় পেলে চলবে না। তাই মারিয়াকে জোর করে নিচে রান্নাঘরে নিয়ে গেল। বললো, চলো আজ একটু জলদি খেয়ে নেই। রাতে একটা মুভি দেখবো দুজন। তারপর একটা লম্বা ঘুম। তুমি একদম ফ্রেশ ফিল করবে কাল সকালে।

পরের দুটি দিন আবার সব ঠিক থাকে। মারিয়ার মেটারনিটি লিভ আরম্ভ হবে আর চার সপ্তাহ পর। শেষের এই সময়গুলো খুব বোরিং। কিন্তু মারিয়া ভীষণ এনজয় করছে। ওরা এখনো বাচ্চার নাম ঠিক করতে পারেনি। পরিচিত সবাইকে নাম দিতে বলেছে। কোনটাই পছন্দ হচ্ছে না। দুপুরে খাবারের পর একলা বাড়িতে বসে ঝিমাচ্ছিল মারিয়া। তাই ল্যাপটপ অন করে গুগলে ছেলে বাচ্চাদের নাম দেখতে লাগলো খুব মন দিয়ে। কয়েকটি নাম ভালোও লেগে গেল। একটি খাতায় কয়েকটি পছন্দের নাম অর্থসহ লিখে রাখছিল। জন ফিরলে দেখাবে রাতে। হঠাৎ করে, মারিয়ার মনে হলো, জানালার পাশে ল্যাপটপের উপর ছায়া দেখা যাচ্ছে কারো। বাইরে মেঘলা আকাশে বিদ্যুৎচমকের খেলা মনে করে কিছুক্ষণ পাত্তা দিল না। কিন্তু অল্পক্ষণের ভেতর বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেল যেন। ধক করে উঠলো অন্তরাত্মা। মারিয়ার ঠিক পেছনেই যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে কেউ। কারো প্রবল উপস্থিতি অনুভব করতে পারছে সে। কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নেবার পর মারিয়া সিদ্ধান্ত নিলো, কথা বলবে সে অশরীরীর সাথে।

ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রেখে বললো, তুমি কে? তুমি কি আমার কথা শুনতে পাও?

কয়েক মিনিট চুপচাপ। কেউ কথা বলে না। কিছুক্ষণ পর ল্যাপটপের আয়নায় ছায়াটি সামান্য নড়ে উঠে।

মারিয়া আবার বলে, তুমি কি আমার সাথে কথা বলতে চাও?

মনে হলো ছায়াটি মাথা নাড়লো। মারিয়ার মনের ভুলও হতে পারে। মারিয়া খুব নরম সুরে বললো, আমি জানি তুমি আমাকে কিছু বলতে চাও। আমি শুনবো। তুমি বলতে পারো।

কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা। কোন শব্দ হয় না। আরো পরে যেন বহু দূরের কোন জগৎ থেকে হালকা স্বরে কথা বলে উঠলো কেউ। মেয়েদের গলার স্বরের মতো কোমল স্বর। বললো, তোমাকে কিছু বলতে চাই।

মারিয়া বলে, বলো। আমি শুনতে পারছি তোমাকে।

– এটা আমাদের বাড়ি ছিলো। তোমরা কেনার আগে আমরা কিনেছিলাম বাড়িটি। তোমার মতো আমাদেরও প্রথম বাড়ি ছিল এটা। খুব শখের বাড়ি। অনেক যত্ন করে সাজিয়েছিলাম আমি এই বাড়ির প্রতিটি কোণ।

একটানা কথা বলে থেমে যায় মেয়েলি কণ্ঠস্বরটি। কয়েক সেকেন্ড কোন কথা শোনা যায় না আর।

: তুমি এখন কোথায় থাকো?

প্রশ্নটি করে মারিয়া চুপ করে যায়। কারণ এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো সে জানে।

– আমি কোথাও নেই। আবার আমি সবখানেই আছি। আমার এই জগতে দিন-রাত্রি, আলো-অন্ধকার, সুখ-দুঃখের অনুভূতি সব একই মাত্রায় অনুভূত হয়। অনন্তকালের সাথে মিশে গেছে আমার আত্মা।

কথাগুলো শেষ হতেই কেমন বুক কাঁপানো তীক্ষ্ণ হাসির শব্দ শুনতে পায় মারিয়া। খটকা লাগে, সব অনুভূতি যদি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় তাহলে এই মেয়ে কণ্ঠটির তো হেসে উঠবার কথা না।

: তোমার নাম কী? মারিয়া প্রশ্ন করে।

– সিলভিয়া। মানে, আমি যতদিন বেঁচে ছিলাম ততদিন এই নামে পরিচিত ছিলাম। এখন আমার কোন নামের প্রয়োজন হয় না।

: সেদিন কি হয়েছিল সিলভিয়া? বিছানায় অনেক রক্ত আর দেয়ালে যে হাতের দাগ দেখেছি, সেটা কি তোমার?

– সেই কথা বলতে চাই তোমাকে। তুমি আমাকে সাহায্য না করলে সে কিছুতেই শান্তি পাবে না। আর আমার আত্মাও দিশেহারা হয়ে ছুটে বেড়াবে এই অনন্তের শূন্য বাতাসে!

মন শান্ত করে কান পেতে থাকে মারিয়া। দূর থেকে ভেসে আসা অশরীরী কণ্ঠস্বরটিকে এখন আর ভয় লাগছে না। বরং মনে হচ্ছে, কণ্ঠস্বরটির ভেতর থেকে মিনতি ঝরে পড়ছে। তার সাহায্য প্রয়োজন। মারিয়াকে সে বিশ্বাসভাজন মনে করেছে। হয়তো এছাড়া আর কোনো উপায় নেই তার।

সিলভিয়া বলতে আরম্ভ করে তার বেঁচে থাকার দিনের গল্প। দূরাগত কণ্ঠস্বরে ভেসে আসে প্রতিটি শব্দ, কিছুটা অস্ফুটে। চোখ বন্ধ করে শুনতে থাকে মারিয়া। যেটুকু শুনেছে তাতে মারিয়ার মনে হয় যেন সে সব দেখতে পাচ্ছে চোখের সামনে। মনের পর্দায় চলমান ভিডিও ক্লিপের মতো ভাসছে একেকটা দৃশ্য। আর পেছন থেকে অশরীরী কেউ ধারাভাষ্য দিয়ে যাচ্ছে প্রতিটি ঘটনার, একের পর এক।

চার

সিলভিয়ার বয়স তখন ছাব্বিশ বছর। ওর প্রেমিক জেনোন আর সে মিলে এই বাড়িটি কিনেছিল। ভীষণ ভালোবাসতো ওরা পরস্পরকে। বাড়ির প্রতিটি ইঞ্চিতে কান পাতলে এখনো শোনা যায় জেনোনের ভালোবাসার গান। সিলভিয়াকে কেন্দ্র করেই ঘুরতো জেনোনের প্রাত্যহিক কর্মযজ্ঞের বৃত্ত।

প্রেমিক জেনোন যেমন খুব ভালোবাসতো তার গার্লফ্রেন্ড সিলভিয়াকে, আবার একই সাথে, মনের ভেতর কাজ করতো প্রেমিকাকে হারানোর ভয়। জেনোন যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারতো না, সিলভিয়া সত্যি তাকে ভালোবাসে। সব গভীর প্রেমেই হয়তো এইরকম ভয় থাকে মানুষের। হারানোর ভয়। একা হয়ে যাবার ভয়।

সিলভিয়া তখন ছয়মাসের প্রেগন্যান্ট। প্রতি সপ্তাহের মতো সেই শুক্রবার রাতেও জেনোন গিয়েছিল বন্ধুদের সাথে পাবে, মদ খেতে। মদ্যপান করাটা ছিল ওর একমাত্র নেশা। রাত এগারোটার সময় জেনোন যখন বাড়ি ফিরে এসেছিল, তখন ওদের রাস্তায় কোন পার্কিং ছিল না। তাই তাকে গাড়ি পার্ক করতে হয়েছিল বেশ কিছুটা দূরে, অন্য রাস্তায়। গাড়ি পার্ক করে হেঁটে বাসার কাছাকাছি আসতেই দেখলো ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে লম্বা মতন একটি ছেলে। হালকা অন্ধকারে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেই জেনোন চিনতে পারলো ছেলেটিকে। রুশদি- সিলভিয়ার এক্স বয়ফ্রেন্ড।

রুশদি রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যাবার পরেও বেশ কিছুক্ষণ রাস্তার পাশের ল্যাম্পপোস্টে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে জেনোন। তারপর সে বাড়িতে ঢোকে। সিলভিয়াকে দেখে মনে হচ্ছিলো সবকিছু প্রতিদিনের মতো স্বাভাবিক আছে। আজ নতুন কিছু হয়নি। বাড়িতে আজ কেউ আসেনি। জেনোন অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে থাকে। সিলভিয়া ওকে রুশদির কথা বলুক। কিন্তু সিলভিয়া রুশদির নামটি পর্যন্ত একবার উচ্চারণ করে না।

আর থাকতে না পেরে জেনোন নিজেই জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা রুশদির সাথে কি তোমার কথা হয়?

সিলভিয়া খুব স্বাভাবিকভাবে বলে, নাহ। ওর সাথে কথা হবে কেন? কোথায় থাকে এখন তাই তো জানি না।

– শেষ করে দেখা হয়েছিল তোমার সাথে?

: অনেকদিন হবে। সেই যে ওর বিয়ের কার্ড দিতে এসেছিল তখন।

অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কথা শেষ করে সিলভিয়া। জেনোনের দিকে তাকায় না।

খুব রাগ হয় জেনোনের। বলে, তুমি কেন মিথ্যে কথা বলছো? রুশদি তো একটু আগেই এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। আমি না থাকলে তোমরা কি প্রায়ই দেখা করো। বাড়িতেই দেখা করতে হয় তোমাদের? কেন?

সিলভিয়া বলে, তুমি এখন ড্রাঙ্ক আছো। তাই ভেবেছিলাম কাল সকালে বলবো তোমাকে। তুমি যা ভাবছো তেমন কিছুই নয়। রুশদি হঠাৎ করে আজ সন্ধ্যায় ফোন করেছিল। বললো অনেকদিন দেখা হয় না। দেখা করতে চায়। তাই আমি ওকে আসতে বলেছিলাম। আজ যে তুমি ফিরতে এতো দেরি করবে তা তো জানতাম না।

জেনোন মানতে চায় না। রাগের বশে অনেক চিৎকার করতে থাকলে সিলভিয়া মুখে তালা আঁটে। একটি কথারও উত্তর দেয় না। মাস্টার বেড থেকে নিজের বালিশটি তুলে নিয়ে সেকেন্ড বেডরুমের খাটে গিয়ে শুয়ে পড়ে।

এতে জেনোনের রাগ যেন আরো বেড়ে যায়। ভীষণ বাজে সব চিন্তা মাথায় খেলতে থাকে। সিলভিয়ার পাশে গিয়ে চিৎকার করে গালাগাল দিতে থাকে অকথ্য ভাষায়। তবুও নির্বাক থাকে সিলভিয়া। এই নির্লিপ্ততা উন্মাদ করে জেনোনকে। গর্জন করে বলে, আমাদের এই বাচ্চাটি কি আমার? নাকি রুশদির?

সিলভিয়া এবার আর চুপ করে রইলো না। উত্তর দিলো। জেনোনের রাগের আগুনে ঘি ঢেলে বলে, রুশদির।

কথাটি শোনার সাথে সাথে চিন্তাজ্ঞান লোপ পাওয়া মাতাল জেনোন, খাটের পাশে ফলের বাটিতে রাখা ছুরিটি হাতে নিয়ে পরপর বেশ কয়েকটি ঘা মারে সিলভিয়ার পেটে আর বুকে। রক্তাক্ত পেটের উপর থেকে হাত সরিয়ে দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে সিলভিয়া। কিন্তু সে ঢলে পড়ে যায় খাটের উপর।

কয়েক মিনিটের ভেতর নেশা কেটে যায় জেনোনের। বুঝতে পারে মারাত্মক ভুল করে ফেলেছে। সিলভিয়াকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে থাকে। বলে, আমি সরি। এটা আমি কী করে ফেললাম?

সিলভিয়া ওর রক্তমাখা ডান হাতটি দিয়ে জেনোনের গালে আদর করে। বলে, বাচ্চাটা তোমার জেনোন। তোমার আর আমার। আমি যেমন শুধুই তোমার।

দিশেহারা হয়ে জেনোন নিজের হাতে নিজের মাথার চুল খামচে ধরে। এম্বুলেন্স ডাকতে চায়।

সিলভিয়া শান্ত কণ্ঠে বলে, জেনোন তুমি পালাও। এম্বুলেন্স আসলে ওরা তোমাকে পুলিশে দিবে। পুলিশ আসার আগেই পালাও। তুমি জলদি পালিয়ে যাও।

জেনোন সিলভিয়ার মোবাইল থেকে এম্বুলেন্স কল করে নিজের পাসপোর্ট আর একটি ব্যাগ ঘাড়ে করে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। বাড়িতে যখন এম্বুলেন্স এসে পৌঁছায় তখনো বেঁচে ছিল সিলভিয়া। কিন্তু হাসপাতালে নেবার পথেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যায় সে। ওর পেটের সন্তানটিকেও বাঁচাতে পারেনি ডাক্তার।

মারিয়া নিশ্চুপ শুনতে থাকে মেয়েলি কণ্ঠের দূরাগত আওয়াজের গল্প। কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে, টেরই পায়নি। বাইরের রাস্তার রহস্যময় আলো এসে ঘরের ভেতরটাতে অদ্ভুতুড়ে গা জমানো অতিপ্রাকৃতিক এমন একটি গল্প শোনার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরী করেছে।

অশরীরী সিলভিয়াকে এখন আর ভয় লাগছেনা মারিয়ার।

পাঁচ

: সিলভিয়া, জেনোন এখন কোথায়? পুলিশ কি ওকে এরেস্ট করেছে?

– না। জেনোন পালিয়ে আছে।

: এখানেই আছে?

– এই এলাকাতে থাকে না। আড়াইশো মাইল দূরের একটি গ্রামে নিজের নাম ঠিকানা লুকিয়ে অন্য পরিচয়ে আছে। কিন্তু মাসে একবার করে আসে। দূর থেকে তাকিয়ে থাকে এই বাড়িটির দিকে। আর কাঁদে। এই বাড়িতে একটি জিনিস আছে। সেই জিনিসটির জন্য সে ছটফট করে।

: কি জিনিস?

– আমাদের ছেলের জন্য আমরা একটি ছোট বাক্স তৈরি করেছিলাম। সেখানে ওর প্রথম কাপড়, ফিডার, চুষনি এইরকম কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখেছিলাম।

: আমি জানি। সেই বাক্সটি এখনো তেমনি আছে। শোবার ঘরে খাটের সেকেন্ড ড্রয়ারে।

– সেই বাক্সে আমাদের ছেলের প্রথম ও দ্বিতীয় স্ক্যানের ছবি আছে। সাদাকালো কয়েকটি ছবিতে আমাদের প্রথম সন্তানের ছোট্ট হাত, পা, মাথা, গোটা শরীরটা আছে। জেনোন সেই ছবিগুলোর জন্য অপেক্ষা করে। কষ্ট পায়। ছবিগুলো পেলেই সে এই দেশ থেকে অন্য দেশে চলে যাবে। তাহলে ওকে আর পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হবে না।

: তাহলে কি তোমার আত্মার মুক্তি লাভ হবে ঐ জগতে? তুমি কি আর ফিরে আসবে না এই বাড়িতে?

– জেনোনকে আনন্দ পেতে দেখলে আমি খুব শান্তি পাবো। তাতেই আমার আনন্দ। ভুল তো সব মানুষই করে, তাই না! আসলে ও আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতো। আমার চারপাশে কাউকেই সহ্য করতে পারতো না।

: তোমার বাচ্চাটির জন্য এখনো কষ্ট পাও?

– নাহ। বাচ্চার চেয়ে বেশি মনে পড়ে প্রেমিকের কথা। কিন্তু তেমন কোন অনুভূতি হয় না আমার। এখানে আসলে কারোরই তেমন অনুভব অনুভূতি কাজ করে না। শুধু দূরের হাতছানির মতো হঠাৎ হঠাৎ প্রবল ঢেউ তুলে যায় বুকে, আগের জীবনে চেনা খুব প্রিয় কয়েকজন মানুষ।

: তুমি কি এখনো মানুষ আছ?

– আমি জানি না। মানুষ হয়ে কেমন ছিলাম, তাও মনে পড়ে না।

: জেনোনের কাছে ফিরে আসতে ইচ্ছে করে না?

– না। আমি এখনো জেনোনের কাছে স্মৃতি হয়ে আছি। আমার কাছে কারো স্মৃতি নেই। আমি সম্পূর্ণ একা এক আত্মা এখানে।

: তোমার সাথে আরো যারা আছে ওখানে, তাদের সাথে কথা বলো না তুমি? তোমাদের সখ্যতা হয় না?

– না। সবাই এখানে একা। কিন্তু কেউই একাকী বোধ করে না। এখানে সবাই একা এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ। পৃথিবীতে যেটা সম্ভব হয় না মানুষের পক্ষে। পৃথিবীতে মানুষ মানুষের উপর নির্ভরশীল। এখানে কেউ কারো উপর নির্ভর করে না। করার প্রয়োজন হয় না।

মারিয়া অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। সিলভিয়াও চুপ করে থাকে মারিয়ার প্রশ্ন না পেয়ে। নীরবতা ভেঙে মারিয়া বলে, আমি কথা দিচ্ছি, জেনোনকে আমি ওই বাক্সটি পৌঁছে দিবো। আমাকে একটু সময় দাও। আমি চিন্তা করে একটি উপায় বের করবো।

– খুব খুশি হবে তাহলে জেনোন। তোমার সন্তানের জন্য শুভ কামনা রইলো।

: ধন্যবাদ।

– নাম ঠিক করেছো ওর জন্য?

: না। কোন নাম পছন্দ হচ্ছে না।

– ওর নাম রাখতে পারো জেনোন। ভালো মনের মানুষ হবে সে।

: এখন বলো জেনোনকে দেখলে আমি চিনবো কিভাবে? মানে ওর বিশেষ কোনো আইডেন্টিটি আছে কি?

– বছর তিনেক আগে মোটরওয়েতে একটি বড় একসিডেন্ট করেছিল। এক্সিডেন্টের সময় ওর বা হাতের কয়েকটি আঙ্গুল থেতলে গিয়েছিল। হাসপাতালে ডাক্তাররা তখন ওর বা হাতের অনামিকা আর কনিষ্ঠাঙ্গুলটি কেটে ফেলে। তোমার যদি কাউকে জেনোনের মতো মনে হয় তার বা হাতের সাথে মিলিয়ে দেখতে পারো।

: আচ্ছা। আমি চেষ্টা করবো। কথা দিচ্ছি তোমাকে।

তারপর থেমে গেলো ওরা দুজনই। বহুক্ষণ আর কোনো কথা নেই কারো মুখে। মারিয়ার মনে হলো সিলভিয়া চলে গিয়েছে। উঠে ঘরের সবগুলো বাতি জ্বাললো। জানালার পর্দা টেনে দিল। জন ফেরার সময় হয়েছে। দুজনের জন্য রাতের খাবার গরম করতে রান্নাঘরের দিকে যায় মারিয়া।

পরের দিন সকাল থেকে যতক্ষণ বাসায় ছিল, মারিয়া দোতলার দুটো জানালা থেকে একটু পর পর উঁকি দিয়ে সবগুলো রাস্তা খেয়াল করে। সিলভিয়ার বর্ণনা অনুযায়ী জেনোনকে খুঁজছে। তিন সপ্তাহ পর এক মঙ্গলবার বিকেলে দেখতে পেলো তাকে। জেনোনের মতো একটা লোককে। ৩৭ নাম্বার জেনিং স্ট্রিটের বাড়ির রাস্তার উল্টো পাশে একটা ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকার ভান করছিলো লোকটা। আর একটু পরপর, আড় চোখে এই বাড়ির দিকে তাকাচ্ছিল। নিজের চেহারা আড়াল করার জন্য দাড়ি-গোঁফ রেখেছে। মাথায় টুপি। মারিয়া আগেই ঠিক করে রেখেছিল, সব বর্ণনা মিলে গেলে জেনোনকে কিভাবে বাড়ির সামনে ডেকে আনবে।

ভারী শরীরে ধীর পায়ে মারিয়া সাবধানে দরজা খুলে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো বাড়ির সামনে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে নেয় একবার। তারপর রাস্তার উল্টোপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বলে, এক্সকিউজ মি প্লিজ!

মাথা তুলে তাকায় লোকটা। সন্দিহান চোখে পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে রাস্তার অন্যপাশ থেকে ধীরে হেঁটে এগিয়ে আসে মারিয়ার কাছে।

– ক্যান আই হেল্প ইউ? মারিয়ার পেটের দিকে চোখ আটকে থাকে লোকটার।

মারিয়া জানে মনে মনে কী ভাবছে এখন লোকটি। বাঁকা চোখের কোণায় মারিয়া লোকটার বা হাতের দিয়ে লক্ষ্য করে। মোবাইল ধরে রাখা হাতের তিনটি আঙ্গুল ভীষণ কাঁপছে। মারিয়া বলে, যদি কিছু মনে না করেন, আমাকে একটু সাহায্য করবেন প্লিজ!

– জি, নিশ্চয়ই। বলুন।

মারিয়া দরোজার পেছন থেকে বের করে আনে ছোট্ট সুটকেসটি। হালকা বেগুনি আর নীল রঙের ছাপানো ফুলের প্রিন্ট করা কাপড়ের সুটকেসটি এগিয়ে দিয়ে বললো, এটি আমার লাগবে না। আপনি যদি এটাকে রাস্তার মাথায় ওই বড় বিনটাতে ফেলে দিতেন কষ্ট করে, তাহলে আমার খুব উপকার হতো। আসলে এই অবস্থায় আমি খুব বেশি ওজন টানতে পারি না তো, তাই আপনার সাহায্য চাইছি।

সুটকেসের দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে লোকটা। রানীর মুকুটের কোহিনুর হীরার দিকেও বোধ হয় মানুষ এমন লোভাতুর চোখে দেখে না। কিছুটা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে লোকটা সতর্ক তাকায় মারিয়ার চোখের দিকে আর চারপাশে।

মারিয়া নিঃশব্দে আশ্বাসের দ্যুতি ছড়ায় দুই চোখে। দুই ঠোঁট চেপে মৃদু হাসিতে ফুটিয়ে তোলে নির্ভরতার হাসি। বিশ্বস্ততার আভাস দেখা যায় সেখানে।

হাত বাড়িয়ে সুটকেসটি প্রায় ছিনিয়ে নিল লোকটা। কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থাকে তারা দুইজন পরস্পরের দিকে। কেউ কোন কথা বলে না। মারিয়া শ্রান্ত পায়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। দোতলায় উঠে জানালার পাশে গিয়ে নিচে রাস্তার দিকে তাকায়। যা ভেবেছিলো তাই। রাস্তায় বা ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে নেই কেউ আর।

(সমাপ্ত)

৩৭ নাম্বার জেনিং স্ট্রিটের বাড়িতে (পর্ব- এক) // লুনা রাহনুমা
৩৭ নাম্বার জেনিং স্ট্রিটের বাড়িতে (পর্ব-দুই) // লুনা রাহনুমা

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top