অমৃতা প্রীতমের কবিতা ।। হিন্দি থেকে ভাষান্তর: সাবেরা তাবাসসুম

তখন ইনসিডিন বাংলাদেশ বলে একটি প্রতিষ্ঠানে শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করছি। আমার সিনিয়র কলিগ রেখা আপার হাতে একদিন একটি বই দেখলাম, বিশ্বের নারীবাদী কবিতার সংকলন। ভাষান্তর এবং ভূমিকায় আলম খোরশেদ। নানা সংস্কৃতির নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে বেড়ে ওঠা কবিদের কবিতা মলাটবন্দি এতে। সেখানে প্রথম পাঠ করলাম অমৃতা প্রীতমের কবিতা। এর আগে তাঁর নাম শুনেছি নিশ্চয়ই। তবে তা উচ্চারিত হওয়ার সাথে জড়িয়ে ছিল খুশবন্ত সিং এবং সাহির লুধিয়ানভির নাম। যেমনটা হয়ে আসছে, পুরুষতান্ত্রিক পপুলার কালচারের অংশ হিসেবে, লেখক, বিশেষ করে “নারীলেখক”-এর নাম অনেক ক্ষেত্রেই উচ্চারিত হয় “পুরুষ লেখক”এর আলোচনার অনুষঙ্গ হিসেবে। তখন অতটা চোখ ফোটে নি বলে ক্যাবলার মত শুনে শুনে গেছি। পরে যখন একটু একটু করে চোখ ফোটা শুরু করলো,“কর্তার সংসার” তৈরির প্রক্রিয়াটা বোঝার চেষ্টা করলাম, নিজের পছন্দটা বেছে নিতে শিখলাম আমি। অমৃতা প্রীতম তখন থেকেই আমার প্রিয় কবির তালিকায় এসে গেছেন। আরো একটা বিশেষ ঘটনা উল্লেখ করতে চাইছি এখানে। সেটা অমৃতা প্রীতমের কবিতার প্রেমে আরেকটু বেশি করে পড়া প্রসঙ্গে। ২০১৫ সালের কথা। ছেলে হওয়ার পর বাইরে কাজ করা ছেড়ে দিয়েছি। উর্দু ও হিন্দী সাহিত্যের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র এবং হিন্দী সিনেমা জগতের অবিচ্ছেদ্য অংশ কিংবদন্তীতুল্য গীতিকার গুলজারের কবিতার প্রেমে হুমড়ি খেয়ে পড়ে হিন্দী ভাষাটি শিখবার চেষ্টা করছি তখন। প্রতি শনিবার সক্কাল বেলায় রবরব বাস অথবা সিএনজি ধরে মিরপুর ১০ থেকে গুলশান-১ এ ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারে যাই কোলের ছেলেটিকে বাসায় রেখে। আমাদের হিন্দী ভাষার তৎকালীন শিক্ষক অপর্ণা পাণ্ডে খুব যত্ন নিয়ে শেখাচ্ছেন। তিন মাস পর পরীক্ষায় বসতে হবে। বসলাম। রিডিং সেশনে আমার হিন্দী পড়তে পারার পরীক্ষা শুরু হলো। ম্যাডামের হাতে একখানি কবিতার বই। পাতা উলটে একটি কবিতা বের করে বললেন পড়ে শোনাতে। পড়লাম, ম্যায় তুঝে ফির মিলুঙ্গি। পুরোটা পড়তে পড়তে কবিতাটির প্রেমে পড়ে গেলাম। কবির নাম অমৃতা প্রীতম। সেই থেকে শুরু। গুলজার সাহেবের কবিতার ঘোর খানিকটা কাটার পর অবসর পেলাম তাঁর কবিতার দিকে ফেরার। অমৃতা প্রীতম— এক নিবিড় প্রেমের কবি, এক টানটান সাহসের নাম। নির্মোহ জীবন দর্শন যেমন তাঁর কবিতার ভাবনাকে ধাওয়া করে তেমনি কবিতায় এক আশ্চর্য ঔদাসিন্য বিছিয়ে রাখতে পারেন তিনি—
“যখনই তার সাথে দেখা হয়
প্রায়শই এক অলিখিত কবিতা বলে মনে হয়
এই অলেখা কবিতাকে
আমি কয়েকবার লিখে ফেলেছি
কিন্তু সে অলিখিতই রয়ে যায়”
মূলত পাঞ্জাবী ও হিন্দী ভাষায় লিখেছেন তিনি। পাঞ্জাবী সাহিত্যের প্রথম উল্লেখযোগ্য নারী লেখক হিসেবে উল্লেখ করা হয় তাঁর নাম। তাঁর সৃষ্টি জনপ্রিয় ভারত ও পাকিস্থানের সাহিত্যমহলে। নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং হচ্ছে তা। তাঁর কবিতা পাঠের পর মনে হয়, তিনি প্রকৃতই যেন তাঁর কবিতার মতো— মনে হয় লেখা হয়ে যাওয়া কোনো কবিতা, আসলে চিরকাল অলিখিতই থেকে গেছেন তিনি।
শিখ ধর্মযাজক ও কবি কারতার সিং হিতকারীর কন্যা অমৃতা কউর। মা রাজ বিবি স্কুল শিক্ষয়িত্রী। লাহোরের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী প্রীতম সিং এর সাথে বিবাহসূত্রে দুই সন্তানের জননী তিনি। পরে এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে নিজের শর্তে বেঁচেছেন বাকি জীবন তাঁর কাজের ভেতর দিয়ে। লিখেছেন দেশভাগ, নারীর অভিজ্ঞতা, স্বপ্ন নিয়ে কবিতা, উপন্যাস, গল্প, আত্মজীবনী। ভরপুর বেঁচেছেন প্রেমের সাথে। ভূষিত হয়েছেন সাহিত্য একাডেমি পুরস্কারসহ আরো বহু পুরস্কার, সম্মাননায়। যতই তাঁকে পাঠ করি, তাঁকে শুনি, মনে হয় এখন কতটা জরুরি তাঁর রচনাকে আরো আরো পাঠ করা, বোঝা। ৩১ অগাস্ট তাঁর জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়। অমৃতা প্রীতমের কবিতাজগতে পাঠককে আমন্ত্রণ জানাই। কবিতাগুলো হিন্দী থেকে বাংলায় তর্জমা করার চেষ্টা করেছি। সংগ্রহ করে দিয়েছেন সুহৃদ সিফাত ই ইলাহী। সকলের জন্যে শুভেচ্ছা।
——–

একটি সাক্ষাৎ

আমি চুপ শান্ত আর অটল দাঁড়িয়ে ছিলাম
শুধু পাশের বইতে থাকা সমুদ্রে ঝড় ছিল
তারপর সমুদ্রের না জানি কী খেয়াল হলো
ঝড়টাকে একটা পুঁটুলি বেঁধে আমার হাতে দিলো
আর হেসে সরে গেল একটু দূরে
হয়রান হলাম কিন্তু এই আশ্চর্য বিষয়টি গ্রহণও করলাম
জানতাম এই রকম ঘটনা শতাব্দীতে একবার ঘটে
লক্ষ ভাবনা মাথায় চমকাতে লাগল
কিন্তু দাঁড়িয়ে ছিলাম এই ভেবে যে
ঝড়ের পুঁটুলি নিয়ে কী করে আমার শহরে যাবো
আমার শহরের সমস্ত গলি সরু
আমার শহরের সমস্ত ছাদ নিচু
আমার শহরের সমস্ত দেয়াল নোনা ধরা
ভাবলাম যদি কোথাও তোমার দেখা পাই
তো সমুদ্রের মত একে বুকের উপর রেখে
আমরা দুটো কিনারা হয়ে হেসে উঠতে পারব
আর নিচু ছাদ অথবা সরু গলির শহরে বসতি গড়ব
কিন্তু পুরো দুপুরটাই তোমাকে খুঁজে খুঁজে কেটে গেল
আর নিজের আগুন নিজেই পান করলাম আমি
আমি একাই কিনার হয়ে কিনারাকে ভাঙলাম
আর যখন সূর্য অস্ত যাচ্ছিল
সমুদ্রের ঝড়কে আমি সমুদ্রে ফিরিয়ে দিলাম
এখন রাত নেমে এলে আমি তোমার দেখা পেলাম
তুমিও উদাস চুপ শান্ত আর অটল ছিলে
আমিও উদাস চুপ শান্ত আর অটল ‍ছিলাম
শুধু দূরে বহতা সমুদ্রের মাঝে এক ঝড় ছিল।

•••••• •••• ••••••

কুফরি

আজ আমি একটা পৃথিবী বেচলাম
আর একটা দিন কিনে আনলাম
আমি কুফরির কথা বললাম

স্বপ্নের একটা থান বুনেছিলাম
এক গজ কাপড় নিলাম ছিঁড়ে
আর বয়সের জামা সেলাই করলাম

আজ আমি আকাশের কলস থেকে
মেঘের ঢাকনা সরালাম
আর পান করলাম এক চুমুক জোৎস্না

এই যে একটু সময় আমি
মৃত্যুর কাছ থেকে ধার নিলাম
গানে গানে তার দাম চুকিয়ে দেবো

•••••• •••• ••••••

পরিচয়

তোমার দেখা পেলাম
তো কত কত জন্ম
আমার শিরায় স্পন্দিত হলো
আমার নিঃশ্বাস তোমার নিঃশ্বাসের সুধা পান করলো
মনে হলো ফিরে গেলাম বহু সময় আগে —

একটা গুহার অস্তিত্ব ছিল
যেখানে ছিলাম আমি আর এক যোগী
যোগী তার বাহুবন্ধনে যখন
আমার নিঃশ্বাস ছুঁলো
খোদার কসম!
এই খুশবুই ছিল যা তার ঠোঁট বেয়ে এসেছে—
এ কেমন মায়া কেমন লীলা
হয়তো কখনো তুমিই সেই যোগী ছিলে
কিংবা সে আদতে যোগীই ছিল—
যে তোমার আকার ধারণ করে আমার কাছে এসেছে
আর ওটাই আমি … আর ওই খুশবুও তা-ই…

•••••• •••• ••••••

আমার ঠিকানা

আজ আমি
নিজের ঘরের নাম্বার তুলে ফেলেছি
আর সরিয়ে দিয়েছি
গলির মাথায় লেখা গলির নাম
আর প্রতিটি সড়কের
দিকচিহ্ন মুছে দিয়েছি
কিন্তু যদি কখনো আমাকে
তোমরা পেতে চাও
তো প্রতিটি দেশের, প্রতিটি শহরের
প্রতিটি গলির দরোজা খটখটাবে
এটা এক অভিশাপ, এটা এক আশীর্বাদ
আর যেখানেই
স্বাধীন আত্মার ঝলক দেখবে
—বুঝবে ওটাই আমার ঘর।

•••••• •••• ••••••

আমি তোমার সঙ্গে আবার মিলব

আমি তোমার সঙ্গে আবার মিলব
কোথায়, কীভাবে, জানা নেই
হয়তো তোমার কল্পনার প্রেরণা হয়ে
ক্যানভাসে ভর করব
অথবা তোমার আঁকা ছবির এক রহস্যময়
রেখা হয়ে চুপচাপ তোমাকে দেখে যাব
আমি তোমার সঙ্গে আবার মিলব

হয়তো সূর্যের এক আলোকণা হয়ে
তোমার রঙে মিশে যেতে থাকব
হয়তো রঙের আলিঙ্গন হয়ে
তোমার ক্যানভাসে ছড়িয়ে যাব
জানা নেই, কোথায় কীভাবে
কিন্তু তোমার সঙ্গে আমি ঠিকই মিলব

হয়তো এক দৃশ্য হয়ে
যেভাবে ঝরনা থেকে পানি ছলকে আসে
সেই জলবিন্দু তোমার শরীরে মেখে দেব
আর এক শীতল অনুভব হয়ে
লেগে থাকব তোমার বুকে
আমি তো আর কিছু জানি না
শুধু এটুকু জানি
সময় যা কিছু করুক
এই জীবন আমার সাথেই চলে যাবে
দেহ ক্ষয়ে গেলে সবকিছু শেষ হয়ে যায়
কিন্তু স্মৃতির সুতো
মহাজগতের মুহূর্তের মতো
আমি সেই মুহূর্তকে বেছে নেব
সেই সুতোকেই জড়িয়ে নেব আমি
আমি তোমার সঙ্গে আবার মিলব
কোথায় কীভাবে জানা নেই

আমি তোমার সঙ্গে আবার মিলব!!

Facebook Comments

comments

১ Reply to “অমৃতা প্রীতমের কবিতা ।। হিন্দি থেকে ভাষান্তর: সাবেরা তাবাসসুম”

  1. সরদার মোহম্মদ রাজ্জাক বলেছেন:

    ”ভাবলাম যদি কোথাও তোমার দেখা পাই
    তো সমুদ্রের মত একে বুকের উপর রেখে
    আমরা দুটো কিনারা হয়ে হেসে উঠতে পারব
    আর নিচু ছাদ অথবা সরু গলির শহরে বসতি গড়ব
    কিন্তু পুরো দুপুরটাই তোমাকে খুঁজে খুঁজে কেটে গেল
    আর নিজের আগুন নিজেই পান করলাম আমি
    আমি একাই কিনার হয়ে কিনারাকে ভাঙলাম
    আর যখন সূর্য অস্ত যাচ্ছিল
    সমুদ্রের ঝড়কে আমি সমুদ্রে ফিরিয়ে দিলাম”
    কী অসাধারণ পরিচ্ছন্ন এবং নিখঁত বাস্তবতা বোধ!! ভাবা যায় না। সবগুলি কবিতাই ভালো লাগলো। ম্যাডাম সাবেরা থাবাসসুম-এর অনুবাদ শিক্ষনীয়। ভালো থাকুন সবাই।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top