তীব্র হেড লাইটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে :: সৌরভ দত্তের কয়েকটি কবিতা

ইলাস্ট্রেশন

ওহে রঙ তুলির শিল্পী
একটা ইলাস্ট্রেশন ভাবো এই কবিতার
শুধু রেখায় রেখায় কার্টুন
কিংবা পোট্রেট প্রোফাইল নয়
মন আর মগজের জটপড়া গভীর পর্যন্ত
ছড়াও একটা জীবন্ত কল্পনার রঙ…

সাদা কালো যুদ্ধের দৈনিক নাভিশ্বাস
হোঁচট খেয়ে টাল সামলায় আবার
হোঁচট খায় আবার
টাল খেয়ে উঠে দাঁড়ায়
ইলাস্ট্রেট করো দেখি হৃদপিন্ডের রৈখিক সংকট–

চার রঙা টুপি সঙ্গে নিয়ে খেলছে ক্লাউন
একেকটা টুপির রঙিন ধাপ্পা
আর ঝকঝকে কারসাজি
কেমন করে মিত্রোঁদের ফাঁসায়
এঁকে রাখো সেই বিশ্বাসঘাতক ফন্দি–

একটা ব্লাইন্ড লেন এ এসে দেখি
খুলির ভেতর জমিয়ে রাখা বুলেটগুলো
খুঁজে পাচ্ছিনা কিছুতেই
আর রুটি রাখার পাত্রে
জমানো আছে সাদা মদ
ক্ষুধার্ত পেট কে নেশায় ডোবানোর ব্লুপ্রিন্ট
ইলাস্ট্রেট করে রাখো
একটা যুদ্ধ শেষের সকালের জন‍্য–

ওহে শিল্পী তোমার জন‍্য রাখা আছে
সব না বলা কথার অনন্ত ক‍্যানভাস
কোনো এক বিক্ষুব্ধ ইতিহাস
সব ইলাস্ট্রেশন সাজিয়ে রাখবে প্রদর্শনীতে
কল্পনার জীবন্ত রঙে
আঁকা থাকবে সব না লেখা কবিতা–

বিরুদ্ধতা

চোখের সামনে বাড়ছে অবাধ
অশান্ত দিন-কাল,
লাগাম বিহীন হিংসা খেলায়
পুড়ছে মাথার চাল।
চার দেওয়ালের গন্ডি ভেঙে
ঠিকানা হীন ঘর,
এখন দেখি শরীর ছুঁয়ে
দেশের দারুণ জ্বর।

ধর্ম-বেনের ফন্দি মত
লাশের দোকান খোলা,
নিরো’র মতই রাষ্ট্র-মালিক
বাজাচ্ছে বেহালা।
নিরো’র বাড়ির অনেক দূরে
আমার মফস্বল,
দাঙ্গা দেখে রাখছে ঢেকে
ভীরু চোখের জল।

খুন জখমে পুড়ছে আমার
শ্যাম সফিকের দেশ,
অস্ত্র শেখায় মৃত্যু-কথা
সাজানো বিদ্বেষ।
আগুন থেকে আগুন ছড়ায়
স্ফুলিঙ্গ সংযোগ,
ধর্ম এবং কু-রাজনীতির
অবৈধ সম্ভোগ।

বদ হাওয়াকে ধমক দিয়ে
ডুবন্ত জ্যোৎস্নায়,
বলছি আমার দেশ যাবেনা
বিষাক্ত গোল্লায়।
ধ্বংস আমার শেষ কথা নয়,
বিভক্ত ইনসান
ভ্রান্তিবিলাস সরিয়ে গায়
সবহারাদের গান।

মাদকতা

দু’পাত্র পেটে পড়তেই
সংরক্ষণবাদীরা ভাবতে শুরু করে স্খলনের গল্প,
আমি মুচকি হেসে পাশ ফিরি উল্টোদিকে,
আরো এক বার নেশায় ঢোঁক,

সোনালী জলে ভাবনার ডুব আর উত্তরণের সাঁতার দেখেনি কেউ;

যেখানে ছবিগুলো সাদা কালো
সেখানে হাঁড়িয়ায় মিশে যায় যন্ত্রণা,
মাদুর পেতে বসি প্রৌঢ় বিকেলে
লালচে রঙে মাদকাশক্ত পশ্চিমের আকাশ,
ফ্যাকাশে ব্যাথাগুলো আবছা আলোয় এলিয়ে পড়ে ঘাসে,

মানচিত্রের সীমানা ভেঙে উঁকি দেয়
স্বপ্নাতুর এ্যাবসার্ড হাসিমুখ;

ফুটন্ত মহুয়ায় যখন মিশতে থাকে পলাশের লাল
তা চলকে পড়ায় ধূসর মাটি সেজে ওঠে গেরুয়ায়,
ডাঙায় উঠে আসা কষ্টগুলো তখন
শোক ভেঙে মাতাল হয় একতারায়;

আমি তখন মাদলের কথা শুনি,
যেখানে ধামসা এসে শুরু করে নিজস্ব গল্প।

তোমার কাছেই অনামিকা

স্বপ্নগুলো নীল খামে রাখার পরে
সব কষ্টকে একটা একটা করে বেহাগের সূঁচে
গেঁথে রাখছিলে অনামিকা,
এমনটা হওয়ার কথা ছিলনা কখনও–

শেষ থেকে নতুন শুরুর সবটুকু রহস্য
শিখেছিলাম তোমার কাছেই,
সেই ঘন কালো মেঘের কাছে রোদ্দুরের হেরে যাওয়ার দিনে
তুমি বলেছিলে, কিছু কান্না জমা আছে বলে বিরাগে মুখ লুকোলো সূর্য–
চোখের জলকে বৃষ্টি সাজিয়ে সে আবার ফিরবে ঝলমলিয়ে;

তোমার থেকেই শেখা-
অভিমান গুমরে থাকলে জলোচ্ছ্বাসে পাড় ভাঙে,
কিন্তু সে ভাঙনে বিপর্যস্ততা যতটুকু
তার চেয়ে ঢেউয়ের পরাক্রমের চিহ্ন অনেক বেশি;

কিংবা সেই কথাটা–
ঘুড়ির কেটে যাওয়া মানে‌ শুধুই কেটে যাওয়া নয়,
কোনো নির্দিষ্ট সুতোয় বাঁধা না থেকে
সে উড়তে চায় নিজের মত বল্গাহীন,
ভাসমান হাওয়ায় দুলে দুলে খুঁজে নেয় স্বাধীনতা,
ভোকাট্টা আসলে তার গ্লানি নয়, মুক্তির ঠিকানা;

মনে পড়ে বলেছিলে ,
মোমের শরীর বেয়ে নেমে আসা‌ গলিত দাগ
আসলে কোনো অন্তর্দহনের চিহ্ন নয়,
আলোকিত করার উচ্ছ্বাস মাত্র;

তবুও, তারপরেও দুঃখবিলাসে নিজেকে গেঁথে রাখো সূচাগ্রে,
আকাশের মত প্রশস্ত প্রশ্রয় ছেড়ে
স্ববিরোধী অভ্যাসে তুমি ডুবে যাও বিষাদ আঁধারে–

আমি তবু রোজ এসে দাঁড়াই তোমার কাছেই
পাশে দাঁড়িয়ে নিজস্ব গোধূলিতে
খুঁজে নিই আলো রঙের জীবন,
আর যে স্বপ্নগুলো বুনে রেখেছে স্মৃতির জাল
নিল খামের আদরে তাদের পাঠিয়ে দিই
গভীরতম রাত্রির আলিঙ্গনে।

কবিতা এখনই…

এই যে ছিন্ন ভিন্ন সময়
দগদগে সকাল সন্ধ্যে রাত
এই যে খাবার না পেয়ে সটান
ঝুলে পড়া দড়িতে;
এখনই নাকি কবিতা লেখা যায়…

যন্ত্রনা কুঁকড়ে দিচ্ছে রোজ,
সন্ত্রাসী স্বপ্নগুলো
এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে ঘুম,
ভেঙে ভেঙে পড়ে যাচ্ছে
তীব্র কালো আকাশটা,
লাভ জিহাদের হুমকিতে
জোনাকিরা সব সন্ত্রস্ত চুম্বনে;
এখনই নাকি কবিতা লেখা যায়…

তারাগুলো কক্ষপথ থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে
পরিযায়ী,
একটা আস্ত চাঁদকে
খেয়ে নিচ্ছে রাহু,
কোনো ইশতেহার নেই
দেওয়াল জুড়ে শুধুই আস্ফালন—
কঙ্কাল ছাড়া অন্য কোনো ছবি নেই;
এখনই নাকি কবিতা লেখা যায়…

সমস্ত অসহায়তা আর
ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া তীব্রতম যন্ত্রনা দেখে
লিখব ভেবেছিলাম কয়েকটা
পোস্টার
তুলির মুখ থেঁতলে দিয়েছে সন্ত্রাস
রক্তাক্ত যন্ত্রনা চুঁইয়ে পড়ছে,
কোনো রঙ নেই কাগজে;
এখনই নাকি কবিতা লেখা যায়…

তীব্র হেড লাইটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে
স্থির দৃষ্টি রেখে কয়েকটা স্লোগান
ছুঁড়ে দেব ভেবেছি যখন,
তীব্র চুম্বনকে সাহসী করার মুহুর্তে
হাতকড়া পড়েছে নগ্ন জিভে,
ত্রিশঙ্কুর মত ঝুলে আছে আদিম চিৎকার;
তবুও এখনই নাকি লেখা যায় কবিতা…

কলমটা ভিক্ষুকের মত,
দুটো কথা বলতে চেয়েও
আবছা ভাসছে শব্দগুলো,
কয়েকটা জিলেটিন স্টিক
ভরসা—
রিমোট কন্ট্রোলে ভেঙে যাবে ধোঁয়াশা
তারপর নরক তুলে আনব
সাদা কগজে,
তুমি কবিতা তুলে নিও দুঃসময়ের
কোল থেকে…

ঠিকানা

তাহলে আমার পরিচয়পত্র থাক
ঘাসের সাথেই
মাটিতে ছড়িয়ে দেব শেকড়
যদি উপড়ে ফেলতে চাও
মাটির বুকে থেকে যাবে ক্ষতচিহ্ন

তাহলে আকাশ ছাদের নীচেই
থাকুক আমার প্রতিটা শ্বাস
আলো উত্তাপের সীমানাহীন পৃথিবীর
বাসিন্দা আমি
সেখানেই আমার উত্তরাধিকার
সীমান্ত যা বাঁধতে পারেনা

তাহলে জলের সাথে আত্মীয়তা
ভাঙবনা আর
মৃত্তিকা থেকে পিপাসা মিটিয়ে
থেকে যাব চির সবুজ
তীব্র দহনে তৃষ্ণা মেটাবে আকাশ

তাহলে আগুনের পাশেই
রেখে দিও আমার নাম
দোস্তি করেছি জ্বলন্ত শিখার সাথে
অভিসন্ধি চিনে নিয়ে
শুধু বুঝে নেব রাষ্ট্রের চাল
কেননা মিলছেনা হিসেব নিকেষ

তাহলে এবার অন্য পথে যাব
খুঁজে নেব ক্ষতচিহ্নের অঙ্কগুলোর
সহজ সরল উত্তর
কোথায় ষড়যন্ত্রের শেকড়
পেয়ে গেছি সেই ঠিকানা

তাহলে আর সংশয় নেই মনে
কৈফিয়ত দেবনা কোনো
জবাব চাইব রাষ্ট্রের কাছে
কোন পরিচয় চায় সে
আমি চিনি আমার দেশ
আর দেশের মাটি
আর সুদূরপ্রসারী শেকড়…

জীবন দেব মেপে

তুমি মুগ্ধ হয়েছো অন্ধকারে-
জোনাকি বাড়ির আশেপাশে
পড়ে আছে হাত পা মুখ বাঁধা রাত্রি,
কঙ্কালসার হাত
বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রেমপত্র…
জীবনের সীলমোহর লাগানো চরাচরে
টুপটাপ ঢুকে যাচ্ছে গাঢ় কালো রঙ,
তুমি ঘুম সঞ্চয় করেছিলে যতটা
তার থেকেও কমে যাচ্ছে আলোর আয়ু-
এখনও অপচয় করছো অনেকটা জীবন
দরজা জানলা বন্ধ করে…

ওপারে তুমি এপারে আমি
মাঝখানে পুড়ছে আমাদের শবদেহ,
তোমার চোখে শোকবার্তা
আমি গাইছি জীবনের গান;
তোমার বুকে শীতগ্রস্ত ভয়
আমার রক্তে নেশা;
জীবন থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে
কষে নিচ্ছো ব্যক্তিগত হিসেব নিকেশ,
আমার দিনগত ব্যস্ততা
হৃদয়ের ভেতর শ্রমিকের মত
খেটে যাচ্ছে আজীবন;
তোমার প্রতিটা জলাশয়ের মাঝখানে
বিস্তীর্ণ মরুভূমি,
আমি প্রতিটা চরা বালিতে
অনেকটা বৃষ্টি ঝরিয়ে যাই…

এভাবে চলতে চলতে কোনো এক কালরাত্রিতে
মুখোমুখি কথা হবে তোমার আমার,
প্রতিদিন আমার শবদেহ পোড়ার মুহূর্তে
প্রাণ পেয়েছি কতটা
শুনিয়ে যাব সেই গল্প,
তুমি হাত বাড়ালে জীবন দেব আঁজলা ভরে-
মৃত ঘাসের সাথে ভোরের প্রথম আলোর প্রেম দেখে
উর্বর করে নিও ফুসফুস,
তারপর অনেকটা পথ হেঁটে যেও
বেঁচে নেওয়ার রাস্তা ধরে…

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top