কার চোখে কত জল কেবা তা মাপে ।। নাহার তৃণা

-জরুরি কথা ছিল, সময় হবে?
সময় নেই বলে চট করে সরে যাওয়ার মোক্ষম উপায় না পেয়ে ভদ্রতাবশত বললাম, জি বলুন।
-তার আগে বলেন আপনার কাহিনিটা কী?
-কাহিনি?
-এই সময় সময় কোথায় জানি হাওয়া হয়ে যান?
খুব পরিচিত কেউ হলে হালকা চালে উত্তর দিতাম হযতো। ভদ্রতা বড় বালাই হয়ে আমাকে দিয়ে বলিয়ে নিলো:

– নানা কাজে ব্যস্ত থাকি।

– কাজ কী আমরা করি না ভাই! আমার প্রোফাইল দেখেছেন নিশ্চয়ই? বড়সড় একটা সরকারি পদে বহাল আছি আপনাদের দোয়ায়।

– ও, খুব ভালো। ভুল না করলে সরকারি কাজে এই মুহূর্তে তো আপনার ব্যস্ত থাকার কথা। সোশ্যাল মিডিয়াতে কী করেন ভাই?

– এই আপনাদের এক দোষ। কে কী করবে, আর না করবে তা নিয়ে জ্ঞান দেওয়া।

লোকটার এমন আলটপকা কথায় বেশ অবাক হলাম। ইনি আমার তেমন পরিচিত কেউ নন। বাশারের শ্বশুরবাড়ির ওদিককার কেমন আত্মীয়। সেই সূত্রে আমার বন্ধু তালিকায় তার ঠাঁই পাওয়া। এর আগে সামান্য যা বাতচিত হয়েছে তার সূত্রে এভাবে কী তার কথা বলা সাজে!

পারতপক্ষে যেচে কাউকে জ্ঞান দিতে যাওয়ার অভ্যাস আমার নেই। তাছাড়া অত সময়ই বা কোথায়? কিসের ভিত্তিতে দুম করে ওরকম সরলীকরণ মন্তব্য করলেন তিনিই জানেন। বাশারের আত্মীয়, এটা বিবেচনায় নিয়ে চুপ করে থাকলাম। আমার সঙ্গে তার কী এমন জরুরি আলাপ থাকতে পারে? সাতপাঁচ চিন্তায় সময় নষ্ট না করে ভদ্রলোকের জরুরি আলাপ শোনার অপেক্ষা করতে লাগলাম। লগ আউট করে চলে গেলেই তো হয়, এমন ভাবনা যে মাথায় আসেনি তা নয়। সেটা যদিও অভদ্রতা হয়ে যায়। কী এক কৌতূহল পেয়ে বসলো আমাকে। এত আয়োজন করে কী এমন জরুরি কথা তিনি বলতে চান শোনা যাক।

জমে থাকা নোটিফিকেশনের স্তূপের দিকে তাকিয়ে কেমন ক্লান্ত লাগলো। এমন তো না ওগুলো আমি না দেখলে সমাজ সংসার গোল্লায় যাবে। কারো কিস্যু যাবে আসবে না। বলার কাজ বলা হয়েছে ব্যস ওইটুকুই। চট জলদি নিউজ ফীডের পোস্টগুলো স্ক্রল করতে গিয়ে যথারীতি কী কী রান্নাবান্না হলো, বিছানার কোন পাশে ঘুমিয়ে উঠলাম, কোন পেস্টে দাঁত মাজি, কোথায় গেলাম, কী খেলামের পাশাপাশি রাণীর জন্মদিন, কে. কে., রূপঙ্কর, সীতাকুণ্ড অগ্নিকাণ্ড, ভারতে ইসলাম অবমাননা, পদ্মা সেতুর উদ্বোধন, রোদ্দুর রায়, কোক স্টুডিও বাংলার লাইভ কনসার্ট, ডিজিটাল আইনের ভুক্তভোগীদের কাছে মোস্তফা জব্বারের ক্ষমা চাওয়াসহ, দুনিয়ার প্রায় তাবৎ বিষয়ে যথারীতি সবার মতামত দেবার চেষ্টা চোখ এড়ালো না। কিছু মানুষের হাতে কত সময়। ভাবনা-চিন্তা প্রকাশের স্বাধীন প্ল্যাটফরম এই ফেসবুকে যে যার নিজস্ব মুদ্রা দেখাতে ব্যস্ত। আমার আটটা-পাঁচটার ছক কাটা চাকুরে জীবন। ব্যক্তিগত জীবন আর সামাজিকতা রক্ষার পেছনে সময় ব্যয়ের পর ফেসবুকে সেভাবে সময় বিনিয়োগ সম্ভব হলো না। প্রয়োজন না পড়লে এর বুকে ভেসে ওঠা হয় না তেমন। আড়চোখে চ্যাটবক্সের ছোট্ট চৌখুপিটায় তাকালাম। নাহ্ ওপাশের জন এখনও জরুরি কথাটা বলে উঠতে পারেননি। কার্সার অনড় দাঁড়িয়ে আছে। হযতো আলাপের কিউতে আরো অনেকে আছেন। আর পাঁচ মিনিট দেখবো তারপর লগ আউট করে বেরিয়ে যাবো।

গাড়িতে গ্যাস না ভরলেই নয়। বিকেলে ফেরার পথে ব্যবস্হা করে ফেলবো ভেবেও ভুলে গেছি। কাজ থেকে একটানে বাড়ি চলে এসেছিলাম। কস্টকো থেকেই সচরাচর গ্যাস কিনি, সামান্য হলেও পরতা পড়ে। চড়চড় করে গ্যাসের দাম বেড়ে যাচ্ছে। বাজারে সব জিনিসের দাম বাড়তির দিকে। ইতোমধ্যে দ্রব্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে মৃদুলয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। বিশ্ব জুড়ে দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতি। ওদিকে দেশে এবছর ডলারের যা দাম, এমনটা নিকট অতীতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। সামনে কী দিন অপেক্ষা করছে জানিনা। ভাবলাম গ্যাস ভরে নদীর ওদিকটায় একটা চক্কর দিয়ে আসা যায়। সুলতা এখন না ঘুমাতে চাইলে তাকেও সঙ্গে নেওয়া যাবে। খোলা হাওয়ায় ভালো লাগবে ওর। রাত খুব বেশি হয়নি। উঠবো উঠবো করছি সেই মুহূর্তে মেসেজ আসার শব্দ পেয়ে চৌখুপিতে মনোযোগী হলাম।

-আছেন?

– আছি।

– দাঁড়ান ফোন দিচ্ছি। একটা জরুরি বিষয়ে আলাপ আছে।

এই মুহূর্তে আমি ফোনে কথা বলতে চাই কী চাইনা তার তোয়াক্কা না করে তিনি ফোন দিয়ে বসলেন।
ফোনের পিডিং পিডিং শব্দটা মাথায় ঘা দিচ্ছে। অগত্যা ফোনের সবুজ বাটনে ক্লিক করলাম।

-হ্যালো , হ্যাঁ হ্যাঁ ভাই, একটু ধরেন আমার অন্য মোবাইলে একটা ফোন আসছে…

অদ্ভুত মানুষ তো! জরুরি কথার নামে আমাকে আটকে রেখে দশ মিনিটের বেশি সময় কিছু না বলে লাপাত্তা থাকার পর ‘সরি’ শব্দটা যে বলা প্রয়োজন লোকটার মধ্যে তার কোনো বালাই দেখা গেল না। এই অভ্যাসটা অনেক বাঙালির ভেতর দেখেছি। সরি, থ্যাঙ্কিউ, প্লিজ এই ম্যাজিক্যাল শব্দগুলো ব্যবহারে খুব অনীহা। ইনি পদস্হ সরকারি চাকুরে হযতো শব্দটা শুনতে যতটা অভ্যস্ত বলতে ততটা নন। কী যন্ত্রণা! এখন আবার বলেকয়ে ফোনে কতক্ষণ আটকে থাকবেন! এবার আমাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষায় না রেখে তিনি চট জলদি সরব হলেন।

-হ্যাঁ যে কথা বলছিলাম। আপনার কী মনে হয়না ব্যাটার উচিত শিক্ষা হয়েছে? আল্লাহর তরফ থেকেই এই গজব তার উপর নাজিল হয়েছে। আপনি কী বলেন?

রীতিমত ধন্দে পড়ে গেলাম। কোন বিষয়ে কথা বলছেন উনি? জিজ্ঞেস করবো কিনা ভাবছিলাম। অস্হির হয়ে আবারও জানতে চাইলেন:

-অত কী ভাবছেন! আপনার তো আর আমার মতো অবস্হা না রে ভাই, সরকারি চাকরি করি, চাইলেই প্রকাশ্যে সব বিষয়ে আলাপ করা যায় না। কখন কোন আইনের ফাঁদে পড়ে যাই তার নাই ঠিক ঠিকানা।

ভনিতা রেখে জানতে চাইলাম:

– ঠিক কোন বিষয়ে বলছেন খুলে বলুন প্লিজ। ফেসবুকে ইস্যুর তো অন্ত নেই।

– আরে বলেন কী! এটা তো হিট ইস্যু। ইরানের পত্রপত্রিকাতে হামলাকারী বাঘের বাচ্চাটিকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে। পামরটা ভেবেছিল আমেরিকায় গিয়ে খুব নিরাপদে থাকবে। পারলো নাসারা আমেরিকা তাকে আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে?

ধোঁয়াশা কেটে বিষয়টা এবার স্পষ্ট। হ্যাঁ, পত্রিকায়, টিভিতে খবরটা দেখেছিলাম। সালমান রুশদিকে সপ্তাহ কয়েক আগে নিউইর্য়কের চৌতাকুয়া ইনস্টিটিউশনের মঞ্চে বক্তৃতা করার সময় হামলা চালিয়ে আহত করা হয়। ভালোই জখম হয়েছেন ভদ্রলোক। এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বিষয়টা নিয়ে স্বভাবতই বিশ্বজুড়ে মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী লোকজন সমালোচনায় মুখর ছিলেন। ত্রিশ বছরেরও বেশি সময়ের এক ঘটনার জের ধরে এই হামলা। উনিশশো আটাশি সালে রুশদির স্যাটানিক ভার্সেস বইটি নিয়ে বেশ হইচই হয়েছিল। সেই হট্টগোল কয়েক মাসব্যাপী চলেছিল। ভারত বাংলাদেশে বইটি নিষিদ্ধ হলেও মজার ব্যাপার তখন পর্যন্ত আয়াতোল্লাহ রুহুলুল্লা খোমেনি বা তার সাঙ্গপাঙ্গরা টুঁ শব্দ করেনি। পরে বইটি নিয়ে তারা সরব হয়। রুশদির কল্লার দাম হাঁকা হয়। শুধু লেখকের কল্লা না প্রকাশকেও টাইট দেবার ফতোয়া জারি হয়েছিল। রুশদির কল্লার দাম বাড়তে বাড়তে তেত্রিশ লাখ ডলার পর্যন্ত উঠেছিল শেষমেশ। মনে আছে এক শুক্রবারের নামাজ শেষে আমাদের নিয়ে মিছিল বের করেছিলেন হুজুরেরা। স্যাটানিক ভার্সেস খায় না মাথায় দেয় সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না তখন। শুধু আমাদের কেন হুজুরদেরও ছিল না। ফতোয়াবাজদের কতজন সেটা পড়েছেন সেই ভাবনা দানা বাধার মতো জানাশোনা আমার তখন জন্মায়নি। পরে জেনেছিলাম খোদ আয়াতোল্লাহ খোমেনি নিজেও সে বই পড়েননি। অথচ বিচারের জন্য লম্ফঝম্ফে সমস্যা হয়নি। হুজুগে পাগল মানুষজন তা নিয়ে হইহই। আমাদের দেশেও এধরনে বিষয় নিয়ে মাঠ গরম হওয়ার ঘটনা নতুন না। কিন্তু সালমান রুশদিকে নিয়ে পদস্হ এই সরকারি চাকুরের এত চুলকানি কেন! খানিকক্ষণ সময় নিয়ে বললাম:

-তাতে আমার মতামত কেন প্রয়োজন?

-আরে কী বলেন! আপনি এই দেশের একজন নাগরিক না? তাছাড়া একজন মুসলমান হিসেবেও ব্যাটাকে টাইট দেওয়ার ব্যাপারে আপনার সমর্থন থাকা উচিত। কত্ত বড় শয়তান ব্যাটা ইসলাম নিয়ে ফালতু কথা বলে। নবীজী(সাঃ) এর বিবিদের নামে কুৎসা রটায়। আপনি মুসলিম নন? নাম তো মুসলমানেরই…

আরেকদফা বিস্মিত হলাম। কিন্তু কিছু বলতে ইচ্ছে করলো না। বরং মনের খটকাটা স্পষ্ট করার জন্য জিজ্ঞেস করলাম:

-ধরেন সমর্থন দিলাম। তারপর? আর এটাই আপনার জরুরি আলাপ?

আমার সমর্থনটা কোন পক্ষে সেটা ইচ্ছে করেই ধোয়াশা রাখলাম। মাস দুয়েক আগে শিকাগোর ডেভোন এলাকায় দেখা মজার প্রতিবাদ মিছিলটার কথা মনে পড়লো। ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রতিবাদে শিকাগো শহরে বেশ কিছু পাকিস্তানী নানা প্রতিবাদী প্লাকার্ড হাতে মিছিল নিয়ে পথে নেমেছে। যার অধিকাংশ আবার মহিলা। মিছিলটা চলে না যাওয়া পর্যন্ত আমরা যে যার গাড়িতে ঠায় বসে ছিলাম। ওদের ভাবভঙ্গিতে আমি আর সুলতা খুব মজা পেয়েছিলাম। সুলতা হাসতে হাসতে বলেছিল:

-কী কাণ্ড! পাকিস্তানে ইমরান খানের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে তার জন্য এখানে প্রতিবাদ মিছিল করে কী ফায়দা?

– ওরা বোধহয় নিজেদের মিঠুন চক্রবর্তী ভাবছে।

সুলতার কপাল জুড়ে প্রশ্নবোধক চিহ্ন ফুটে উঠতে দেখে আমি মিঠুনকে নকল করে শুনিয়ে ছিলাম;

– ‘মারবো এখানে, লাশ পড়বে শ্মশানে’। সুলতার খিল খিল হাসিতে চারপাশ ভরে উঠেছিল…

ওপাশ থেকে আমার মন্তব্যের উত্তর উড়ে এলো:

-নাসারা আর মালুদের পক্ষে কারা আর আমাদের পক্ষে কারা সেটা জানা জরুরি না? তাছাড়া ওদের নানাবিধ অনৈতিক কর্মকাণ্ড আর মুখ বুঁজে মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। এই মাস দুয়েক আগে গুজরাটের ৬০০ জেলে স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন করলো আদালতে। কেন? মুসলমান তাই তাদের মাছ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা। এদিকে কিন্তু মাল্লু জেলেগুলো দুহাতে মাছ ধরে যাচ্ছে তার বেলায় কোনো বাধা নিষেধ নাই। আপনি এসব সমর্থন করেন? আরেকটা ব্যাপারেও আপনার মতামত জানতে চাই…হাওয়া সিনেমায় বন্য প্রাণীর উপর ব্যবহার নিয়ে আপনার কী বক্তব্য?

গুজরাটের নিরীহ জেলেদের ঘটনা প্যাথেটিক। দেয়ালে কতটা পিঠ ঠেকে গেলে একদল মানুষ ওরকম সিদ্ধান্ত নিতে পারে! অথচ যুথবদ্ধতা জীবনমুখী হতে শেখায়। আমাদের হৃৎপিণ্ড গলে ক্রমশ কী মনুষ্যত্ব হারিয়ে যাচ্ছে? নইলে মারী-দুযোর্গ আমাদের আর যুথবদ্ধ হতে শেখাচ্ছে না কেন! এক মানুষের পাশে অন্য মানুষ নিজেকে কেন নিরাপদ ভাবতে ব্যর্থ হচ্ছে? দেশে দেশে ধর্ম, বর্ণ দানবের চেহারা নিয়ে গিলে খাবে বলে ছুটে আসছে। কে বা কারা শেখাচ্ছে মঙ্গল বারতার বিপরীতে এমন অসূয়া পাঠ? ‘Je Suis Karl’ কিংবা ‘Collision’ বানোয়াট কোনো সেলুলয়েডীয় কাহিনি তো না। ওটাই এখন চারপাশের বাস্তবতা। শিউরে উঠি খণ্ডিত দৃশ্য, সংবাদের কোলাজ মনে করে।

অসহিষ্ণু গলায় পালটা প্রশ্ন করি – হাওয়া সিনেমা নিয়ে কী হলো আবার?

-বলেন কী! শিল্পের নামে কচকচিয়ে বনের অবলা পাখি ধরে খেয়ে সাফা করে ফেলছে। জানেন না আপনি? আর্টফিল্মের নামে মানুষরে ক্যানিবালিজমে প্ররোচিত করা।

-জানি না, কিন্তু আপনি কী জানেন উত্তরবঙ্গের এক জেলায় সাত বছরের বাচ্চার সামনে তার মাকে গণধর্ষণ করা হয়েছে গতপরশু?

-আহা তাই নাকি? কী দিনকাল হইছে। আজকাল মেয়েদের বাইরে চলাফেরার কোনো মাবাপ নাই। তাছাড়া তাদের চলনবলনও বেহায়ার মতো। সেই কারণেই এসব আরো বেড়ে গেছে।

ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে পদস্হ সরকারি চাকুরিয়ার মন্তব্য শুনে কঠিন মুখ খারাপ করতে গিয়েও রাশ টানলাম। এর সাথে কথা চালানো বৃথা। এই জাতের কুত্তার বাচ্চারা ধর্ষিতার দোষ না খুঁজে ধর্ষকদের নিয়ে মাথা ঘামালে হযতো অনেক নারী নরকবাস থেকে মুক্তি পেতো। বাজারে আগুন, দ্রব্যমূল্যের চাপে
নিম্নবিত্তদের মরণদশা, লাগামহীন দুর্নীতি, ইত্যাদি নিয়ে তার মাথা ব্যথা আছে বলে তো মনে হয়না। তিনি আসছেন পাখির জন্য প্রেম দেখাতে। খচ্চর একটা। মাথায় খুন চেপে গেল। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারালাম।

দ্বিতীয়বার না ভেবে লোকটাকে তথাকথিত বন্ধুতালিকা থেকে গদাম দিলাম। বাশারকে ব্যাপারটা জানালেই হবে। ও আমাকে খুব ভালো বোঝে। আমিও ওকে আত্মার আত্মীয় ভাবি। বহু বছরের পরিচয় আমাদের।
একই কলেজ পাশ করে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি দুজন। আজকে আমার এই জায়গায় পৌঁছানোর পেছনে বাশার এবং তার পরিবারের প্রচুর সহযোগিতা আছে। নইলে আমার মতো একজন শিকড়হীনের পক্ষে এই জায়গায় পৌঁছানো সহজ ছিল না। বাশারকে আমি শুধু বন্ধু ভাবিনা ও আমার ভাইয়েরও অধিক। তাই যে কোনো মূল্যে ওর সাথে সম্পর্কের স্বচ্ছতা রাখতে আমি খুব যত্নবান। আমাদের মধ্যে এই স্বচ্ছতা আছে বলেই বন্ধুত্ব- সংগঠন সবই চলছে স্বাচ্ছন্দ্যে। আমরা কয়েকজন বন্ধু দুঃস্হ শিশুদের জন্য একটা সংগঠন চালাই। খুব বড় কিছু না। গোটা পাঁচেক শিশুর খাওয়া-পড়াশোনার খরচ ব্যয় করি। তার সব দায়-দায়িত্বের ঝড় ঝাপটা বাশার আর মৃণাল সামলায়। আমরা আমাদের সাধ্যমতো প্রতি মাসে টাকা পয়সা দিয়ে পাশে থাকি।

কিন্তু এক্ষুনি না বেরুলে গ্যাস নেওয়া হবে না। গাড়িতে যা তেল আছে সকালে অফিস পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব না। তাছাড়া কাল আমাকে ইউ আই হাসপাতালে একবার যেতেই হবে। মিসেস উইনি ভর্তি আছেন ওখানে। এইচ আরে কাজ করতেন মহিলা। এখনো যোগাযোগ আছে। আমাকে খুব স্নেহ করেন। গত সপ্তাহে ওর ছেলে, আমার সহকর্মী রবার্টের কাছ থেকে মিসেস উইনির হাসপাতালে ভর্তির খবর পেয়েছি। একবার দেখতে না গেলে নিজের কাছে অপরাধী হয়ে থাকবো। সপ্তাহভর তুমুল ব্যস্ততার মধ্যে আগামী কালই যা একটু সুযোগ আছে। ঠিক করেছি কালই যাবো। উবারে পোষাবে না। তাছাড়া এখন কোনো বাড়তি খচরে পারতপক্ষে যেতে চাই না। সামনের কয়েকটা মাস খুব হিসেব করে চলতে হবে। আর পাঁচ মাস পর আমাদের ঘর আলো করে বেবি আসবে। তার জন্য বাজেট আলাদা করা আছে যদিও। কোনোভাবে তাতে হাত দেওয়া চলবে না। হুট করে শাশুড়ি মায়ের একটা অপারেশনের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হলো এ মাসেই। এই মুহূর্তে অপারেশন না করলেই না। তার জন্য একটা বড় অংকের টাকা পাঠাতে হয়েছে। নিজের মায়ের জন্য কিছুই করার সুযোগ আমি পাইনি। তাই হযতো মাতৃস্হানীয় শাশুড়ি বা অন্যদের জন্য সামান্য কিছু হলেও করতে চাওয়ার একধরনের আকুলতা আছে আমার মধ্যে। এবার অবশ্য সুলতাকে না জানিয়েই টাকা পাঠিয়েছি। এই অবস্হায় ওকে বাড়তি চিন্তায় ফেলতে চাইনি। শাশুড়ি মা হাসপাতালে, গুরুতর কিছু না- এটুকুই জানিয়েছি। দেশ থেকেও যেন ওকে সেভাবে জানানো হয় বলা আছে। যতটা সম্ভব নিয়মিত তাঁর খোঁজখবর রাখছি। আশা করি অবস্হা খারাপ দিকে মোড় নেবে না।

বেডরুমে উঁকি দিয়ে দেখি সুলতা ঘুমিয়ে পড়েছে। থাক বেচারি ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। ঠিক মতো ঘুম তো হয় না। খানিক পরেই হযতো অস্বস্তি নিয়ে উঠে বসবে। আমি বরং একা গিয়েই চট করে গ্যাস নিয়ে ফিরে আসি। নদীর পারে আজ আর যাবো না। পাশের ঘরে সুলতার রুম্পামাসি আছেন। বোনঝির বাচ্চা না হওয়া পর্যন্ত তিনি এখানেই থাকবেন। মাসি প্রতিবছর ছেলে অসীমের কাছে একবার বেড়াতে আসেন। সুলতাকে দেখতে এসে আমাদের হালচালে ভরসা না পেয়ে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। না চাইতেই আমরা যেন হাতে চাঁদ পেয়ে যাই। অসীমদাও তাতে আপত্তি করেননি। সুলতা ঘুমোচ্ছে, কথাটা মাসিকে জানিয়ে বেরিয়ে আসি।

গাড়ি স্টার্ট দেবার মুহূর্তে রিয়ার ভিউ মিররে নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে কয়েক সেকেন্ড স্হির তাকিয়ে থাকলাম। এই ব্যাপারটা যেন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে যখন একা থাকি। আয়নার ওই মুখটা যে আমারই, নিজেকে এই আস্হা যোগাতে অবচেতনে ওটা করি কিনা জানিনা। নিজের দিকে তাকিয়ে এই মুহূর্তে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই, হুড়মুড় করে কেন জানিনা, বহুদিন পর ফরিদপুর জেলার হতদরিদ্র আলিদিয়া এতিমখানার ছবি মনে ভেসে উঠলো। আমি ওই এতিমখানায় বড় হয়েছি। আমার উপর এতিমখানার মেজো হুজুরের সদয়দৃষ্টি না পড়লে অনেকের মতো আমাকেও হযতো লিল্লাহ বোর্ডিঙের হুজুরগিরি করতে হতো। কিংবা মুদি দোকানদারি। কিন্তু অলৌকিকভাবে মেজো হুজুর আমার জীবনের মোড় ঘুরাতে হাত বাড়িয়েছিলেন। তাঁর কারণেই আজকের এই আমি। সাধ্যের বাইরে গিয়ে তিনি আমার ভবিষ্যত গড়ে দিয়ে গেছেন। এতিমখানার অনেকেই আমাকে ঘৃণার চোখে দেখতো। কেন, সেটা আমি একটা সময় পর্যন্ত জানতে পারিনি। কিন্তু অকৃতদার ওই মানুষটা আমাকে কখনো ঘৃণা করেননি। বরং নিরন্তর আপত্য স্নেহে আগলে রেখেছিলেন। অন্যদের ব্যবহারে যেন মন ছোটো না করি তারজন্য পাখি পড়ার মতো আমাকে সব সময় বলতেন, “জন্মের উপর আমাদের হাত থাকে না বাবা। কিন্তু কর্মের উপর থাকে। তুমি চেষ্টা করবা সেইরকম কাজ যেন তোমার হাত দিয়া বাহির হয়, যাহাতে মানবজন্মের কল্যাণ নিহিত থাকে।”

শুধু তাই না, তার এক আত্মীয়া যেন আমাকে পোষ্য হিসেবে নেয় তার যাবতীয় ব্যবস্হাও তিনি করেছিলেন। মেজো হুজুরের কল্যাণে তাঁর আত্মীয়া বাশারের নিঃসন্তান মামি আয়শা চৌধুরী এবং বড় মামা ইয়াকুব চৌধুরীর আশ্রয়ে আমার থাকা পড়াশোনার ব্যবস্হা পাকা হয়েছিল। আমি যখন কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি, তখন হুজুর মারা যান। মৃত্যুর সময় আমি তাঁর পাশে ছিলাম। ইয়াকুবমামা খবর পেয়ে তাঁর গ্রামের বাড়ি করিমগঞ্জে নিয়ে যান আমাকে। সেই প্রথম শোকের দ্বিমাত্রিক আঘাত আমাকে বেসামাল করেছিল। একদিকে পিতৃসম মেজো হুজুরের মৃত্যু, আরেক দিকে নিজের জন্ম পরিচয়ের নিদারুণ এক সত্যের সামনাসামনি পড়ে হযতো ভেঙেচুরে শেষই হয়ে যেতাম। বাশারের বড়মামি-মামা তখন আমায় সন্তান স্নেহে বুক দিয়ে আগলে ছিলেন।

আশৈশব মাকে আমি মনে মনে আঁতিপাঁতি খুঁজেছি। অথচ আমাকে জন্ম দেবার দেড়ঘন্টা পর আমার মা মারা যায়। মরে গিয়ে বেঁচেই গিয়েছিল আমার মা। বুদ্ধি প্রতিবন্ধী এক এতিম কিশোরী মায়ের সন্তান আমি। গ্রামের কোন পাষণ্ড যে মায়ের শ্লীলতাহানি করেছিল, সেটাও মা স্পষ্ট করে বলতে পারেনি। যাকেই দেখতো আঙুল তুলে চেঁচাতো। নানা নানি প্রথমদিকে বিষয়টা গোপনের চেষ্টা করেছিল। স্হানীয় স্বাস্হ্যসেবা কেন্দ্রে খালাসের উদ্দেশ্যে গেলেও লাভ হয়নি। ততক্ষণে যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে। একসময় মায়ের শরীরে সন্তানসম্ভবার চিহ্ন ফুটে উঠলে বিষয়টা আর গোপন থাকেনি। ছিছিক্কার থেকে বাঁচতে মা ঘরবন্দি হয়। নাওয়া খাওয়াও করতো না ঠিকঠাক। অপুষ্টিতে ভুগে, আর চারপাশের নির্দয় ব্যবহারের চাপ হযতো নিতে পারেনি আমার হতভাগিনী মা। কী পরিহাস! দোষ করলো কে আর শাস্তিভোগ করতে হলো কাকে! মেয়ের শোক যতদিন সতেজ ছিল নানা নানি আমার লালন পালন করেছিল। পরে গ্রামের এক হুজুরের পরামর্শে আমাকে আলিদিয়া এতিমখানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তার কাছ থেকে পরিচয় সূত্রে মেজো হুজুর সবটা শুনেছিলেন। বিদায়বেলায় তিনি জানিয়ে যান আমার শিকড়হীনতার দগদগে কাহিনি।

সেই থেকে ধর্ষণ শব্দটা আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। পৃথিবীর কোথাও ওই ঘটনা ঘটবার পর সিঁটিয়ে থাকি অন্য কোথাও আমার মতো আরো একজনের জন্মের সম্ভাবনায়। সবার ভাগ্যে আমার মতো সুযোগ নাও জুটতে পারে। শিকড়হীন হয়েও মাটির উপর শক্ত পায়ে দাঁড়াবার ভাগ্য সবাই পায় না। গুটি কয়েকজন হযতো পায়। আমি তাদেরই একজন।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top