শেষ ইচ্ছা ।। সাবিনা পারভীন লীনা

এই বয়সে বাঁশখালীর কালিপুর গ্রামে আমার যাওয়ার কথা নয় । গিয়েছি আমার বাসার কাজের মেয়ে জরিনার বিয়েতে । ওই বিয়েতেও যাওয়ার কথা নয়, গিয়েছি কেবল একটা কর্তব্য পালনের জন্য ৷ ছোটবেলা থেকে জরিনা আমাদের বাসায় কাজ করে, সে এখন যুবতী মেয়ে। জরিনার গায়ের রং কালো তবে চেহারায় একটা মায়ামায়া ভাব আছে।

এ কারণে কয়েকবার তাকে বাদ দিতে গিয়ে বাদ দেয়া হয়নি। জরিনা আমার স্ত্রীকে ডাকে আম্মা, আমাকে ডাকে খালু । আমাদের দুই ছেলে, মেয়ে নেই । মেয়ের জন্য আমার স্ত্রীর মনের মধ্যে গোপন আকুতি ছিল, তাকে বাদ দিতে না পারার এটাও একটা কারণ হতে পারে। কাজের বিনিময়ে তার মা কোন দিন টাকা নেয়নি, যতোবারই বলেছি ততোবারই বলেছে, “জরিনার বিয়ার সমত দিয়ুন, অনর যা মন চায় দিয়ুন। পাইরলি জরিনার লাই উগ্গা ভালা পোয়ার ব্যবস্থা করি দিয়ুন । ধরি রাখন, ইয়ান অনর কাছে আঁর দাবি।”

আমি তখন বলি “যদি শেষে টাকা পয়সা না দিই, এমন তো অনেক হচ্ছে।” তখন সে বলে   “ অনে শিক্ষিত মানুষ, তার উয়র ভালা মানুষ, অনে এই কাজ কিল্লাই গরিবান ? আঁরা মানুষ চিনি ।”

বছর দুই হয় জরিনার মা বিলকিস বানু হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেঝেতে দুই দিন পড়ে থেকে মারা যায় । তার স্বামী মারা যান জরিনার যখন তিন বছর তখন । এই দুনিয়ায় এক অর্থে জরিনার আপন বলে কেউ নেই। থাকার মধ্যে আছে তার দূর সম্পর্কের এক মামা, তার নাম জামাল, অনেক খোঁজাখুঁজির পর জানা গেল ভদ্রলোকের খাসমহালে টিনের দোকান আছে। তার বাড়িও বড় রাস্তার পাশে। জামালের দোকান বললে সবাই একনামে চেনে । জামাল অবস্থাসম্পন্ন হলেও কৃপণ । জরিনাকে পাত্রস্থ করা এই এক গুরু দায়িত্ব, অনেক চেষ্টা করেও পাত্র পাচ্ছি না। জামাল সাহেবকে অনেকবার জরিনার জন্য পাত্র খুঁজে দেয়ার কথা বলেছি কিন্তু মুখে  জি স্যার জি স্যার বললেও কোন উদ্যোগই নেয়নি। পরে যখন বলি জরিনার বিয়ের পুরো খরচা আমরা দেব, এই নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না তখন ভদ্রলোক দৌড়ঝাঁপ শুরু করে । আশ্চর্যজনক হলেও সত্য পনের দিনের মধ্যে পাত্রের সন্ধান দেয়, মনে হচ্ছে ভদ্রলোক পাত্র নিয়েই বসে আছে। জরিনার বিয়ের আয়োজন নিয়ে আর কারো মাথা ঘামাতে হচ্ছে না, ভদ্রলোক আয়োজনের খুঁটিনাটি নানা বিষয় নিয়ে তৎপর ।

পাত্রের নাম মামুন, সে রামদাশ মুন্সির হাটে শাড়ির দোকানে চাকরি করে, দেখতে-শুনতে ভালো । জামাল সাহেবের উদ্যোগে বিবাহের সব ঠিকঠাক হয়, বিয়ে হবে জৈষ্ঠ মাস পার করে আষাঢ় মাসের শেষে। ওই এলাকায় যে কোন ছুতায় বাউলগানের আসর বসে, বাউলগানের আসর বসানোর জন্য এতোবড় একটা উপলক্ষ্য কি করে মিস করা যায়।

জামাল সাহেবের ঠিকানার সুত্র ধরে কালিপুরে আমরা পৌঁছি সন্ধ্যার একটু আগে । আমাদের সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় রমিজ মেম্বারের বাড়িতে । জরিনার বিয়েও সেই বাড়িতে হবে, অবশ্য জরিনাকে আগেই তার মামা নিয়ে এসেছে, সে আছে তার মামার বাড়িতে ।

রমিজ মেম্বারের বাড়ি বলতে একেবারে বাগানবাড়ি, সামনে পিছনে নানা ধরনের গাছ। ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চান্ন ষাটের বেশি নয়, লম্বা দাড়ি, সাদা পায়জামা পাঞ্জাবির সঙ্গে মাথায় সাদা টুপি । ভদ্রলোকের বেশভূষা দেখে আমার ভালো লাগেনি । গ্রাম্য টাউট ছাড়া মেম্বার চেয়ারম্যান হওয়া প্রায় অসম্ভব। পরে জানতে পারি রমিজ সাহেব আসলে মেম্বার নয়, কোনদিন ইলেকশনও করেননি । পারিবারিকভাবে প্রচুর জমি পেয়েছেন, এলাকার স্কুল কলেজের জন্য জামি দান করেছেন, পাঠাগার স্থাপন করেছেন । লোকজন সম্মান করে মেম্বার সাব ডাকেন । গ্রামের যে কোন সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তাকে ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না । এইসব তথ্য জানার পর ভেতরে ভেতরে অনুশোচনা হয়, বেশভূষা দেখে কাউকে বিচার করা মোটেই সঙ্গত নয়।

আমার আদর আপ্যায়নে যাতে কোন ত্রুটি না হয় সে দিকে রমিজ মেম্বার সদা সতর্ক। তার সদ্য কলেজে উঠা মেয়েটার নাম লোপা, লোপা আরো বেশি সতর্ক।

সন্ধ্যায় চা নাস্তা খাওয়ার পর রমিজ মেম্বার পরদিনের প্রোগ্রাম নিয়ে আলোচনা করেন। জরিনার বিয়ে, খাওয়া-দাওয়া সব আয়োজন দুপুরের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে । আমি বললাম, “ তা হলে বিকেলের দিকে আমরা শহরে পৌঁছে রাতের বাসে ঢাকায় ফিরে যাবো ।” রমিজ মেম্বার চোখ কপালে তুলে বলেন, “চলে যাবেন মানে স্যার, আসল আকর্ষণই তো রাতে । বিবাহ উপলক্ষে গানের আসরের ব্যবস্থা করেছি। অনেক দিন গানের আসর বসে না । যেনতেন গানের আসর নয়, আমাদের গ্রামের দুই প্রতিভাকে আসরে দেখতে পাবেন”।

লোপা পাশ থেকে বলে, ‘প্রতিভাদের সম্পর্কে স্যারকে বলো আব্বা, না হলে গুরুত্ব বুঝবে কিভাবে?

-তুই ঠিক বলেছিস মা, আপনি শামসু দেওয়ানের নাম শুনেছেন?

-না, শুনিনি।

ভদ্রলোকের বিস্ময়ের সীমা নেই।

“সেই এক আশ্চর্য প্রতিভা, এই গ্রামের এখন দুই প্রতিভা আছে; তার মধ্যে একজন শামসু দেওয়ান, অন্যজন নেপাল ঢুলি। নেপাল ঢুলিকে আপনার চেনার কথা নয়, কিন্তু শামসুকে চেনার কথা । এই দুই প্রতিভাকে একমঞ্চে হাজির করা হবে । শামসু এই গ্রামের ছেলে হলেও বহুদিন গ্রামে আসে না । ছেলেটা ছোটবেলায় ঢাকায় মামার বাসায় পড়তে গেছে আর গ্রামে ফিরেনি। আগামীকাল সকালে আসবে, তার সঙ্গে কথা হয়েছে । এই ইচ্ছা আমার অনেকদিনের,  কোন উপলক্ষ পাচ্ছি না, আপনার মতো সম্মানি মানুষ এলাকায় এসেছেন সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইছি না।”

রমিজ মেম্বারের এই বক্তব্যের পর ঢাকায় চলে যাওয়ার প্রসঙ্গ অবান্তর ৷

“এই দুইজন সম্পর্কে ধারণা দেয়ার ব্যবস্থা করছি’ বলে রমিজ মেম্বার সোহেল নামের এক ছেলেকে ডেকে নেপাল ঢুলিকে রাতে নিয়ে আসতে বলে। এর পর লোপার দিকে তাকিয়ে বলে, “মা, তুমি স্যারকে ইউটিউব থেকে শামসুর কয়েকটা গান শোনানোর ব্যবস্থা করো ।”

শামসু দেওয়ানকে না চেনার জন্য আমার মধ্যে কোন অনুশোচনা তৈরি হয় না। গ্রামে যেকোন বিষয়ে অতিরঞ্জন স্বাভাবিক ব্যাপার ।

চা-নাস্তার পর্ব শেষে লোপা স্মার্ট টিভিতে শামসু দেওয়ানের গান ছেড়ে আমার পাশে বসে। শামসুর প্রথম গানঢা হচ্ছে জসিমউদ্দীনের “ নদীর কূল নাই ….”

গান শেষ হওয়ার পর লোপা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে । আমি কিছু বলি না।

“এবার আর একটা গান শোনেন। এবারের গান ‘পুবাল হাওয়া পশ্চিমে যাও.” কাজী নজরুলের লেখা ।

গান চলার সময় লোপা ক্ষণে ক্ষণে আমার দিকে তাকায়, আমার অভিব্যক্তি বুঝার চেষ্টা করে।

– গান কেমন স্যার ?

– ভালো ।

“কেবল ভালো !“ লোপার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে যায়।

– কেবল ভালো না, অসম্ভব ভালো ।

লোপা এবার শান্ত হয় । আসলে আমি মনে মনে লজ্জিত হয়ে পড়ি, আমাদের সময়ে বেতারে আব্দুল আলীম আর বেদারউদ্দিনের গলায় এই গান শুনতাম । এমন আশ্চর্য গলার একজন শিল্পী আছে, আমি জানিই না।

একটু পর একটা ছেলে নেপাল ঢুলিকে নিয়ে হাজির । নেপালের বয়স বেশি না, বাইশ তেইশ হবে, একবারে ফর্সা । নেপালের চোখে কালো চশমা, সে জন্মান্ধ।

নেপাল আমার সামনে বসে আছে । রমিজ মেম্বার নেপালকে আমার সম্পর্কে বলেন, ‘উনি হলেন প্রফেসর ইমতিয়াজ , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক । তোমার আর শামসু দেওয়ানের আসর উপভোগ করবেন । ওনার সম্মানে আসর বসবে ।’

নেপাল ঢুলির এইসব বিষয়ে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই , শিশুর মতো অদ্ভূত অদ্ভূত অঙ্গভঙ্গি করছে।

নেপালের আচরণে সামান্য লজ্জিত মনে হয় রমিজ মেম্বারকে । চোখের ইশারায় আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন  “ঢোলের বাজনা শুরু না করলে বুঝতে পারবেন না, ও কি জিনিস ।”

রাতে খেতে বসে দেখি এলাহিকাণ্ড,  নানা পদের রান্না । খাওয়ার এক ফাঁকে রমিজ মেম্বার বলেন, ” শামসু দেওয়ানের গান কেমন লাগলো, কিরে মা স্যাররে গান ধরাই দিয়ুছ না ?”

“আমি শুনেছি, আপনি ঠিকই বলেছেন, ছেলেটার বয়স বেশি নয়, তবে গলা অসাধারণ, এমন গলায় গান শুনিনি।”

“সে তো এখন বলতে গেলে দেশেই থাকে না,  সারা বছরই শান্তিনিকেতনে পড়ে থাকে। কি রে মা, কথা ঠিক বলেছি?”

লোপা বলে. “শান্তিনিকেতনে যে গান গাইছে সেটা শুনলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে।”

“খাওয়ার পর তুই তা হলে ধরিয়ে দিস ।”

“নেপাল ঢুলিও বিরাট প্রতিভা, তার ক্ষমতা আপনি কাল দেখতে পাবেন। আসলে আমারই ভুল হইছে, তার বাড়ি থেকে একটা ঢোল নিয়ে আসা উচিত ছিল, তা হলে আপনি আজই বুঝতে পারতেন ।”

“না, কাল শুনলেই হবে, ভালো জিনিসের জন্য একটু অপেক্ষা করাই উচিত।”

পরদিন সকালে এলাকা ঘুরে দেখার জন্য বের হই লোপাকে সঙ্গে নিয়ে । রাস্তার দুই পাশে বিস্তৃত লিচু বাগান । যার সঙ্গে দেখা হয় সেই সালাম দিয়ে বলে, “স্যার কেমন আছেন”। আমার মনে হয়েছে এরা সবাই আমার আগমন সম্পর্কে জানে ।

আমি লোপাকে বলি, ” সবাই মনে হচ্ছে আমার আগমন সম্পর্কে জানে !”

“সবাই জানে, সব কিছুতেই গ্রামের মানুষের আগ্রহ । তবে তাদের আগ্রহ শামসু আর নেপাল ঢুলিকে নিয়ে নয়, শামসু দেওয়ানকে তারা চেনে না। আর নেপাল তাদের কাছেই থাকে । কাছে থাকা মানুষ যতো প্রতিভাবান হোক তার কদর কম । কদর পেতে হলে দূরে থাকতে হয়৷ তাদের আগ্রহ আপনাকে নিয়ে ।”

“আমাকে নিয়ে কেন?  আমি তো বিখ্যাত কেউ নই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একসময় পড়াতাম এখন রিটায়ার্ড।”

‘’আপনি এর মধ্যে এই গ্রামে বিখ্যাত হয়ে গেছেন ।”

“কিভাবে বিখ্যাত হলাম?”

লোপা ইতস্তত করে। আমি তাকে আবার বলি – ”কিভাবে বিখ্যাত হলাম?”

লোপা আমার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে এবার মাটির দিকে তাকিয়ে বলে,  “গ্রামের সবাই আপনাকে ফেরেশতা মনে করছে।”

“আমাকে ফেরেশতা মনে করবে কেন? আমি কি করেছি?”

“আপনি কি করেননি? জরিনার বিয়ের সব খরচ দিয়েছেন ।”

“ওটা তো কোন দান দয়া নয়, আমার বাসায় অনেক দিন কাজ করেছে, তার পাওনা টাকা তাকে দিয়েছি।”

” গ্রামের সবার ধারণা ছিল আপনি টাকা দেবেন না, এখন অনেক নামি-দামি লোকেরা এসব কাজ করেন। টাকা দেওয়ার কমিটমেন্ট করেছেন জরিনা আপার মায়ের সঙ্গে, সেই মা-ই মারা গেছেন, এই টাকার দাবি করবে কে?”

“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্পর্কে এমন অদ্ভূত নেতিবাচক মনোভাব কি করে হলো?”

“তা আমি জানি না স্যার ।”

“তোমার কি অনুমান হয়?”

“আমার কোন অনুমান হয় না।”

“আসসালামু আলাইকুম” বলে এক বয়স্ক লোক হাত বাড়িয়ে রাখেন ।

আমি হাত বাড়িয়ে দিতেই খপ্ করে আমার হাতটা দুই হাতে ধরে থাকেন কিছু সময়। “আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে কতো ভালো লাগছে স্যার বলে বুঝাতে পারবো না। কতোদিন পর একটা ভালো মানুষের সঙ্গে হাত মিলানোর সুযোগ পেলাম, সবই আসলে আল্লাহতায়ালার ইচ্ছা।”

আমরা লিচু বাগান ছেড়ে হলুদ ক্ষেত, হলুদ ক্ষেত পার হয়ে সুপারী বাগানের দিকে যাই। বাগানের শেষ প্রান্তে একটা বাড়ি। আমি লোপাকে বলি “এটা কার বাড়ি?”

“ওটাই তো নেপাল ঢুলির বাড়ি, নেপাল ঢুলি জন্মান্ধ, কিন্তু আল্লাহ তাকে আশ্চর্য ক্ষমতা দিয়ে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন, ঢোল বাজনায় তার কোন তুলনাই হয় না। আজ রাতে শামসুর সঙ্গে ঢোল বাজাবে ।”

“এই ধরনের একটা অনুষ্ঠান আয়োজন আব্বার অনেক দিনের ইচ্ছা, বলতে পারেন জীবনের শেষ ইচ্ছা। আল্লাহপাক শেষ পর্যন্ত আব্বার ইচ্ছা পুরণ করতে যাচ্ছে। আমরা চাই নেপাল ঢুলির প্রতিভা দেশ-বিদেশের মানুষ জানুক।”

“কিভাবে দেশ বিদেশের মানুষ জানবে? ”

“পুরো অনুষ্ঠান ভিডিও করে ইউটিউবে ছেড়ে দেয়ার জন্য আব্বা তানভীর ভাইয়াকে দায়িত্ব দিয়েছেন। তানভীর ভাইয়ার বাজারে ভিডিও এডিটের দোকান আছে । আমার ধারণা ভিডিওটা ভাইরাল হবে। আপনার কি ধারণা স্যার? ”

“আমারও একই ধারণা । ”

ভালোয় ভালোয় জরিনা মামুনের বিয়ে সম্পন্ন হয়, মেহমানদের খাওয়া-দাওয়াও ভালোমতো হয়। জামাল সাহেব কৃতজ্ঞতা জানিয়ে নবদম্পতিকে সঙ্গে করে নিয়ে যান।

বিকেল হতেই তুমুল বৃষ্টি, আমরা বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখি । আমি রমিজ মেম্বারকে বলি এভাবে বৃষ্টি থাকলে গানের আসর জমবে কিভাবে?

“এই বৃষ্টি থাকবে না, আপনি চিন্তা করবেন না।”

সত্যি সত্যি সন্ধ্যার আগে আগে বৃষ্টি থেমে যায় । চারিদিকে হালকা একটা বাতাস।

“শোনেন প্রফেসর সাব, জোছনা রাত হলে ভালো হইত । কিন্তু দুই দিন পর অমাবশ্যা, তাই চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার,  একহাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না। আমার ইচ্ছা ছিল জোছনা রাতে এমন একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করার । কিন্তু মানুষের সব ইচ্ছা একসঙ্গে পুরণ হয় না। এটা আল্লাহপাকের ইশারা । তবে অন্ধকার হলে চিন্তার কিছু নাই, পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে । শামসু দেওয়ানের সঙ্গে এর মধ্যে দুইবার কথা হয়েছে, সে সন্ধ্যার আগে পৌঁছে যাবে।”

রাত আটটায় অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা , অলরেডি সাড়ে আটটা পার হয়ে গেছে। স্টেজে নেপাল ঢুলি বসে আছে, তার তিন দিকে তিনটা ঢোল । কিছুক্ষণ পরপর শিশুর মতো অঙ্গভঙ্গী করছে। নেপাল কেবল জন্মান্ধই নয়, প্রতিবন্ধীও, এমন একটা লোকের শিশু সুলভ  আচরণ প্রত্যক্ষ করা কারো ধৈর্য্যে কুলানোর কথা নয় । সমবেতদের মধ্যে বিরক্তি ছড়িয়ে পড়ে।

শামসুর দেরি দেখে প্রেসার বেড়ে রমিজ মেম্বার হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। জরুরি ভিত্তিতে আশু ডাক্তারকে আনা হয়, প্রেসার দেখে আশু ডাক্তারের চোখ চড়ক গাছ । রমিজ মেম্বারকে তেতুলের শরবত খাইয়ে শুইয়ে রাখা হয়েছে । সমস্ত আয়োজন তদারকির জন্য রমিজ মেম্বারের দুই লোক এক পায়ে খাড়া থাকলেও মাঝে মাঝে ডেকে খবর নেন।

নয়টা উনত্রিশ মিনিটে শামসু তার দুই সঙ্গীকে নিয়ে হাজির । লোপা দৌড়ে গিয়ে খবরটা দিতেই রমিজ মেম্বার উঠে বসে মোনাজাত ধরেন । রমিজ মেম্বারের শরীরে যেন প্রাণ ফিরে এসেছে।

“ শোনেন প্রফেসর সাব, মানি ব্যক্তির মান আল্লাহপাক রাখেন । এইসব ক্ষেত্রে একঘন্টা ২৯ মিনিট লেট কোন লেট না, ছেলেটার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারায় বড় টেনশনে পড়ে গেছি।”

“গান বাজনা আজ না হলে কাল হবে, এই নিয়ে এতো সিরিয়াস হওয়ার কি আছে?”

“এই রকম একটা আয়োজন ভন্ডুল হয়ে যাবে, আর আপনি বলছেন সিরিয়াস হওয়ার কি আছে?”

দেরি হওয়ায় শামসু দেওয়ান তার দুই সঙ্গীকে নিয়ে সরাসরি স্টেজে গিয়ে উঠে। বাঁশখালী উপকূলীয় ডিগ্র্রী কলেজের বাঙলার শিক্ষক শ্যামল কান্তি নাগ আগে থেকে প্রস্তুত হয়ে আছেন অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য । শ্যামল কান্তি নাগের গায়ের রঙ কালো, তার ওপর তিনি পরেছেন বেগুনি রঙের পাঞ্জাবি । মাথার একপাশ থেকে লম্বা চুলে পরিপাটি করে টাক্ ঢেকে দিয়েছেন। মনে হয় শ্যামল কান্তি লোকটা উপস্থাপনার নামে অনেক জ্বালাবে। কিন্তু লোকটা বাহ্যিকভাবে দেখতে কিম্ভুত হলেও তার কান্ডজ্ঞান অত্যন্ত টনটনে, গলার আওয়াজও ভরাট । তিনি কয়েকটা বাক্যে দুই জনের পরিচয় তুলে ধরেন । তার পর হঠাৎ আমাকে স্টেজে উঠার আহ্বান জানান।

রমিজ মেম্বার বলেন, “যান, যান না স্যার।”

স্টেজে উঠে বসার সঙ্গে সঙ্গে রমিজ মেম্বারের মেয়ে লোপা আর শ্যামল কান্তির মেয়ে সুমি আমার হাতে ফুলের তোড়া তুলে দেয়।

শ্যামল কান্তি দুই একটা বাক্যে আমাকে সংবর্ধনা দেয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেন। তারপর অনুষ্ঠান শুরু করে দিয়ে দর্শক সারিতে এসে বসেন। শ্যামল কান্তি সম্পর্কে আমার ধারণা পাল্টে যায়, লোকটার প্রতি শ্রদ্ধা তৈরি হয়।

রমিজ মেম্বারের কাছে শ্যামল কান্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন শ্যামল স্যার কবি, অনেক উচুঁমাপের কবি, গ্রামে পড়ে থাকায় মেধার মূল্যায়ন হচ্ছে না। কাল কয়েকটা কবিতা আপনাকে পড়তে দেব, বুঝবেন কতো বড় কবি ।

পাশাপাশি দুইটা সিংহাসন টাইপের চেয়ার, আমার পাশে বসেছেন রমিজ মেম্বার। শ্যামল বাবুকে ডেকে এনে আমার পাশে বসালেন। রমিজ মেম্বার পান চিবুচ্ছেন, সুগন্ধি জর্দার ভুরভুরে গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। এই ধরনের গন্ধে আমার মাথা ঘুরে, কিন্তু কি কারণে আজ গন্ধটা ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে একটা পান মুখে পুরে দিয়ে চিবুতে থাকি।

শামসু দেওয়ান নেপাল ঢুলিকে গানের তাল বলে দিয়ে বাঁশিতে ফুঁ দেয়। শামসুর বাঁশি থেকে কোন সুর বের হয় না, প্রথম প্রথম বাঁশি শিখলে যেমন কেবল ফুঁ ফুঁ শব্দ বের হয় ঠিক সে রকম শব্দ বের হয়। রমিজ মেম্বার হঠাৎ আমার হাত শক্ত করে ধরে রাখেন, মনে হয়  আমরা মাঝ নদীতে ঝড়ের কবলে পড়া নৌকার যাত্রী, নৌকা যে কোন সময় উল্টে যেতে পারে। হঠাৎ শামসু বাঁশিটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে গান ধরে। কিন্তু যে গানের বাজনা বাজছে, গান ধরেছে অন্যটা, গানের সঙ্গে বাজনার কোন সঙ্গতি নেই । আমার হাতে আরো কঠোর চাপ অনুভূত হয়। রমিজ সাহেব জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছেন।

শামসু উঠে দঁড়ায়, কিন্তু শরীরের টাল সামলাতে পারে না। একটু পরে ধপাস্ করে নিচে লুটিয়ে পড়ে, তার সঙ্গে আসা দুই যুবক তাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে স্টেজ থেকে নেমে যায়। আমার কানের কাছে মুখ এনে রমিজ মেম্বার বলে, “দেখছেন কতো বড় বেয়াদ্দপ, পাড়মাতাল হয়ে স্টেজে উঠেছে।”

গান থেমে যাওয়ায় নেপাল ঢুলি বাজনা বন্ধ করে দিয়ে হাতড়িয়ে শামসুকে খোঁজে, কিন্তু তাকে পায় না। পুরো দর্শক হতবিহবল। রমিজ মেম্বার উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “নেপাল তুমি বাজাও, আমরা আজ নেপালের বাজনা শুনবো । আপনারা কি বলেন?”

কেউ একজন নেপাল ঢুলিকে ঢোল ধরিয়ে দেয়, নেপাল মন খুলে বাজাতে থাকে । নিশুতি রাতে বহু দূর পর্যন্ত নেপাল ঢুলির বাজনা ছড়িয়ে পড়ে । সত্যি এমন বাজনা আমি কোন দিনই শুনিনি।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top