কফিল আহমেদ, আমাদের সহোদরা জ্বলন্ত অগ্নি ।। অমল আকাশ

১.
সাতানব্বই সালের একুশের বইমেলা। ধাবমান সাহিত্য আন্দোলন থেকে স্টল নেয়া হয়েছিলো বাংলা একাডেমির বাইরের রাস্তায়। একদিন রাতে ধাবমান সম্পাদক রনজিত কুমার ভীষণ উচ্ছ্বোসিত চোখ নিয়ে হাজির হলেন স্টলে। তার উচ্ছ্বাসের কারণ জানতে চাইলে বললেন, আজকে তিনি জাদুঘরের ছোট মিলনায়তনটাতে এমন এক তাগড়া, রাগিল শিল্পীর গান শুনে এসেছেন, যার গান একদমই নতুন ঘরানার মনে হয়েছে। আমরা যারা স্টলে ছিলাম এবং রনজিতদার অভিব্যক্তির বিষয়ে পরিচিত, তারা বুঝতে পারলাম দাদা নতুন কিছু আবিষ্কারের মতো আনন্দে টগবগ করছেন। কি সেই শিল্পীর নাম? উত্তরে রনজিতদা জানালেন তার নাম কফিল আহমেদ। দাদা আরো জানালেন এই শিল্পীকে তিনি খুব শীঘ্রই নারায়ণগঞ্জে আমন্ত্রন জানাবেন। এবং করলেনও তাই। কিছুদিনের মধ্যেই কফিল আহমেদ চলে আসলেন ধাবমানের মহড়া কক্ষে। আমরা তখন ধাবমানের গানের দলটাকে একটু একটু করে গুছিয়ে তুলছি। আমি সবেমাত্র কিছুগান গড়ে তুলেছি। গানের দলে নিজেদের গান গুলোর পাশাপাশি আমরা গাইছি তখন হেমাঙ্গ, সলিল, প্রতুল, রুদ্র ইত্যাদি। তো এমন এক কালে একটা প্রাইমারী স্কুলের ক্লাস রুমে, যেখানে রিহার্সেল করতাম আমরা, সেখানে সেই বিকালে ঝাঁকড়া চুলের তাগড়া এক মানুষ হারমোনিয়ামে হাত রেখে তার দরাজ কন্ঠ ছুঁড়েদিলেন আমাদের দিকে-
‘বাঘ বন্দি সিংহ বন্দি, বন্দি তোমার হিয়া
বন্ধুরে, শিকল ছিঁড়িয়া দে মরি দেখিয়া’
সেই আমার প্রথম কফিল দর্শন ও শ্রবণ। সেই থেকে কফিল আহমেদের সাথে কাজেরও যাত্রা শুরু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামসুন্নাহার হল ছাত্র আন্দোলনে, শহীদ মিনারে ছাত্রদের অনশনে টানা তিনদিন তিন রাত আমরা একসাথে গান করেছি, শ্লোগান গেয়েছি, গড়ে তুলেছি ব্যারিকেড। বুয়েটের ছাত্র আন্দোলন, জাহাঙ্গীর নগরের যৌন নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলনসহ প্রায় সকল ছাত্র আন্দোলনে, উল্লেখযোগ্য শ্রমিক আন্দোলনে কিংবা বিভিন্ন সভা সমাবেশে প্রায়শ আমরা একসাথে গান করেছি। তখন যন্ত্রসংগীত বলতে অধিকাংশ সময়ে কফিল ভাইয়ের হাতে হারমোনিয়াম, শিশিরদার তবলা। মাঝে মাঝে গিটারের সঙ্গতো মিলে যেতো। এমনো বহুদিন হয়েছে তবলা বাদকের অনুপস্থিতিতে আমিই তবলা বা ঢোল বাজিয়ে গান করেছি কফিল ভাইয়ের সাথে।
এরই মাঝে ২০০০ সাল যখন নতুন শতাব্দির দিকে যাত্রা শুরু করেছে, তখন ‘ঘোড়াউত্রা’ প্রকাশনা থেকে কাজ শুরু হলো কফিল আহমেদের প্রথম এবং একমাত্র এ্যালবাম ‘পাখির ডানায় দারুণ শক্তি, গরুর চোখে মায়া’। এবং নতুন শতাব্দি ২০০১ আমাদের উপহার দিলো নতুন যুগের, নতুন বোধের গানের সংকলন। যা বাংলাগানের ইতিহাসে উজ¦ল মাইল ফলক হয়ে থাকবে। ‘পাখির ডানায় দারুণ শক্তি, গরুর চোখে মায়া’ এমনো কোনো সংগীত সংকলনের নাম হয়, এর আগে কখনো হয়েছে পৃথিবী? হয়, তখনি, যখন সে গান শুধু মানুষের কথা বলে না, পৃথিবীর সর্বপ্রাণের সাতটা শঙ্খ এক সাথে বাজায় কেউ, পুরোটা সপ্তক একবারে বেজে ওঠে যখন। এমনি এক সম্মিলনের সুর যা নাগরিক সমাজে কফিল আহমেদের আগে এভাবে বাজাতে পারেনি কেউ। যদি সাংগেতীক ভাবেও দেখি তবে কি আছে পুরোটা সপ্তকে ? ভারতীয় সংগীত শাস্ত্র মতে ষড়জ-ময়ূরের স্বর, ঋষভ- চাতকের স্বর, গান্ধার-ছাগলের স্বর, মধ্যম-সারসের স্বর, পঞ্চম- বসন্তকালের কোকিলের স্বর, ধৈবত- বর্ষাকালের ভেকের (ব্যাঙ) স্বর, নিষাদ- হাতির স্বর। অর্থাৎ পুরোটা সপ্তক যখন একবারে বেজে ওঠে, সে স্বর তখন সকল প্রাণের স্বর মিলে মহাপ্রাণের ঐকতানে রূপান্তরিত হয়। আর সেই আকাঙ্খা থেকেই কফিল আহমেদ গভীর প্রত্যয়ের সাথে উচ্চারণ করেন-
‘সাতটা শঙ্খ একসাথে বাজাবো
পুরোটা সপ্তক একবারে বাজাবো
একটাও কম না।’
তার একটাও কম হলে মহাপ্রাণের সেই ঐকতানতো বেজে উঠবেনা। ‘পাখির ডানায় দারুণ শক্তি, গরুর চোখে মায়া’ সংগীত সংকলনের পরতে পরতে সর্বপ্রাণের সেই ঐকতানকেই বাজাবার আয়োজন করেছেন কফিল আহমেদ। তাইতো এ কেবল একটা অডিও এ্যালবাম নয়, পৃথিবীকে দেখবার, সকল প্রাণের সাথে ‘মহাসৃষ্টির সহোদরের’ মতো নিজেকে খুঁজে পাওয়ার এক নতুন জীবন দৃষ্টি। প্রাণে প্রাণ মেলাবার কথাতো নতুন নয়, ভারতীয় দর্শনে ফিরে ফিরে এসেছে সেই আকুতি। কিন্তু কফিল আহমেদ বলেন-
‘প্রাণে প্রাণ মেলাবোই, বলে রাখি।’
অর্থাৎ মেলাবোই এ ‘ই’ প্রত্যয় যুক্ত করে তিনি এক সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হন। এই প্রতিজ্ঞা আমাদেরকে নতুন যুগে নতুন ভাবে উদ্বুদ্ধ করে প্রথাবদ্ধ চৈতন্যে বিনির্মাণের ঝড় ডেকে আনে।
২.
পরিচয়ের শুরু সময়টাতেই আমাদের নিয়ে কফিল আহমেদ কাজ করেছিলেন ‘হাজার বছরের বাংলা গান’ শিরোনামে একটা স্ক্রিপ্ট নিয়ে। যেখানে তিনি চর্যাপদ থেকে শুরু করে দ্বিজদাস পর্যন্ত নির্বাচিত বেশ কিছু গান নিয়ে বাংলাগানের ধারাবাহিকতার একটি সাংগীতিক পরিবেশনা দাঁড় করিয়েছিলেন। হাজার বছর আগে চর্যার পদ গুলো কিভাবে গাওয়া হতো সে তথ্য আমার জানা নাই, কিন্তু কফিল আহমেদ সেটাকে তার সুরে আমাদের সামনে হাজির করলেন। যে কাজটিকে শুধু যথার্থ বললে কম বলা হবে। কফিল আহমেদ যখন আপন সুরে গাইতে থাকেন-
‘ভাব হয়না, অভাব যায় না, এই তত্ত্বে কি জ্ঞান পাবো?’
তখন মনে হতে থাকে হাজার বছরের পুরোনো কথা নয়, এ যেনো সমকালেরই সুর। চর্যার এই নতুন চর্চা নিঃসন্দেহে কফিল আহমেদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কিন্তু আফসোসের বিষয় যার পরিবেশনা অধিকাংশ শ্রোতারই শোনার সুযোগ ঘটেনি। কফিল আহমেদ করিমগঞ্জে এই স্ক্রিপ্ট নিয়ে গানের সংঘ গড়ে তুলেছিলেন, যেমনটা গড়ে তুলেছিলেন নারায়ণগঞ্জে আমাদের নিয়েও। পরবর্তী বেশ কয়েক বছর মোশরফা মিশুর নেতৃত্বে প্রত্যক্ষ শ্রমিক রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়লে ব্যস্ততা বেড়ে যায় রাজনৈতিক কাজে। এমনকি কিছুদিন জেলও খেটেছেন গার্মেন্টস শ্রমিকদের দাবি আদায়ের আন্দোলন করতে যেয়ে। সেই সময় গড়ে তুলেছিলেন ‘মাতৃধারা’ সাংস্কৃতিক সংগঠন, আয়োজন করেছিলেন ‘তারুন্য-তাড়ণার গান’। এই সময়টাতে জন্ম নিয়েছে তার অসংখ্য গান। কিন্তু হাজার বছরের বাংলাগানের স্ক্রিপ্ট নিয়ে কাজ করবার মতো সুযোগ বা সংঘ আর হয়ে উঠেনি। তার সেই সময়টার স্পষ্ট ছাপ পাওয়া যাবে ‘আমারে তালাবদ্ধ রেখে’, ‘শূন্যে জামা উড়ে গেছে’ অথবা পরীবাগ বস্তি উচ্ছেদের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলাকালীন সময়ে জন্ম নেয়া গান-
‘বাংলার আকাশে উড়ে যাওয়া জেট-জঙ্গীর দিকে
ছুঁড়ে মারছি আ…
দাউ দাউ করা সারাটা দুপুরে বস্তিতে পোড়া আ’।
সেই সময় গ্রীন রোডের পার্টি অফিসেই ফ্লোরে বিছানা পেতে ঘুমাতেন তিনি। আমরাও মাঝে মাঝে থাকতাম মূলত কফিল ভাইয়ের সংগ পেতে। সেই সময় গুলোতে খুব কাছ থেকে দেখেছি একজন রাজপথের শ্লোগানের মতো মানুষকে, হাওড়ের থৈথৈ জলের মতো মানুষকে, একটা প্রবীন বটের মাটির গভীরে প্রোথিত শক্ত শিকড়ের মতো মানুষকে, যার টান টান সীনার ভিতর থেকে জন্ম নিচ্ছে নতুন যুগের বাংলাগান। যে গান ‘একটা ঘাড় ভাঙ্গা ঘোড়ার’ উঠে দাঁড়ানোর মতো আমাদের দাঁড়াতে শিখায়, যে গান ‘একটা পাখ ভাঙ্গা পাখির’ উড়াল দেবার মতো আমাদেরও উড়তে শিখালো।
কফিল আহমেদের আগমণের আগ পর্যন্ত মধ্যবিত্তের বাংলা গানের কেন্দ্রে ছিলো মানুষ, অর্থাৎ সে নিজে। সেই সাহেবী আলোকায়নের যুগ থেকে শুরু করে ক্রমবিকাশমান ব্যান্ড সংগীতের ধারা পর্যন্ত মধ্যবিত্ত মনোজগতের বর্ণিলাতাকে সুরের ক্যানভাসে এঁকে চলেছে যে সংগীত, তার নায়ক প্রধানত মধ্যবিত্ত মানুষ। সেই মধ্যবিত্ত মানসের বহু বাঁক, বহু রাগ, পাওয়া না পাওয়ার জ¦র, দেহ মনের বিপ্রতীপ দোলাচল কতো কতো ভঙ্গিতে প্রকাশিত হয়ে চলেছে বাংলাগানে। কিন্তু সেখানে মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণের আনন্দ বেদনার ছবি কই? একটা গুলি বিদ্ধ বাঘের যন্ত্রণার আর্তিটা কই, গরুর বুকে মাঠের হাহাকার কই? আছে, বহু গানেই প্রাণ-প্রকৃতি আছে, তবে সে মানুষের জন্য উপমা হয়ে, তুমি পাখির মতো, আমি নদীর মতো। অথবা প্রকৃতির সাথে মানুষের কথা বলার চেষ্টাও আছে,‘ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে..’। কিন্তু এই সকল চেষ্টাতেই কর্তাসত্তাটি মানুষ। মানুষের কল্যাণ বোধের জায়গা থেকে প্রকৃতির মঙ্গল-অমঙ্গল নির্ধারণ করা, মানুষের চোখে প্রকৃতির সুন্দর অসুন্দর নির্ধারণ করা। সেই চৈতন্যে প্রকৃতির কোনো অংশগ্রহণ নাই, প্রকৃতি যেনো শুধু মনোবাঞ্ছা পুরণের এক উপাদান মাত্র। কিন্তু লোকগানে, রূপকথা, কিচ্ছায় প্রাণ-প্রকৃতি কিন্তু সক্রিয় সত্তা। রূপকথার বাঘেরা, পাখিরা, গাছেরা নদীরা কথা বলে মানুষের সাথে। কিন্তু সে কথা মানুষের মতো। তবু তারা কথা বলেতো! সে সকল রূপকথা, উপকথায় অন্তত প্রকৃতির সাথে মানুষের সহাবস্থানের, বন্ধুত্বের আঁচটুকু পাওয়া যেতো। কিন্তু ‘আধুনিক’ মানুষ, প্রযুক্তির শৃঙ্খলে আবদ্ধ মানুষ, তার মনের কথা বন্ধুর কাছে পৌঁছে দেবার জন্য আর হীরামন পাখির দারস্থ হয় না। অথচ এতো এতো মোবাইল ইন্টারনেট, প্রগতির গতি মনের কথা পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হচ্ছে তবে কেন? এতো এতো ভোগ, তাই বুঝি এতো এতো রোগ! ‘আধুনিক’ মানুষ প্রকৃতিকে জয় করতে চেয়েছে, শাসন করতে চেয়েছে, গড়ে তুলেছে প্রকৃতি বিরুদ্ধ এক নগর-সমাজ। তবু কিছুতেই সে তার শান্তি খুঁজে পেলোনা। শত বছরের ‘প্রগতির’ দৌড়ে কেবলই ক্লান্ত হলো মানুষ। দুনিয়া জোড়া সেই মানুষদের অনেকেই এখন ‘আধুনিক’ ‘প্রগতি’ ‘উন্নয়নের’ নামে প্রকৃতি বিরুদ্ধ কর্মযজ্ঞকে চ্যালেঞ্জ করছেন, প্রকৃতিকে নতুন করে পাঠ করবার চেষ্টা করছেন। জাপানে মাসানবু ফুকোওকার মতো কৃষিচিন্তাবিদ জন্ম নিয়েছেন। আর এই সকল প্রবণতা, প্রচেষ্টার মধ্যদিয়ে ধীরে ধীরে জেগে উঠছে সর্বপ্রাণবোধ। বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের একাংশের মাঝে হলেও সেই বোধ জাগরণের অগ্রপথিক হয়ে থাকবেন কফিল আহমেদ, কফিল আহমেদের গান। নব্বই দশকের শেষভাগ থেকে আজো অবধি এ লড়াই জারি রেখেছেন তিনি।
‘হরিণেরা কি জানে? ভালোবাসি তোমারে!
হনুমানে কি জানে? ভালোবাসি তোমারে!’
তোমারে যে ভালোবাসি, সে কথা হরিণ, হনুমানেরও জানতে হবে কেন? কফিল আহমেদ তার ভালোবাসার কথা হরিণ, হনুমানেরেও জানাতে চান। ভালোবাসার সম্পর্কটা এমনি হবার কথা ছিলো চারাচরের সর্বপ্রাণের। এমন আত্মীয়তার, বন্ধুত্বের সম্পর্ক হলে পরেইতো পৃথিবী আরো সুন্দর। যে পৃথিবী যুদ্ধের রোষানলে, ‘উন্নয়নের’ ডামাঢোলে হঠাৎ বিবর্ণ, তাকে ‘আরো সুন্দর পৃথিবী, আবার জাগাবো জাগাবোই’ বলে দৃঢ়তা প্রকাশ করেন কফিল আহমেদ। কিন্তু মানুষ হরিণের বন্দি দশার খবর না রেখে কি করে এই পৃথিবীকে আবার জাগাবে? তাই আমাদের ভালোবাসার খবর যেমনি হরিণ, হনুমানকে জানতে হবে, তেমনি আমাদেরও জানতে হবে কেন কোন প্রয়োজনে চিড়িয়াখানায় বন্দি হয়ে আছে সোনালী হরিণ! কসাইখানার বাছুরের শেষ হাম্বা ডাকের করুণ আর্তি পৌঁছাতে হবে আমাদের চৈতন্যে। একে অন্যের বেদনায়-শোকে, শক্তিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়াতো সর্বপ্রাণ বোধের জাগরণ।
কফিল আহমেদের গানে একটা পাতা কিংবা পাখি, ঝড় কিংবা ঘর, রাখাল, গরু, মাঠ, ঘাস সবাই জীবন্ত সতন্ত্র সত্তা। তারা সবাই যার যার বেদনার কথা, হাহাকারের কথা বলতে সক্ষম। প্রকৃতির সকল প্রাণের সাথে মানুষের গান সমগীতের সুরে বাঁধা। কেউ কারো কর্তা বা প্রভুসত্তা নয়। কফিল আহমেদের গানে প্রকৃতি তাই কোনো উপমা হিসেবে আসেনা, আসে সতন্ত্র চরিত্র হিসেবে।
‘… পাখি গাইলো, আমার মা… কা… কা…
আমাকে পাঠিয়েছে তোমার কাছে
এখন তুমি কি করবে, কি করবে, বলো পৃথিবী?
বলি, রূপকথাটা ছড়িয়ে দিলাম চোখের সামনে
একটা ঘাড়ভাঙা ঘোড়া উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখভাঙা পাখি উড়াল দিলো’
তিনি যখন গান করেন তাকেই মনে হয় একটা ছোটো ফুল, অথবা গরু, একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া কিংবা কোনো গুলিবিদ্ধ বাঘ। অর্থাৎ গান গাইবার সময় কফিল আহমেদ সেই চরিত্রে রূপান্তরিত হয়ে যান। কিন্তু যখন একটা ঘাসফড়িং পাখির ঠোঁটে ছটফট করছে?
‘…একটা পাখি এসে, ছোঁ মেরে ছিঁড়ে নিলো
ঘাসফড়িংয়ের চোখটা
কবি,কবি? তুমি দেখেছো কি?
এমনই ছিলো, এমনিতো ছিলো সকালের শুরুটা…’
কবি কফিল আহমেদ তখন কোন চরিত্রকে নিজের মাঝে ধারণ করবেন, প্রকাশ করবেন? উত্তরে কফিল আহমেদ বলবেন, ‘তখন আমি ঘাসফড়িংটার পক্ষে, তার সাথে আমি আছি। আবার একটা পাখির গলায় যখন ফাঁস লেগে যায় তখন আমি পাখিটার জন্য গান গাই। একই মানুষ আমি, যখন যে নির্যাতিত হচ্ছে, আহত হচ্ছে, তার বাঁচার সংগ্রামের পক্ষে আমি। ইতিহাসবিদের সাথে একজন বোধসম্পন্ন কবি, শিল্পীর তফাত এইখানেই। ইতিহাসবিধ খনার জিহŸা কাটার ইতিহাস বর্ণনা করতে পারেন। কিন্তু একজন বোধসম্পন্ন শিল্পী জিহŸা কাটার পর খনার যে দু:সহ যন্ত্রণা, সেটাকেও টের পান। সেই যন্ত্রণাকে অনুভব করতে পারা, শুধু অনুভব নয় তাকে তীব্র ভাবে প্রকাশ করতে পারাটাইতো বোধসম্পন্ন শিল্পীর কাজ।’
৩.
কফিল আহমেদ সারাজীবন মূলত তারুণ্যের সংগ করেছেন। জেগেছেন তরুনদের সাথে, জাগিয়েছেন তারুণ্যের শক্তিকে। তার নেতৃত্বে অসংখ্য সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামে, গানের মিছিলে কাঁধে কাঁধ রেখে কন্ঠ মিলিয়েছি আমরা। কফিল আহমেদের নেতৃত্বে আমাদের সম্মিলিত সংগ্রামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ ছিলো, ‘সর্বপ্রাণ সাংস্কৃতিক শক্তি’ নামে যৌথ সাংস্কৃতিক প্লাটফর্ম গড়ে তোলা। সুন্দরবনের রামপালে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রতিবাদে ‘সর্বপ্রাণ সাংস্কৃতিক শক্তি’ থেকে অসংখ্য কর্মসূচি পালন করা হয়। সেই সময় গান-নাটকসহ বিভিন্ন মাধ্যমের ৩০ থেকে ৩৫টি সাংস্কৃতিক সংগঠন যুক্ত হয়েছিলো এই প্লাটফর্মে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যখন সরকারের সাংস্কৃতিক মুখোপাত্রে রূপান্তরিত হয়ে পড়েছে, তখন প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার দাবিতে, সুন্দরবনের পাশে দাঁড়াতে ‘সর্বপ্রাণ সাংস্কৃতিক শক্তি’র ডাকে রাজপথে, গানের মিছিলে জড়ো হয়েছিলো অসংখ্য তরুণ সাংস্কৃতিক কর্মী বন্ধুরা। আর সেই যৌথ মেলবন্ধনের প্রাণ ভ্রোমরা ছিলেন কফিল আহমেদ। তার নেতৃত্ব ছাড়া এই সম্মিলন অসম্ভব ছিলো। কেননা তিনিই তরুনদের মাঝে সবচাইতে গ্রহণীয়, শ্রদ্ধেয়, ভালোবাসার মানুষ। কেবল ব্যক্তি কফিল আহমেদের ডাকেই সকলে জড়ো হয়েছে, এমনটা বললে খন্ডিত সত্য বলা হবে। ডাকের ভাষাটাই ছিলো প্রধান। ‘সর্বপ্রাণ সাংস্কৃতিক শক্তি’ নতুন ভাষায় সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের ডাক। যে ডাকে সুন্দরবন একটি সক্রিয় সত্তা, আমরা তার উদ্ধারকর্তা নই। তাইতো আমাদের সাংস্কৃতিক সমাবেশের শিরোনাম হয়, ‘সুন্দরবনের পাশে’। অর্থাৎ সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি তার নিজের বাঁচার লড়াইতো করেই যাচ্ছে, আমরা তার এই লড়াইয়ের সহোদর হতে চাই। রাষ্ট্র যে মৃত্যুদন্ড চাপিয়ে দিচ্ছে সুন্দরবনের উপর, আমরা তার বিরুদ্ধে সুন্দরবনকে সাথে নিয়েই লড়াইটা চালিয়ে যাবো। আর সে লড়াই কেবল মাত্র একটা বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনকে প্রতিহত করার নয়, প্রাণ-প্রকৃতিকে রাষ্ট্রীয় ‘সম্পদ’ গন্যের যে দৃষ্টি, সর্বপ্রাণের অস্তিত্বকে অস্বিকার, বিনাশ করে ‘উন্নয়নের’ যে দর্শন তার বিরুদ্ধে সর্বপ্রাণের লড়াই একটি চলমান প্রক্রিয়া। মনে পরে, ট্রেডিশনাল বামপন্থী আন্দোলনও প্রাণ-প্রকৃতিকে রাষ্ট্রীয় ‘সম্পদ’ গন্যের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেড়িয়ে আসতে পারছিলোনা। ‘সম্পদ’ ধারণার সাথেতো বানিজ্যের সম্পর্ক, সহাবস্থান নয়, প্রকৃতির উপর আধিপত্য বিস্তারের সম্পর্ক! আর আধিপত্য বিস্তার করে যে প্রকৃতির মন জয় করা যায় না, করোনাকালেও কি আমাদের সেই শিক্ষা হয়নি? ফুলবাড়িতে যখন ‘উন্মুক্ত নয়, রফতানি নয়, বিদেশী নয়’ ¯েøাগান চলছে, তখন কফিল আহমেদসহ কেউ কেউ বলছেন, কয়লা উত্তোলনই নয়। ‘উন্নয়নকে’ জীবাশ্ম জ¦ালানির বিকল্প পথে হাঁটতে হবে। উন্নয়নের দোহাই দিয়ে পৃথিবীকে তিলে তিলে ধ্বংসের পথে আর ঠেলে দেয়া যাবে না। তাইতো যখন চা বাগানের ফসলি জমি দখল করে ইকোনোমিক জোন নির্মাণের পায়তারা উঠে, কফিল আহমেদ তখন সর্বপ্রাণ সাংস্কৃতিক শক্তির প্রতিবাদী অনুষ্ঠানে ¯েøাগান তোলেন, ‘যে মুখে ফসল পণ্য নয়’। যে মুখে ফসল পণ্য হতে পারে না, মানুষের শ্রমের প্রতিদানে প্রকৃতির উপহার হয়ে আসে, সেই মানুষদের প্রাণের পরবে মিলিত হয়েছিলাম আমরা মৌলভীবাজারের চাঁনপুর চা বাগানে। হাজার হাজার মানুষের মিছিলে ভুমি রক্ষার আন্দোলনে মিলিত হয়েছিলাম সর্বপ্রাণ সাংস্কৃতিক শক্তির সকল বন্ধুরা। গানের মিছিলে আমরাও প্রতিজ্ঞা করেছিলাম কফিল আহমেদের সাথে-
‘প্রাণে প্রাণ মিলাবোই, বলে রাখি’
সর্বপ্রাণের সাথে আমাদের প্রাণ মেলাবার এই লড়াইয়ে কফিল আহমেদ এক প্রবহমান নদীর নাম। যে নদীর গন্তব্য মহাপ্রাণের মিলন সাগর। সেই নদীর স্রোতে আমরাও অবারিত ঢেউয়ের মতো বয়ে যেতে চাই, অনন্ত। কফিল আহমেদ সেই মহাসৃষ্টির সহোদর, সহোদরা জ¦লন্ত অগ্নি। সেই অগ্নি চেতানায় শান দিতে দিতেইতো আমাদের গান গাওয়া, একসাথে পথ চলা।

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top