একটি বন্য স্বপ্নের অন্ধ যাত্রা ( ১৪ম পর্ব) // নীলিম কুমার II অসমিয়া থেকে অনুবাদ: বাসুদেব দাস

(৩১)

বরুণ সত্যিই খুব ভাগ্যবান ছিল।

আর সত্যিই পৃথিবী নিশ্চয় বিশাল এবং উদার ছিল, কেননা ছয়টা ছেলে মেয়ে থাকার পরেও বিপত্নীক বরুণের সঙ্গে বিয়ে বসতে মেয়ের অভাব হল না।

গোলমুখের সেই মেয়েটি, শশী রাহুলকে একজন ফর্সা মা এনে দেবার জন্য বাবাকে বলার মতোই মেয়েটি ধবধবে ফর্সা– যার চোখে পৃথিবীটাকে আঁকড়ে নেবার আগ্রহের কোনো চিহ্ন ছিল না, নির্বিবাদ সত্যের আভাস থাকা একটি পবিত্র মুখ ছিল সেই মেয়েটির। সেই মুখ ছিল সরলতার আলোতে স্নিগ্ধ এবং লাজুক।

আনন্দ এবং বেদনার উৎসব ছিল।

সবচেয়ে আনন্দিত ছিল রাহুল।সে তার মাকে ফিরে পাবে। তার শরীরে যেন পাখা গজিয়ে ছিল। কী বলবে সে তার মাকে! সে তার নতুন মাকে চুমু খেতে পারবে? মা তারা হাত ধরে ম্যাজিক দেখাবে কি? নতুন মা তাকে গল্প বলবে কি? স্নান করিয়ে দেবে? নতুন মা স্নান করিয়ে দিলে সে আর কাঁদবেনা? সে সঞ্চিত করে রাখা সমস্ত সম্পদ মাকে দিয়ে দেবে– একটি সুন্দর কাঁচের টুকরো এবং পৃথিবীর সবচেয়ে মসৃণ দুটো ছোটো পাথর, ভেলভেটের এক টুকরো কাপড়। সে সমস্ত কিছুই তার মাকে দিয়ে দেবে।

এই সমস্ত কিছুই তার সম্পদ–যারা সবার অজান্তে তাকে ভালোবাসত! হ্যাঁ ভালোবাসত– ভেলভেটেড কাপড়ের টুকরো সে গালে লাগালে ভেলভেট তাকে আদর করত! পাথর দুটো তার ঠোঁটে লাগালে– হ্যাঁ পাথর দুটো তাকে শীতল স্পর্শের মাধ্যমে আদর করত। আর পারফিউমের ছোট্ট বোতলটির গায়ে অজস্র কাটা দাগ, সেটা সে আদর করে তার বুকে কখনও চেপে ধরত। তখন সেই বোতলটি যেন তাকে রাহুল রাহুল বলে ডাকত। তাকে আদর করা এই বস্তুগুলি সে তার মাকে দিয়ে দেবে! সে অধৈর্য হয়ে পড়ল তার নতুন মায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য।

তজো এবং সদা দুজনে রাহুলদের বাড়ির সামনে একত্রে দুটো কলা গাছের চারা পুঁতেছিল। ধানের খড়ের রশি টেনে তাতে আম পাতা শলা দিয়ে ফুটো করে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। তার নিচ দিয়ে একজন মহিলা হাতে কলস নিয়ে বিছন্নলার পারে গিয়েছিল। তারা উলু দিচ্ছিল, গান গাইছিল না। এই বিয়ে সাধারণভাবেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

রাষ্ট্রভাষা প্রচার সমিতির হিন্দি শিক্ষক জগদীশ গোস্বামী এসেছিলেন, ধুতিটা গুঁজে নিয়ে তিনি এদিক থেকে ওদিকে দ্রুত আসা যাওয়া করছিলেন এবং টিকেন মাস্টারের চলাফেরা ছিল সবচেয়ে মন্থর। তিনি যেন হাঁটতে লজ্জা পাচ্ছিলেন এবং ইচ্ছা অনিচ্ছার অনেক লোকের আগমন বরুণের দ্বিতীয় বিবাহস্থলকে ভারী করে তুলেছিল। গজেন্দ্রনাথ ব্যস্ত ছিলেন গিরীন পুরোহিতের সঙ্গে। আর অমৃতপ্রভা তরুণী পিসির সঙ্গে। সেদিন তরুণী পিসি বড়ো অবোঝ হয়ে পড়েছিলেন। অমৃতপ্রভা বড়ো বিপদে পড়েছিলেন। তরুণী পিসি বি বি বি বলে মুখ দিয়ে অদ্ভুত উচ্চারণ করে বিয়ে শব্দটি বলতে চেষ্টা করছিলেন আর বলতে না পেরে তরুণী পিসির খুব রাগ হয়েছিল। অমৃতপ্রভাও বিয়েতে লেগে থাকার চেয়ে তরুণী পিসির সঙ্গে থাকাটাতেই স্বস্তি অনুভব করছিলেন কারণ এই উৎসবে সবচেয়ে দুঃখী ছিলেন অমৃতপ্রভা।

দাড়ি কামিয়ে চুল আঁচড়ে পার্টির পাঞ্জাবি এবং সাদা ফাইন ধুতি পরে , মুখে বসন্ত মালতী মেখে বরের সাজে বরুণ উৎসবের বিকেলে সপ্রতিভ হয়ে উঠেছিল। বন্ধু মালচন্দ আগরওয়ালা বরুনের আশেপাশে ছিল। মালচন্দ আগরওয়ালার হাতে একটা চামড়ার কভারে থাকা রেডিও ছিল । সেই সময় রেডিও থাকা মানুষ আঙ্গুলের কর গুণে বলা যেত । বরুণদেরও কোনো রেডিও ছিল না।

বিকেলে মালচন্দ আগরওয়ালা রেডিওটা ফুল ভলিউমে বাজিয়েছিল। প্রত্যেকেই রেডিওটার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল। মানুষগুলিকে রেডিওটার দিকে তাকিয়ে থাকতে মালচন্দ দেখেছিলেন। মালচন্দের ওপরের পাটির দাঁত গুলির মধ্যে একটা সোনার দাঁত ছিল । কয়েকজন সোনার দাঁতটাও দেখতে পেয়েছিল। মালচন্দ রেডিওটা প্রায় কাঁধের ওপরে তুলে ধরেছিল যাতে রেডিওটা থেকে বেরিয়ে আসা গানগুলি মানুষের গায়ে ধাক্কা না খায়!

রেডিওতে হিন্দি গান বাজছিল। একটা বাস এসেছিল। বাসটার ড্রাইভার এবং সহকারীর সঙ্গে বাসটাও হিন্দি গান শুনছিল। বরের সঙ্গে যাওয়া মানুষে বাসটা ভর্তি হয়ে গিয়েছিল।

রাহুল নীপা এবং মালা পিসির মেয়ে হিমানী, ও নীপার সমবয়সী– ওরা কাঁদছিল, ওরাও বরের সঙ্গে যাবার জন্য বায়না ধরেছিল। নীপা এবং হিমানীর চোখের জলে ফ্রক ভিজে গিয়েছিল আর রাহুলের শার্ট এবং হাফ প্যান্ট চোখের জলে ভিজেছিল। ওরা বাসের গায়ে হেলান দিয়ে কাঁদছিল। লোকেরা ওদের দেখে মজা পাচ্ছিল। কেউ একজন অন্য একজনকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ওরা কেন এভাবে কাঁদছে?’

কেউ একজন উত্তর দিয়েছিল,’বাপের বিয়ে দেখতে যেতে চাইছে, যেতে দিচ্ছে না বলে কাঁদছে।’

মালিনী দিদি, নীপা এবং হিমানীকে কোনো মতে বুঝিয়ে সুজিয়ে বাসটার  কাছ থেকে সরিয়ে নিয়েছিল। মালিনী দিদি ওদের কনে আসার পরে কনে রেখে আসার সময় সঙ্গে নিয়ে যাবে বলে অশ্বাস দিয়েছিল।

কিন্তু রাহুল?

কোনো কিছুতেই সে হার মনছিল না। তার মাথার ভেতরের অন্ধকার খোড়লে থাকা শয়তানের পোকাটা জাগ্রত হয়ে উঠেছিল। সে যাবেই। বাসের হ্যান্ডেলটা খামচে ধরে চোখের জলে ভিজতে ভিজতে সে দাঁড়িয়ে রইল।

সবাই তাকে বলছিল,’ বাবার বিয়ে দেখা উচিত নয়,পাপ। সে কিন্তু আজ সেটা যদি পাপ, সেই পাপকে ভয় করি না বলে পাপ করতে চাইছিল। সে বুঝেছিল এটা কীভাবে পাপ? এতো দেখছি অন্যায়। তাকে বরের সঙ্গে না নিয়ে যাওয়াটা, তাকে তার নতুন মায়ের কাছে যেতে না দেওয়াটা দেখছি এই মানুষগুলি তার প্রতি করা চরম অন্যায়!

সে ভাবছিল যে সেই ঘরে মাকে বলে যাওয়া’ ফর্সা মাকে’ আনার কথা বলেছিল। মায়ের সেই ইচ্ছার কথা সে প্রকাশ না করলে এই বিয়ে হত কি? এখন তোমরা বিয়ের আয়োজন করলে আর আমাকে ভুলে গেলে? এভাবে ভাবতে ভাবতে চরম দুঃখে রাহুল কাঁদছিল। সে ভাবছিল বাবার অন্তত তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত ছিল। লোকেরা যে বলে পাপ। বাবার বিয়ে দেখাটা পাপ।কীভাবে পাপ হতে পারে?

এমনকি গজেন্দ্রনাথও বলছে, পাপ।আজ গজেন্দ্রনাথও রাহুলকে না বোঝা হয়ে গেল।আজ কেউ রাহুলকে বুঝতে চাইছে না।তার বুকে শোক উথলে উঠল।সত্যিই সেদিন রাহুলের চোখের জলকে সমর্থন করার কেউ ছিল না।‘এত অন্যায় এত অন্যায় ‘বলে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করল রাহুলের।

ঠাকুরঘরে গিয়ে তার ঠকুরকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছা হল,’আমি বরের সঙ্গে যাওয়াটা কি পাপ?

কিন্তু সে দুটো কলা গাছের চারা সামনে বেঁধে’ বিয়ে যাত্রী’ বলে লেখা একটা কাগজ সামনের গ্লাসে আঠা লাগিয়ে রাখা বাসটার সামনে থেকে সরে এল না। তার ভয়, একটু সরে এলেই যেন বাসটা চলে যাবে। শয়তানের পোকাটার নির্দেশে সে বাসের পেছন দিকে থাকা দরজার হেন্ডেলটা খামচে ধরে রইল। তার মনের ইচ্ছা, তার সিটের প্রয়োজন নেই; বাসের ভেতরে কোথাও একটু দাঁড়াতে পারলেই হল। সে যে বাসের ভেতরে রয়েছে সে কথা কেউ লক্ষ্য না করলেই হল। সে কাউকে বিরক্ত করবে না। লোকেরা তাকে ঠেলা ধাক্কা দিয়ে পা মারিয়ে গেলেও সে বিন্দুমাত্র  উঃ আঃ করবে না। তাকে কেবল তার আত্মাকে মায়ের কাছে নিয়ে যেতে দাও।

এই সময় মালচন্দ আগরওয়ালা এসে তাকে বাসের কাছ থেকে  কোলে তুলে নিল এবং হাতে একটা টাকা দিয়ে বলল–’ চকলেট খাবি, কাঁদিস না। এই বলে মালচন্দ তাকে পেছনের উঠোনের দিকে নিয়ে গেল। পেছনের উঠোন  থেকে দেখতে পাওয়া সুপুরি গাছের বাগানটা তখন অন্ধকারে ডুবে ছিল । বাগানটা কারও কান্না শুনছিল না।

মালচন্দ আগারওয়ালার সোনার দাঁতটা রাহুল খুব কাছ থেকে দেখতে পেল। মালচন্দের হাতে রেডিওটা তখনও বাজছিল। রাহুল আঙ্গুল দিয়ে রেডিওটা ছুঁয়ে দেখল এবং রেডিওটাতে  আস্তে করে কানটা লাগিয়ে দিল। শয়তানের পোকাটা সঙ্গে সঙ্গে শান্ত হয়ে পড়ল।

মালচন্দ রাহুলকে গজেন্দ্রনাথের হাতে সঁপে দিয়ে ইতিমধ্যে স্টার্ট দেওয়া’ বিয়াযাত্রী’ বাসটায় উঠল। গলায় তুলসির মালা এবং বগলে মনেট পারফিউম লাগিয়ে বরুণ ইতিমধ্যে বাসে বসেছিল। মালচন্দ বরুণের পাশের সিটে বসল।

রেডিওতে হিন্দি গান বেজে উঠল–’ চলতে চলতে এহি কোই মিল গয়া থা…’। তখনকার সময় অসমিয়া গানের খুব অভাব ছিল। অসমিয়া গান ছিলই বা কয়টা! রেডিওতে শোনা হিন্দি গান মানুষের হৃদয় অধিকার করেছিল।

সেই মালচন্দ আগরওয়ালাদের একটা ধানের মিল ছিল। মৃত প্রায় মিলটির চিমনির ওপরে একটা অশ্বত্থ গাছের চারা বাতাসের সঙ্গে খেলছিল। ধানের ব্যাবসা ছেড়ে এখন কাপড় এবং কয়লার ব্যাবসা করা মালচন্দ গান শুনতে খুব ভালোবাসত। কিন্তু তার বন্ধু বরুণ গান পছন্দ করত  না। গান পছন্দ করা মানুষকে তিনি দুর্বল মনের মানুষ বলে ভাবতেন।

(৩২)

বাসটা সকালবেলা ফিরে এসেছিল।

রাতে বোধহয় কুয়াশা পড়েছিল, কেননা বাসের সামনের গ্লাসে বিয়াযাত্রী বলে লেখা আঠা লাগিয়ে রাখা কাগজটার অক্ষরগুলি এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল যেন অক্ষর গুলি চোখের জল ফেলেছে। বাস থেকে নেমে মানুষগুলি যে যার বাড়িতে চলে গিয়েছিল। মালচন্দ আগরওয়ালাও চলে গিয়েছিলেন। রেডিওটা তখন নীরব ছিল।

রাহুল নামঘরের বারান্দা থেকে দেখছিল– দুটি ফ্রক পরা মেয়ে পাটের সাজ পরা কনেকে ধরে ধরে উঠোনের মধ্য দিয়ে নিয়ে আসছে। গজেন্দ্রনাথের ঘরে থাকা মহিলাদের মুখে মুখে ‘কনে এসেছে’, ‘কনে এসেছে’ শব্দ দুটি শোনা গেল। আর যে যেখানে ছিল সেখান থেকে প্রত্যেকে দীর্ঘ ঘোমটা নিয়ে থাকা কনের দিকে তাকাল। প্রত্যেকেই যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আঁটোসাটো শরীরের ঘোমটায় ঢাকা কনে শশীর মতো ক্ষীণ ছিল না। ঘোমটা থাকার জন্য রাহুল তার মায়ের মুখটা দেখতে পেল না।

কনেকে   শশী থাকা ঘরটাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মাটিতে একটা ধাড়ি  পেতে তার ওপর একটা তোষক এবং বিছানার চাদর পেতে সেখানে কনেকে বসতে দেওয়া হয়েছিল। শশী থাকতে যে জানালাটা চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়েছিল, সেই জানালাটা এখন খুলে দেওয়া হয়েছে। সেই জানালা দিয়ে সকালের সোনালি রোদ প্রবেশ করে কনের ঘোমটা এবং পাটের চাদরের ভাঁজে ভাঁজে পড়েছে। সেই রোদ পড়েছে ফ্রক পরা মেয়ে দুটির নাইলনের ফ্রকে। রাহুল শশীর গায়ে এত সুন্দর রোদ পড়তে কোনোদিন দেখেনি। আজ শশীর সেই স্যাঁতসেতে অন্ধকার ঘরের রূপই বদলে দিয়েছে রোদের আলো।

ঘোমটার নিচে কনে ছিল নীরব।

সে কোনো রকম নড়াচড়া করছিল না। রাহুল তার নতুন মায়ের মুখটা দেখার জন্য অধৈর্য হল। গতরাতে তার প্রতি সমগ্র পৃথিবী করা সীমাহীন অন্যায়ের পরে এখন সেই ক্ষণ  এসে উপস্থিত হয়েছে। তথাপি যেন বিলম্বের শেষ হয়নি। ঘোমটাটা বিলম্বের সঙ্গে রহস্যেরও জন্ম দিয়েছে। ফ্রক পরা মেয়ে দুটি তার দিকে তাকিয়ে একে অপরকে বলছে,’ এটাই বোধহয় বড়ো ছেলে!’

রাহুল ‘হ‍্যাঁ’ বলল না। অপরিচিত মেয়ের কথায় কেন সে সায় দেবে? সে মালা পিসির কাছে গেল এবং বলল, মাকে দেখব। মালা পিসি কনের কাছে তাকে নিয়ে এল এবং কনের শরীরে সামান্য ধাক্কা দিয়ে বলল–’ বউ, দেখি মুখটা একটু দেখাও তো, তোমাকে দেখতে এসেছে। ও হল রাহুল। কাল রাতে তোমাকে দেখতে যাবার জন্য কত যে কান্নাকাটি করেছিল…।’

ফ্রক পরা দুজন ঘোমটা তুলে কনের মুখটা রাহুলকে দেখিয়ে পুনরায় ঘোমটাটা  নামিয়ে দিল। এক মুহূর্তের জন্য রাহুল দেখল, একটি ফর্সা মুখ। নিস্পন্দ, নির্বিকার মুখ। সেই মুখের দিকে তার চেয়ে থাকতে ইচ্ছা হল। যে মুখ ঘোমটা দিয়ে ঢেকে রাখা হল।

মালা পিসি রাহুলকে বলল,’ তুই মায়ের কাছে বসে থাক।’

সে খুব খুশি হল। তার মুখে হাসি ফুটল। সে কনের কাছে বসে পড়ল। ফ্রক পরা মেয়ে দুটি তার দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসল। সেই দুজনকে কোনো কারণে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর মতো মনে হল। সে মায়ের চাদরের ভাঁজে পড়ে থাকা রোদের দিকে তাকিয়ে রইল। মায়ের হাতের আংটি দুটোর দিকে তাকাল। ঝুন ঝুন করা চুরি গুলোর দিকে তাকিয়ে রইল।

নীপা এবং হিমানী কিছুটা ইতস্তত করে রাহুলকে দেখতে এল। রাহুলের মুখে গর্ব ফুটে উঠল এই কারণেই যে সে কনের কাছে বসেছে।

কিন্তু রাহুলের সেই গর্ব নীপা এবং হিমানীর চাহনি ধূলিসাৎ  করে দিল। ওদের চাহনিতে এভাবে ঘৃণা ফুটে উঠল-ছিঃ তোর লজ্জা করছে না অপরিচিত দুটি মেয়ের সঙ্গে কনের কাছে বসে থাকতে? ছিঃ ছিঃ তোর একেবারে লজ্জা নেই।

ঘরের মহিলারা প্রত্যেকেই কনের কাছে একটা শান্ত ছেলের মতো বসে থাকা ভয়ানক দুষ্ট রাহুলকে  দেখে নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করতে লাগল, কীভাবে সৎ মায়ের কাছে রাহুল বসে আছে। প্রত্যেকেরই চোখে মুখে শোক এবং কৌতূহল ছড়িয়ে পড়ল। অমৃতপ্রভা পুনরায় একবার কেঁদে উঠল।

গজেন্দ্রনাথ ছিলেন নির্বিকার। তিনি যেন রাহুলকে সমর্থন করছিলেন। এবং শালগ্রাম ধোয়ানোর জন্য তুলসী এবং দুব্বো ছিঁড়ে ছিঁড়ে তার হাত শিশিরে ভিজেছিল। সেই শিশিরে ছিল পৃথিবীকে  সুন্দর করার ইচ্ছা।

গতরাতে, অর্থাৎ বরযাত্রী হতে না পারা রাতে তার প্রতি হওয়া চরম অন্যায়ের পরে আজ আবার রাহুল অপমানিত হল। তার নিচের মাতৃহীনা চার ভাই এবং ভানুর ছেলেমেয়েগুলিও কনের কাছে বসে থাকা রাহুলকে আশ্চর্য জিনিস দেখার মতো দেখতে লাগল। প্রত্যেকের চোখ মুখে যেন একটাই প্রশ্ন– রাহুল কেন পাল্টে গেল? চুল কামানোর পরে ছোটো ছোটো ঘাসের মতো গজিয়ে উঠা মাথাগুলির ভেতরে থাকা মগজ  দিয়ে রাহুলের ভাইরা ভাবল– আমাদের রাহুল দাদা আজ কেন আমাদের সঙ্গে খেল না ? কেন সে কনের কাছে বসে আছে ?

ওদের পরিচিত রাহুল আজ হঠাৎ অপরিচিত হয়ে পড়েছে। এই ঘোমটায় ঢাকা কনেটি যে ওদের মা হতে এসেছে, সে কথা হয়তো ওদের মগজে ঢোকেনি।

মালা পিসি একটা ট্রেতে তিন কাপ চা এবং তিনটি প্লেটে নিমকি এবং বুন্দিয়া ভুজিয়া নিয়ে এসে কনের সামনে রাখল এবং বলল–’ বৌ, চা খাও।’

মালা পিসি ফ্রক পরা দুজনকেও উদ্দেশ্য করে বলল,’ তোমরাও চা খেয়ে নাও। তোমাদের নাম কি?’

একজন বলল আমার নাম বীণা, ওর নাম নীরু ।’

মালা পিসি রাহুলকে কিছুই বলল না। তার জন্য মালা পিসি কোনো খাবার ও আনেনি। তথাপি রাহুল বসে রইল। অপমানের চেয়ে  সে তার নতুন মায়ের কাছে বসে থাকার সৌভাগ্যটাকে অনেক বেশি মূল্যবান বলে মনে করল।

কনে কনে নয় তার মা কিছুটা বুন্দিয়া -ভুজিয়া তুলে নিয়ে তার হাতে গুঁজে দিল। আস্তে করে বলল,’ খেয়ে নাও।’

সে সেটা মুখে দিল। কিন্তু সেটা কোনো সাধারণ বুন্দিয়া ভুজিয়া  ছিল না। তার এত স্বাদ লেগেছিল যে কোনোমতে আকাশে উড়ে যাওয়া থেকে নিজেকে সামলে ছিল। ফ্রক পরা মেয়ে দুটি না থাকলে সে হয়তো সত্যিই এই জানালা দিয়ে ডানা মেলে রোদের পারে পারে উড়ে যেত…

(৩৩)

রাহুল উড়ে গেল না,উঠে গেল।তার সর্বাঙ্গে নতুন মা দেওয়া বুন্দিয়া-ভুজিয়ার অমৃত স্বাদ ছড়িয়ে পড়েছিল।সে গিয়ে তার গোপন ভাণ্ডারে থাকা জিনিসগুলি বের করল।সেগুলির মাঝখান থেকে সে সারা শরীরে নক্সা কাটা পারফিউমের সুন্দর বোতলটা বের করল। একটা খালি বোতল।কিন্তু সেই খালি বোতলটার সুন্দর অতীতের গন্ধ তখনও বোতলটার ভেতরে উগ্র হয়ে ছিল।

সে তার মধ্যে জল ভর্তি করল এবং শুঁকে দেখল-জলেও গন্ধ করছে।কিন্তু জলের রঙটা তার ভালো লাগল না। সে কিছু একটা জল খুঁজে বেড়াল। জলটা রঙিণ করার জন্য রঙ? রঙ মানে রঙের উৎসব দোল পূর্ণিমা।তার সেই আবিরের কথা মনে পড়ল,একটা কাঠের বাক্সে থাকা নানা রঙের আবিরগুলির কথা।

বজালীর দোল উৎসবের রাধা-কৃ্ষ্ণের মূর্তিজোড়া থাকে গজেন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে রাহুলদের ঠাকুরঘরে।দৌল উৎসবের দিন সেই মূর্তি সিংহাসনসহ শোভাযাত্রা করে ব্যাণ্ডপার্টি বাজিয়ে সুর-সমলয় শুনতে শুনতে মানুষের শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে মাতালের নাচন কুদন দেখতে দেখতে রাহুলরা উঠোনে ফিরে আসে।সারা সিংহাসন আবিরে ভরে থাকে,রাধাকৃ্ষ্ণের সর্বাঙ্গ আবিরে পরিপূর্ণ হয়ে যায়।সেইসব আবির একটা বাক্সে রেখে দিয়ে আবিরের মাঝখান থেকে গজেন্দ্রনাথ রাধাকৃ্ষ্ণকে উদ্ধার করে।

রাহুল উঠে আবিরের বাক্সগুলোর নিচে গেল।কাঠের দরজা না থাকা আলমারিটার ওপরের খাপে থাকে বাক্সটা।সে কীভাবে নামাবে বাক্সটা!নাগাল পাবার মতো বড়ো হয়নি রাহুল।সে বড়ো সমস্যায় পড়ল।কিন্তু আশ্চর্য!তাকে কেউ তুলে ধরল এবং সে তৎক্ষণাৎ আলমারির র‍্যাকগুলির ওপরে পা রেখে ওপরে উঠে আবিরের বাক্সটার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিল এবং এক মুঠো গোলাপি রঙের আবির নিয়ে এল।মা রাহুলের হাতে গুঁজে দেওয়া সেই বুন্দিয়াগুলি প্রকৃ্তপক্ষে অমৃত হয়ে গিয়েছিল এবং সেই অমৃতের শক্তি রাহুলকে তুলে ধরেছিল,অন্য কেউ নয়।

রাহুল কিছুটা আবির পারফিউমের বোতলটার জলে মিশিয়ে নাড়িয়ে নিল।জলটা গোলাপি রঙের হয়ে উঠল।বোতলটার স্বচ্ছ খাঁজে খাঁজে গোলাপি ঝলমলিয়ে উঠল।রাহুল তার হাফ পেণ্টের পকেটে বোতলটা ঢুকিয়ে নিল এবং মায়ের কাছে গেল।

ফ্রক পরা দুজনের মাঝখানে মা সেভাবেই বসেছিল। সে গিয়ে আগের বসা জায়গাটায় বসে পড়ল। কিন্তু মাকে দেওয়ার জন্য আনা বোতলটা বের করতে তার খুব লজ্জা করতে লাগল। লজ্জায় সে ঘেমে গেল। কিন্তু জিনিসটা নতুন মাকে না দিয়ে সে থাকতেও পারছে না।

তখনই বরুণ ঘরে প্রবেশ করল। রাহুলকে কনের কাছে বসে থাকতে দেখে বরুণ বলল–’ ও তুই এখানেই বসে আছিস!’

রাহুল কোনো জবাব দিল না।

সে বুঝতে পারল, এখন তাকে এখান থেকে যেতে হবে। সে বরুণের অজান্তে পলকের মধ্যে তার প্যান্টের পকেট থেকে বোতলটা বের করে মায়ের হাতে গুঁজে দিল এবং লজ্জায় ঘর থেকে বেরিয়ে দৌড় লাগাল।সে বাগানের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বাঁশ গাছের নিচে থাকা উইয়ের ঢিবিটার কাছে গেল এবং পুরো দৃশ্যটা মনে করল। মায়ের সরল, মমতাময়ী মুখটা তাকে  বিরক্ত করতে লাগল।

রাহুলকে বাগানের দিকে যেতে দেখে তার ভাইগুলি এবং ভানুর ছেলে মেয়েরা বাগানের প্রান্তে থাকা উইয়ের ঢিবিটার কাছে গিয়ে পৌঁছাল। রাহুল ওদেরকে বোঝাল,’ তোরা কেন তখন এভাবে কনের কাছ থেকে চলে এসেছিলি? তিনি কনে নন, আমাদের নতুন মা। আমাদের মা মরে যাবার পরে মা এই নতুন মাকে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। এই মাও আমাদের আগের মায়ের মতোই। আগের মায়ের মতোই তিনি আমাদের ভালোবাসবেন, গল্প বলবেন, ম্যাজিক দেখাবেন– ম্যাজিক না দেখাতেও পারে– ম্যাজিক জানে কি জানে না। এই মাকেও আমরা মা বলে ডাকব। এই মাও আমাদের অনেক আদর করবে। কিছুক্ষণ আগে আমাকে ভুজিয়া বুন্দিয়া দিয়েছিল, তোদেরকেও দেবে। চল আমরা মায়ের কাছে যাই।’

কেউ একজন বলল ,আমি ম্যাজিক দেখব। অন্য কেউ একজন বলল, আমি বুন্দিয়া খাব।

রাহুল সদল বলে গিয়ে মা থাকা সেই ঘরে হাজির হল। ওরা দেখল, বাবা বরুণ তার আগের পালঙ্কে শুয়ে আছে। পাশে সেই ফ্রক পরা মেয়ে দুটি। আর ওদের নতুন মা আগের মতই মাটিতে পেতে রাখা ধাড়িতে ঘোমটা টেনে বসে আছে।

বরুণ ফ্রকপরা দুজনের একজন বীণার কোঁকড়া  চুলগুলির মধ্যে দিয়ে হাত বুলিয়ে খুব আদর করে দুজনের সঙ্গে কথা বলছিল। এত মিষ্টি কথা রাহুলরা বরুণের মুখে প্রথম শুনছিল। ওরা বরুনের ঘরের পর্দার গায়ে  গা লাগিয়ে বরুণ বীণা,নীরুকে এবং কনের বেশে থাকা মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল।

রাহুলদের দল বেঁধে ঘরে ঢুকতে দেখে বরুণ মুখ ভেঙচে বলে উঠল,’ তোরা কেন এই ঘরে এসেছিস? যা যা এখান থেকে এখনই যা।’

কিন্তু ওরা সরে এল না। বীণা এবং নীরুকে ওদের খুব ভাগ্যবান বলে মনে হল। সেই ভাগ্যবান দুজনের দিকে তাকিয়ে ওদের মন শান্ত হয়ে পড়ল।

ওদের মন শান্ত হয়েছিল আরও কিছু কারণে।বরুণের ঘর থেকে বেরোনো পারফিউমের সুগন্ধ, মশারির চারটে স্ট্যান্ড থেকে চন্দ্রাতপের মতো ঝুলতে থাকা বরুণের মশারিটার সাগর নীল রংটা এবং বরুণের সেই ছোট্ট টেবিলে থাকা হোমিওপ্যাথির ছোটো ছোটো বোতল গুলি, বসন্ত মালতীর বোতল এবং ভেসলিনের ডিবেটা, ছোটো সবুজ ফ্রেমের একটি আরশি , হ‍্যাঙ্গার  থেকে ঝুলতে থাকা একটি জহর কোট। এই অপরিচিতা কনেটিকেও ওদের বড়ো ভাগ্যবতী বলে মনে হল। কারণ কেউ না বললেও ওরা বুঝতে পেরেছিল এই নবাগতা বরুণের স্বর্গীয় ঘরের বাসিন্দা, ওদের মতো নরকের বাসিন্দা নয়।

বরুণ এবার গর্জন করে উঠল,’ তোদের কি চাই এখানে? যেতে বলেছি না। এক্ষুনি যা।’ রাহুলের পিটপিট করতে থাকা চোখ বরুণের চোখে নিবদ্ধ হতে পারল না। মন খারাপ করে ওরা ফিরে এল। ওদেরও একটি স্বর্গ ছিল গজেন্দ্রনাথের ধুতি কাশ- কোমল ভালোবাসার আঁচলে! ওরা সেই স্বর্গের দিকে চলে গেল।

একটি বন্য স্বপ্নের অন্ধ যাত্রা ( ১৩ম পর্ব) // নীলিম কুমার II অসমিয়া থেকে অনুবাদ: বাসুদেব দাস

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top