কালের সন্ততি : মানবিক ইতিবৃত্তের দলিল (পর্ব-৫) ।। এদুয়ার্দু গ্যালিয়ানো ।। অনুবাদ মুহম্মদ রফিকুল ইসলাম

এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানো (১৯৪০-২০১৫) উরুগুয়ের প্রখ্যাত লেখক, কবি ও সাংবাদিক। লাতিন আমেরিকার এই লেখকের মন-প্রাণ জুড়ে রয়েছে অফুরান ভালোবাসা ও বিস্ময়। ভালোবাসা মানুষের প্রতি আর বিস্ময় জীবনের। জীবনকেও ভালোবেসেছেন অন্তহীন কৌতূহলে, আনন্দে আর নিবেদনে। দেশ-কালের সীমানা পেরিয়ে মানুষের জন্য মানবতার জন্য নিবেদিত হয়েছে তাঁর সমস্ত সাহিত্যকর্ম, বক্তৃতা-ভাষণ, আন্দোলন প্রতিবাদ। নির্বাসনে থেকেছেন, মৃত্যুর পরোয়ানা পেয়েছেন একাধিকবার তবু থেমে যায়নি অদম্য এই প্রাণ ।

লাতিন আমেরিকার ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ নিয়ে লিখেছেন ‘ওপেন ভেইনস অব ল্যাটিন আমেরিকা’। তিনখন্ডে লিখিত মেমোরি অব ফায়ার’ আমেরিকা মহাদেশের আদিবাসী জীবন ও সংগ্রামের প্রাণবন্ত ইতিহাস। শিল্প-সাহিত্য ইতিহাস যুদ্ধ প্রতিরোধ স্বৈরশাসন বর্ণবাদ নারী-স্বাধীনতা প্রভৃতির অনবদ্য কাব্যিক উপস্থাপন তাঁর ‘ মিরর’ ‘চিলড্রেন অব দ্য ডেজ’ বই দুটি।

‘চিলড্রেন অব দ্য ডেজ’ ৩৬৫ দিনের দিনলিপি। জগতের কত অদ্ভূত ইতিহাসের কত অনন্য বিষয় নিয়েই-না তিনি লিখেছেন কিন্তু কী আশ্চর্য সবকিছুই মনে হয় আজকের – এই সময়ের – এই জীবনের আর কাঙ্ক্ষিত বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিবাদের।

– মুহম্মদ রফিকুল ইসলাম
———————-

মে ১
আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস

সম্মিলিত উড্ডয়নের মূলসূত্র খুঁজে পাওয়া যায় হংস বলাকার যূথবদ্ধ উড়ালে। প্রথম বলাকা উড়াল শুরু করে পথ করে দেয় অন্যের পক্ষ সঞ্চালনের। সে সহজ করে দেয় তৃতীয় বলাকার নিবিড় উড্ডয়ন। তৃতীয় হংস বলাকার নিপুণ নিয়ন্ত্রণ সাহায্য করে চতুর্থের দক্ষ উড়ালে। চতুর্থ নিয়ে আসে পঞ্চম বলাকার শক্তি। পঞ্চম জোগায় ষষ্ঠ বলাকার স্বতঃস্ফূর্ততা। ষষ্ঠের পর আসে সপ্তমের নেতৃত্ব, এরপর অষ্টম নবম – এভাবে চলতে থাকে পর্যায়ক্রমে।

সারি সারি হংস বলাকার অধিনায়ক নেতা শ্রান্তিবোধ করলে জায়গা ছেড়ে দেয় অন্যকে। সে তখন ‘V’ আকৃতির উড়ন্ত ঝাঁকের শীর্ষে চলে আসে। এরূপে চলতে থাকে নেতৃত্বের পালাবদল। কেউ এখানে স্থায়ী নেতা নয়, পারিবারিক নেতৃত্বের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এখানে অর্থহীন হাস্যকর। অথবা শীর্ষে আছে বলেই এখানে কেউ দলের পিতা, আর পেছনের সব শ্লোগানকর্মী আমজনতা – এ নিয়মও বলাকার জগতে অচল অকেজো!

মে ২
অপারেশন জেরোনিমো

ঊনবিংশ শতাব্দীর রেড ইন্ডিয়ান ‘অ্যাপাচি-প্রতিরোধে’র অন্যতম প্রভাবশালী নেতা জেরোনিমো। তিনি তাঁর অসামান্য সাহস ও বিচক্ষণতা দিয়ে আগ্রাসী শত্রুদের বেসামাল নাস্তানাবুদ করে ছাড়েন। তাঁর এই কুখ্যাত কীর্তি তাই হাওয়ার বেগে ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। আর বিংশ শতাব্দীতে তিনি অতিমাত্রায় অমানুষ এক চরিত্র হয়ে ওঠেন ওয়েস্টার্ন চলচ্চিত্রের রুপালি পর্দায় – হলিউডীয় উর্বর কল্পনায়।

প্রতিবাদীদের শায়েস্তা করতে আমেরিকা বরাবর তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। তারই ধারাবাহিকতায় শুরু করা ‘অপারেশন জেরোনিমো’ – ওসামা বিন লাদেন কে নিশ্চিহ্ন করার বিশেষ এই প্রচেষ্টা সফল হয় ২০১১ সালের এই দিনে।

কিন্তু বিন লাদেনের সাথে জেরোনিমোর কী সম্পর্ক থাকতে পারে- উর্বর মস্তিষ্কের আমেরিকান সেনাবাহিনীই কেবল এ-প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানে!

হতে পারে সুদূর অতীত থেকে জেরোনিমো বিন লাদেনকে আমেরিকার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছিলেন!

আমেরিকার চোখে লাদেন সন্ত্রাসী সেইসাথে জেরোনিমোও কারণ তিনি রেড ইন্ডিয়ানদের নিজস্ব ভূমি আর আত্মমর্যাদা রক্ষা করতে চেয়েছিলেন!

মে ৩
রীতিমতো অসম্মান

১৯৭৯ সালের শেষের দিকে সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তান আক্রমণ করে। প্রগতিশীল সরকারকে সমর্থন দিয়ে আধুনিক আফগানিস্তান গড়ার মহান উদ্দেশ্য নিয়ে তারা এই আক্রমণ করে!

১৯৮১ সালে, স্টকহোমে এক আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই আগ্রাসনের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ঘটনাচক্রে সেই ট্রাইব্যুনালের একজন সদস্য ছিলাম আমি। বিচারসভার সেইসব উত্তুঙ্গ মুহূর্তের কথা কখনোই ভুলতে পারব না!

ইসলামী মৌলবাদী দলের কয়েকজন মোল্লা যথারীতি সেদিন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। যাঁরা নিজেদের তখন মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচয় দিতেন আর আজ আমরা যাঁদের সন্ত্রাসী বলে জানি, তেমনি এক মোল্লা সেদিন চিৎকার করে যুক্তি দেখান, ‘ কমিউনিস্টরা আমার দেশের মা বোনেদের অসম্মান করেছে! ওদের লিখতে পড়তে শিখিয়েছে!‘

মে ৪
রাতের কল্লোলে

১৯৩৭ সালে নোয়েল রোসা মাত্র ২৬ বছর বয়সে মারা যান। রিও ডি জেনেরিও‘র সঙ্গীতে বুঁদ মধ্যরাতের ঘরকুনো এই শিল্পী কখনো সমুদ্র সৈকত দেখেননি, যদিও ঢেউয়ের শব্দ শোনা যায় ঘর থেকেই! শহরের বিভিন্ন পানশালার জন্য তিনি ‘সাম্বা‘ গান লিখতেন আর সুর করে নিজেই গাইতেন।

এমনই এক পানশালায় তাঁর এক বন্ধু আসেন শুনশান নীরব সকল দশটার দিকে। নোয়েল তখন গুনগুন করে নতুন-রচিত কোনো গান গাইছেন। তাঁর টেবিলে পরপর সাজানো দুটি বোতল – একটিতে বিয়ার অন্যটিতে সস্তা রাম। বন্ধু জানতেন যক্ষা রোগে শীঘ্রই মারা যাচ্ছেন সঙ্গীতে মগ্ন এই শিল্পী!

নোয়েল তাঁর বন্ধুর মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ দেখে আত্মপক্ষ সমর্থনের ছলে বিয়ারের গুণপনা করছেন, ‘ চিন্তা কোরো না, যেকোনো ভারী খাবারের চেয়ে বিয়ার ঢের ভালো – শতগুণ পুষ্টিকর‘

বন্ধু এই ব্যাখ্যায় আশ্বস্ত হতে পারলেন না; রামের বোতল দেখিয়ে বললেন, ‘তাহলে এটা কী?‘

নোয়েলের তাৎক্ষণিকজবাব, ‘ভারী খাবারের সাথে তো কিছু একটা লাগে, তাই না?‘

মে ৫
গান আমার স্লোগান দৃপ্ত প্রতিবাদ

১৯৩২ সালে নোয়েল রোসা তাঁর ‘ক্যুয়েস দ্য মাইস’ (কে বেশি দাম দেবে) সাম্বা গান রেকর্ড করেনঃ

“নিলামে তুলে কয় পয়সা পেল আজ?
সকলেই তারা গর্বিত ব্রাজিলিয়ান আর
নিলামে বিকিয়ে দেশ রাষ্ট্র ও সমাজ
সুধিলেন ঋণ তার অন্তহীন অপার!”

এই রচনার মাত্র বছরকয়েক পেরই এন্ড্রিকোলো আর্জেন্টিনার কুখ্যাতি গেয়ে তাঁর বিখ্যাত ট্র্যাঙ্গো ‘ক্যাম্বালাচে‘ (বিপনীবিতান) রেকর্ড করেনঃ

“আজ সবাই আমরা একজোট একাট্টা
যেন সব শেয়ালের একই রা
চিরসখা বন্ধু সকল আর ধূর্ত প্রতারক
প্রতিভার বরপুত্র অথবা গর্ধব ও চোরা
কিংবা ভদ্রসদ্র সুধীজন অলস কর্মহীনা
চলো সবাই ভাগ করে ভোগ করি
এই আর্জেন্টিনা”

মে ৬
যেমন চাঁদের বুকে শ্মশ্রুময় মুখ

শেয়ারবাজারে অকস্মাৎ দরপতনে সাংবাদিক জনাথন টিলোভের চাকরি চলে যায়।

কিন্তু ২০০৯ সালে ওয়াশিংটনে তাঁর অফিস সাফসুতরো করার সময় টেবিলে কপির পেয়ালায় কুমারী মেরির জ্বলজ্বলে ছবি দেখতে পান।
ভাগ্য তাঁর খুলে যায়!

অর্থনৈতিক সংকট যতই তীব্র হতে থাকে, মানুষ আস্থা হারাতে থাকে যৌক্তিক সব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে। অর্থনীতিবিদ রাজনৈতিক ও সাংবাদিকের কথায় কাজে কারো বিশ্বাস থাকে না, আস্থা থাকে না! আস্থা তখন অন্যত্র অন্য কোথাও!

তাই অনেকেই চিজ স্যান্ডউইচের কোমল জমিনে, অ্যাসপ্যারাগাস উদ্ভিদের পত্রপল্লবে, অথবা দাঁতের এক্স-রে ফলকে কুমারী মাতাকে দেখতে পান!

মে ৭
অনাড়ম্বর নেতৃত্ব

১৯৫৪ সালে ভিয়েতনামিজ বিদ্রোহীরা ফরাসি সেনাবাহিনীকে রীতিমতো নাজেহেল করে ছাড়ে। ফরাসিদের সর্বজনস্বীকৃত শক্তিশালী ঘাঁটি ‘দিয়েন বিয়েন ফু‘ লন্ডভন্ড পর্যুদস্ত করে দেয়।
শত বছরের উপনিবেশিক শাসক -গর্বিত ফ্রান্স নির্লজ্জভাবে লেজ গুটিয়ে পালায়!

এরপর আসে আমেরিকার পালা।
অবিশ্বাস্য ব্যাপার ঘটে এখানেও! পৃথিবী ও মহাজগতের সর্বাধিক ক্ষমতাধর রাষ্ট্র, এই ক্ষুদ্র গরীবস্য গরীব ভিয়েতনামের কাছে গো হারা হেরে যায়!

ধীরস্থির ছোটখাটো এক কৃষক তাঁর সরল সামান্য কথায় দেশকে উজ্জীবিত করে তোলে। অসামান্য শক্তিশালী দুই দুইটা আগ্রাসী রাষ্ট্রকে পরাভূত করে!

এই কৃষক নেতার নাম ‘হো চি মিন‘, ভালোবেসে সবাই তাঁকে ‘আঙ্কেল হো‘ বলে ডাকে।
‘আঙ্কেল হো‘ মোটেই অন্য বিপ্লবীদের মত নন।

যেমন একদিনের এক ঘটনা দিয়েই তাঁকে চেনা যায়, তাঁর চরিত্র বোঝা যায় –

দূর গ্রাম থেকে এক বিপ্লবী এসে খবর দিল, গ্রামের বৌদ্ধ সাধুদের কোনভাবেই দলে ভেড়ানো যাচ্ছে না! তাঁরা দিনরাত জপতপ করে, আর ধ্যানে মগ্ন থাকে সারাক্ষণ!

আঙ্কেল হো তৎক্ষণাৎ তাঁকে নির্দেশ দিলেন, ‘এক্ষুনি গ্রামে ফিরে যাও আর তাঁদের সাথে মিশে ধ্যান করো। ‘

মে ৮
তাসমানিয়ান ডেভিল

দেখতে নারকীয় পিশাচের মত তাসমানিয়ান ডেভিল তার প্রখর ঘ্রাণেন্দ্রিয় আর দানবীয় চোয়ালের জন্য পৃথিবীতে ভয়ের প্রতিভূ হিসেবে পরিচিত।

কিন্তু তাসমানিয়ার আসল শয়তান এ নয়।‘ ব্রিটিশ সাম্রাজ্য‘ই তাসমানিয়ার প্রকৃত পিশাচ, যারা সভ্যতা প্রতিষ্ঠার নামে দ্বীপের অধিবাসীদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। তাঁদের নির্যাতনের শেষ শিকার ‘ক্রুগানিনি‘। তাসমানিয়ায় তাঁর রাজত্ব থেকে অপসারিত এই রাজকন্যা ১৮৭৬ সালে আজকের এই দিনে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে দুনিয়া থেকে একটি ভাষা আর জাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়!

মে ৯
আমি তারেই খুঁজে বেড়াই

১৮৭৪ সালের এই দিন সকালবেলায় হাওয়ার্ড কার্টার জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের ৫০ বছর পর পৃথিবীতে তাঁর আগমনের তাৎপর্য বুঝতে পারেন তিনি।

তুতেনখামেনের রাজকীয় সমাধি আবিষ্কারের দিনই তাঁর নিজের জন্মের গোপন উদ্দেশ্য উন্মোচিত হয়। কী অসাধারণ একাগ্রতা আর নিষ্ঠার পরিচয়ই-না দিয়েছেন এই অতিলৌকিক উদঘাটনে। বছরের পর বছর তিনি এখানে সেখানে হন্যে হয়ে খুঁজে বেরিয়েছেন ফারাও রাজাদের সমাধিপ্রাসাদ। অসংখ্য প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে গেছেন বিরল নিষ্ঠায়। তাঁকে নিরুৎসাহিত করেছেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা, ভয় দেখিয়েছেন মিশরতত্ত্ববিদ বড় বড় পন্ডিত ঐতিহাসিক। মুহূর্তের জন্যে দমে যাননি কার্টার, একদিনের জন্যেও থেমে যায়নি তাঁর খুঁজে ফেরা।

অবশেষে দেখা মেলে সেই অলৌকিক মুহূর্তের, দেখা মেলে তুতেনখামেনের! আবিষ্কারের সেই মহালগ্নে তুতেনখামেনের পদপ্রান্তে বসে – বিস্ময়ে বিমূঢ় কার্টার – ঘন্টার পর ঘন্টা নির্বাক ধ্যানমগ্ন সময় কাটান। চারপাশে তখনও ছড়িয়ে আছে অলৌকিক বিস্ময়ের অফুরন্ত রত্নরাজি!

সেদিনের পর বারবার ফিরে এসেছেন তিনি ফারাও সমাধিপ্রাসাদে। প্রতিবার খুঁজে পেয়েছেন রহস্যেঘেরা নতুন নতুন উপাদান।

একদিন তিনি অবাক বিস্ময়ে খেয়াল করেন তুতেনখামেনের পায়ের কাছে ছড়িয়ে আছে সাড়ে তিন হাজার বছরের পুরোনো একগুচ্ছ শস্যবীজ!

কার্টারের স্বপ্নময় হাত নিবিড় তুলে নেয় দূর অতীতের স্বর্গীয় শস্যকণা – পরম পুলকে অপার্থিব আবেগে!

মে ১০
ক্ষমা নেই তার ক্ষমা নেই

কবি রোক ডালটন বরাবরই প্রতিবাদের অভিনব আর প্রাণময় পন্থা গ্রহণ করতেন। অন্যায় তিনি মুখ বুজে সহ্য করতেন না বা কারো অন্যায্য নির্দেশনা আদেশ মাথা পেতে মেনেও নিতেন না। প্রাণ খুলে হাসতে পারতেন তিনি আর ভালোবাসতেন অফুরান।

১৯৭৫ সালের এইদিনে তাঁর সহযোদ্ধা এক গেরিলা ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। মতের মিল হয়নি তাঁদের কোনো কোনো ব্যাপারে।

মতের অমিলের কারণে হত্যা করা আর অন্যায় মত চাপিয়ে দিতে খুন করা দুই-ই সমান অপরাধ! স্বৈরাচারী জেনারেল ও বিপ্লবী গেরিলা এখানে সমান অপরাধী।

মে ১১
একই অঙ্গে এত রূপ!

১৮৫৭ সালে প্যারিসে ইউজিন ফ্রাঁসোয়া ভিডক মারা যান।

মাত্র ১৪ বছর বয়সে বাবার বেকারিতে পয়সাপাতি তছরুপ করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েন। ছিচকে চোরের পরিচয় সবাই জেনে যায় এরমধ্যেই। ধান্দাবাজ ক্লাউন, ধূর্ত ঠগ, ছন্নছাড়া ভবঘুরে, দক্ষ চোরাকারবারি’র তকমা জুটেছে এই বয়সেই! স্কুলে শিক্ষকতাও শুরু করেছেন কোমলমতি মেয়েদের সঙ্গ পাবার লোভে!

তাঁর অন্যান্য পরিচয়ের মধ্যে আছে –
নিষিদ্ধ পল্লীর দালাল, বিচিত্র ব্যবসায়ী, তুখোড় জুয়ারী, অভ্রান্ত গোয়েন্দা, অপরাধতত্ত্ববিদ, ক্ষেপনাস্ত্র বিশেষজ্ঞ, ফরাসি এফবিআই-এর পরিচালক, এবং প্রথম প্রাইভেট গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ।

জীবনে ২০ বার দ্বন্দ্ব যুদ্ধে মেতেছেন, জেল পালাতে গিয়ে পাঁচবার মিশনারী নান ও অসুস্থ বৃদ্ধের ছদ্মবেশ নিয়েছেন। অদ্ভুত সব ছদ্মবেশ নিতে তিনি ছিলেন ওস্তাদ অভিনেতা। পুলিশের বেশে অপরাধী বা অপরাধীর বেশে পুলিশ – ইউজিনকে সনাক্ত করা ছিল কঠিন এক কাজ।

বন্ধুর শত্রু কিংবা শত্রুর বন্ধু হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল সর্বজনবিদিত। শার্লক হোমস-সহ ইউরোপের গোয়েন্দা সাহিত্য ভিডকের কাছে নানাভাবে ঋণী। অপরাধী হিসেবে তাঁর ছলচাতুরি কৌশল ব্যবহার করেছেন পলাতক আসামী সনাক্তকরণে – অপরাধ দমনে!

মে ১২
জীবন্ত সিসমোগ্রাফ

২০০৮ সালে ভয়াবহ এক ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে মহাচীনের বড় এক অংশ!

কিন্তু কোনো প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা এই বিপর্যয়ের পূর্বাভাস দিতে পারেনি যদিও প্রায় দুই হাজার বছর আগে এই চীনেই ভূমিকম্প পরিমাপযন্ত্র সিসমোগ্রাফ আবিষ্কৃত হয়।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যেখানে ব্যর্থ, সেখানেই এগিয়ে আসে প্রাকৃতিক উদ্ভিদ ও প্রাণী; যদিও বিজ্ঞানীদের মনোযোগ এদিকে কখনো ছিল না এখনো নেই।

চীনে সেই ভূমিকম্পের পূর্বে প্রাণীদের আচরণ ছিল লক্ষ্য করার মতো। ঝাঁকে ঝাঁকে বিভিন্ন প্রজাতির ব্যাঙ লাফিয়ে পালাতে থাকে দিগ্বিদিক- শহরের রাজপথ পার্ক বিপনিবিতান সর্বত্র দেখা যায় ব্যাঙের ঝাঁক। চিড়িয়াখানার বাঘ সিংহ অস্বাভাবিক গর্জন করতে থাকে, ময়ূর কর্কশস্বরে ডাকতে থাকে অবিরাম, বৃহদাকায় হাতি ও জেব্রা চিড়িয়াখানার দেয়ালে উন্মাদের মতো আছড়ে পড়তে থাকে।

মে ১৩
গাইতে গাইতে জানি অন্তততর সত্তা

জগতের ভেতর অসংখ্য অজস্র জগত দেখতে চোখ খোলা চাই
নিজের ভেতর পাখির কলরব শুনতে গলায় গান আনা চাই

ওরিনোকো নদীর উজানে প্রজ্ঞাবান ঋষিদের জন্ম হয়।
কারণ ওরিনোকো আপনমনে গান গেয়ে নিজের রহস্য খুঁজতে জানে।

মে ১৪
এ নয় আমার আপন অপরাধ

১৯৪৮ সালের এই দিনে ইজরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
রাষ্ট্রগঠনের কয়েক মাসের মধ্যেই পাঁচ লাখ ফিলিস্তিনি নাগরিবকে তাঁদের জন্মভূমি থেকে বের করে দেওয়া হয়, পাঁচ শতাধিক গ্রাম নিশ্চিহ্ন করা হয়। যেসব গ্রামে একসময় জলপাই নাশপাতি মিষ্টি ডুমুর আর উৎকৃষ্ট বাদামের বাগান ছিল, সেসব আজ সুপরিসর রাজপথ ঝা ঝকঝকে বিপনীবিতান আর আধুনিক আনন্দনিকেতনের মাটির তলায় চাপা পড়ে আছে।

নতুন মানচিত্রে গ্রামের নাম নিশানা পর্যন্ত নেই! দখলদার ইজরায়েল একে একে গ্রাস করে নিচ্ছে সব, ফিলিস্তিনের খুব সামান্য অংশই আজ অবশিষ্ট আছে!

দু হাজার বছর ধরে অমানবিক নির্যাতন সহ্য করে আর বারবার ভূমি থেকে বিতাড়িত হতে হতে ইহুদীরা আজ বেপরোয়া সহিংস।

বিভিন্নভাবে ইহুদি নিগ্রহ-নির্যাতন ইউরোপীয়দের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। আর আজ তাঁদের অন্যায় প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছে নিরীহ ফিলিস্তিনি!

মে ১৫
অনাগত দিন কী এমনই ব্যর্থ হবে হতাশার কাফনে মুড়ে

২০১১ সালে হাজার হাজার চাকরিচ্যূত যুবক-যুবতী স্পেনের রাজপথে নেমে আসে। তাঁদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। ক্রমবর্ধমান আন্দোলন-প্রতিরোধ মহামারির থেকেও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে – ব্যাপ্ত হতে পারে সর্বত্র।
তাঁদের দৃপ্ত স্লোগান যেমন দেশকালের সীমানা পেরিয়ে হয়ে ওঠেছিল বঞ্চিত জনতার চিরকালীন উচ্চারণ।

‘ওদের নির্লজ্জ অপরাধ আমাকে রাস্তায় নামিয়েছে
আমার এ গ্লানি প্রজ্জ্বলিত ঘৃণা ওদের জন্যই জমা
তোতাপাখি টেলিভিশন বন্ধ করে জনতা স্লোগান ধরেছে
অনিবার্য সংকটের হোতা, তোমার ক্ষমা নেই আজ নেই ক্ষমা
অঢেল অর্থ বাগিয়েছ তুমি, বানিয়েছ প্রাসাদ ভিনদেশে
পুঁজির বাজারে তোমার অযুত-নিযুত বিনিয়োগ নানা ছদ্মবেশে
আমার কপালের আমিই স্থপতি তুমি কোথাকার কে হে
খেটে খাই বলে ভেবোনা আমায় বাধিবে মিথ্যা মোহে
আজিকে আমি খুঁজিছি আমার আজন্ম অধিকার
আমার স্বপ্ন ভাঙ্গিলে যেনো ঘুম কাড়িব ওই তোমার।’

মে ১৬
শেষ ঠিকানা

বৃহৎ গ্রাউপার ও অন্যান্য কড ফিস
ডলফিন,
রাজহাঁস, ফ্লেমিংগো, অ্যালব্যাট্রস
পেঙ্গুইন
বন্যমহিষ
উটপাখি
কোয়ালা
ওরাংওটাং ও অন্যান্য বানর এবং
প্রজাপতির মতো প্রাণিজগতে আমাদের নিকট আত্মীয় কমবেশি সবাই সমকামী সম্পর্কে অভ্যস্ত।
নারী- নারী ও পুরুষে পুরুষ।
মুহূর্তের তরে কিংবা জীবনভর!

ভাগ্যিস ওরা মানুষ নয়, মানুষ হলে নির্ঘাত পাগলাগারদ বা কয়েদখানায় জায়গা হতো –
স্থায়ী বা অস্থায়ী মেয়াদে!

১৯৯০ সালের এইদিন পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে সমকামিতা ছিল একধরনের মানসিক অসুস্থতা।

মে ১৭
আপন নিবাস

মহাকালের রাজপথে একবিংশ শতাব্দী আজ গর্বিত পথ চলছে! সেইসাথে অসহায় অনিকেত মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে সমতালে। দুনিয়াতে এখন এককোটি গৃহহীন মানুষ!

আবাসন সংকট নিরসনে বিশেষজ্ঞরা খ্রিস্টান এক সাধুকে অনুসরণের কথা ভাবছেন। সন্ত সেইন্ট সেমিয়ন স্টাইলেটিস একাধারে সাইত্রিশ বছর একটিমাত্র পিলারের উপর জীবন কাটিয়েছেন!

সকালে প্রার্থনা পরিচালনার জন্য তিনি নেমে আসতেন আর সারমন শেষে উঠে যেতেন সরু থামের মাথায়। দুনিয়াতে ঐটুকু জায়গাই তিনি দখলে রেখেছেন, ভোগ করেছেন!

মে ১৮
স্মৃতিবিহার

১৭৮১ সালের ১৮ মে, পেরুর কাসকো শহরে প্লাজা দ্য আরমাস চত্বরে ‘টোপাক আমারু‘কে কুপিয়ে চার টুকরো করা হয়।

দুইশ বছর পর একনাদান পর্যটক আসেন সেই একই চত্বরে। খালিপায়ে নিবিড় মনোযোগে অন্যের জুতা পালিশ করছে এক ইনকা বালক চত্বরের এককোণে। অজ্ঞরাজ সেই টুরিস্ট, বালককে জিজ্ঞেস করে, ‘ টোপাক আমারুর সাথে তোর দেখা হয়েছে কখনো?‘

মাথা না-তুলেই নির্বিকার ভঙ্গিতে সেই কিশোর জানায়, ‘ হ, দ্যাহা হইছে, অহনো হয়।‘

কাজ করতে করতে আপন মনে বালক বলে, ‘ আমারু তো দমের বাতাসের ল্যাহান আমার বুকের মইধ্যে ওঠানামা করে!‘

[ ঔপনিবেশিক স্প্যানিশ শাসকদের নিদারুণ নির্যাতনের শিকার ইনকা বিদ্রোহী বীর টোপাক আমারু ২ (১৭৪২-১৭৮১) । তাঁর পূর্বপুরুষ টোপাক আমারু ১ (১৫৪৫-১৫৭২) এর মতোই এই চত্বরে তাঁকেও হত্যা করা হয়। সভ্যতার বরপুত্র স্প্যানিশ শাসকেরা তাঁর চোখের সামনে স্ত্রীপুত্রকে পাশবিক নির্যাতনে হত্যা করে । হাত-পা দড়িতে বেঁধে তেজী আটটা ঘোড়ার মাধ্যমে আমারুর দেহকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চালানো হয়, ব্যর্থ হয়ে কুঠারের আঘাতে হাত পা বিচ্ছিন্ন করা হয় দেহ থেকে। –অনুবাদক ]

মে ২০
নিপাট পাগলামি

১৯৯৮ সালে ফ্রান্স আইন করে সাপ্তাহিক কর্মঘন্টা পয়ত্রিশ-এ নামিয়া আনে।

‘কম কাজ বেশি জীবন’-এর মূলমন্ত্র থমাস মুরের প্রিয় বিষয়, তাঁর ইউটোপিয়া’র প্রধান উপজীব্য। কিন্তু বাস্তবে পরিণত করতে মানুষকে ৫০০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে।

যাই হোক, কাজের চাপ যদি কমাতে না-ই পারল বা জীবনের অবসর আনন্দ বাড়াতে না-ই পারল, তাহলে যন্ত্রের এই বাহুল্যের দরকার কী? প্রযুক্তির এতো প্রয়োজন কোথায়?

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কী শুধু মানসিক অবসাদ আর বেকারত্ব বাড়াবে – কালে কালে দেশে দেশে!

ইতিহাসে অন্তত একটি দেশ এর প্রতিবাদে সাপ্তাহিক কর্মঘণ্টা কমিয়ে দিয়েছিল।

কিন্তু জগতে পাগলামির স্থান কোথায়? পয়ত্রিশ ঘন্টার যৌক্তিক এই কর্মপরিধির নিয়ম বেশিদিন টেকেনি। মাত্র দশ বছরের মাথায় এ নিয়ম পরিত্যক্ত হয়, বাতিল হয়ে যায়!

মে ২১
বিশ্ব সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য দিবস

১৯০৬ সালে কঙ্গোর জঙ্গল থেকে এক পিগমি মানবকে নিউইয়র্কের ব্রোংস চিড়িয়াখানায় ধরে আনা হয়। সেখানে তাঁর নাম দেয়া হয় ‘ওটা বেঙ্গা‘। চিড়িয়াখানার একটি খাঁচায় চারটে শিম্পাঞ্জি ও একটি ওরাংওটাং এর সাথে তাঁরও উন্মুক্ত প্রদর্শনী হয়!

বিশেষজ্ঞদের মতে এই উনমানব তাঁর পূর্বপুরুষের যথার্থ উত্তরাধিকারী ও জীবন্ত নমুনা। সবাইকে সে প্রমাণ দেখাতেই এই সম্মিলিত প্রদর্শনী – একসাথে শিম্পাঞ্জি ওরাং ওটাং ও মানুষ!

কিছুদিন পর এক খ্রিস্টান মানবাধিকার সংস্থা পিগমি মানবকে সেখান থেকে উদ্ধার করে।

মানবাধিকার সংস্থা চেষ্টা করে যায় তাঁকে মানবিক করে তুলতে, কিন্তু সব ব্যর্থ হয়! ওটা বিঙ্গা কিছুতেই মানবিক হতে চায় না! প্রতিবাদে সে কথা বন্ধ করে দেয়, দামি জিনিসপত্র ভাঙতে থাকে, কাছে কেউ আসলে আঘাত করে আর তাঁর সাথে ছবি তুলতে আসলেই কামড়ে দেয়।

১৯১৬ সালে, মানবিকীকরণের দশ বছরের মাথায় কোন একভোরের আলো-আঁধারিতে তাঁর সব পোশাক-পরিচ্ছদ প্রজ্বলিত আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দেয় আর চুরি করা পিস্তলের নির্ভুল নিশানা করে নিজের ছোট্ট হৃদপিণ্ড লক্ষ্য করে!

মে ২২
প্রিয় টিনটিন, তুমিও?

১৯০৭ সালের এইদিনে, কমিক হিরো টিনটিনের স্রষ্টা বেলজিয়ান কার্টুনিস্ট ‘আর্জ’ জন্ম গ্রহণ করেন।

টিনটিন সভ্য সাদা মানুষেদের নির্ভুল প্রতিরূপ।

বহুলবিক্রিত তার এডভেঞ্চার বইয়ে, টিনটিন বেলজিয়াম অধ্যুষিত কঙ্গো ভ্রমণ করে। সেখানে সে নিগ্রোদের অদ্ভুতসব কর্মকাণ্ড নিয়ে বিস্তর হাস্যপরিহাস করে আর নিজেকে ব্যস্ত রাখে বিবিধ শিকারে।

পনেরটি কৃষ্ণসার হরিণ শিকার করে সে, ছদ্মবেশের জন্য বানরের আপাদমস্তক চামড়া ছিলে নেয়, ডিনামাইট দিয়ে বৃহদাকার রাইনোসোরাস হত্যা করে, কুমিরের হা-করা মুখে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে অবলীলায় ট্রিগার টিপে দেয়!

টিনটিন গর্বকরে বলে কৃষ্ণাঙ্গদের থেকে ঢের ভালো ফরাসি জানে চতুষ্পদ হাতি! শুধুমাত্র সুভেন্যিয়রের জন্য নির্বিচারে সে হাতি হত্যা করে বৃহদাকায় আইভরি দাঁত সংগ্রহ করে।

সবমিলে সেবার আফ্রিকার ট্রিপ ছিল মৌজ-মাস্তিতে ভরা!

মে ২৩
অফুরান সম্পদ আর ক্ষমতার যুবরাজ

১৯৩৭ সালে পার্থিব দুনিয়ার অঢেল সম্পদের মালিক, জ্বালানি তেলের রাজপুত্র, স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা জন ডি. রকফেলার মারা যান।

তিনি প্রায় শতবর্ষ বেঁচে ছিলেন!

ময়নাতদন্তের রিপোর্টে সম্পদ নিয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র দ্বিধা বা গ্লানির নমুনাও পাওয়া যায়নি!

মে ২৪
স্বীকৃত স্বর্গবাসী

১৫৪৩ সালের ২৪ মে নিকোলাস কোপার্নিকাসের জীবনের শেষ দিন। ‘সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ঘোরে’ – এই মতবাদের বইটি প্রকাশের পরপরই তাঁর মৃত্যু হয়। চার্চ রায় দেয় বইয়ে প্রকাশিত মত সর্বৈব মিথ্যা ও পবিত্র বাইবেল বিরোধী। এই আবিষ্কারে আস্থা রাখার জন্য পুড়িয়ে মারা হয় জিওর্দানো ব্রুনোকে, আর সূর্য কেন্দ্রিক মতবাদ ভিত্তিহীন মিথ্যা প্রমাণ করতে গ্যালিলিও’কে বাধ্যকরা হয়।

ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারার সাড়ে তিন শতাব্দী পর ভ্যাটিকান অনুতাপ প্রকাশ করে, এবং চার্চের আঙ্গিনায় গ্যালিলিওর আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করে। দুনিয়াতে ঈশ্বরের দূতাবাস ভ্যাটিকান থেকে এই বিলম্বিত ক্ষমা চাওয়ার সাথে সাথে সগর্বে এটাও ঘোষণা করা হয় যে, ‘সেইন্ট রবার্তো বেলার্মিনো ঈশ্বরের প্রিয়বান্দা, স্বর্গের সম্মানিত অধিবাসী।‘

সেইন্ট রবার্তো ব্রুনো ও গ্যালিলি’কে মৃত্যুদণ্ড দেন!

মে ২৬
শার্লক হোমস দুই দুইবার মারা যান

প্রথমবারের মতো শার্লক হোমসের মৃত্যু হয় ১৮৯১ সালে।জনক আর্থার কোনান ডয়েল ধারণাই করতে পারেননি কী ভীষণ জনপ্রিয় তাঁর এই মেধাবী সন্তান। জনপ্রিয়তা কিছুটা টের পেলেন আল্পসের চূড়া থেকে তাঁকে ফেলে দেওয়ার পর।
স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিন এই সংবাদ প্রচার করলে দুনিয়াজুড়ে শোকের মাতম শুরু হয়। অনেকেই এই সংবাদ ভিত্তিহীন মিথ্যা বলে বিশ্বাস করেনি। অসংখ্য মানুষ রাগে ক্ষোভে তাঁদের প্রিয় ম্যাগাজিনকেও পরিত্যাগ করে।

কোনান ডয়েল বাধ্য হয়ে শার্লক হোমসকে ফিরিয়ে আনেন।

কিন্তু হোমসের দ্বিতীয় মৃত্যুর ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না। তাঁর বেকার স্ট্রিটের বাড়িতে ফোন করে কেউ খোঁজ নেয়নি সেদিন। কেননা সেদিন আর কেউ নয়,সময় বয়ে এনেছিল মৃত্যু; যে-সময় আমাদের জন্যেও বয়ে আনবে অমোঘ এই উপহার!

মজার বিষয় হলো তাঁর অন্তেষ্টিক্রিয়ার খবর টাইমস ম্যাগাজিন এবার ছাপেনি!

মে ২৭
ভবঘুরেষু

ফার্নান্দো মারা যায় ১৯৬৩ সালের ২৮ মে সকাল বেলা। সত্যিকার স্বাধীনসত্তা আর মুক্তপ্রাণ পথিক ছিল সে। ফার্নান্দো ছিল সবার আবার সে কারো একান্ত ব্যক্তিগতও নয়।

রাস্তায় ইঁদুর তাড়াতে গিয়ে ভিড়ে যায় সঙ্গীতবাজ গিটারবাদকদের দলে। তাঁদের সাথে হল্লা করে পৌঁছে যায় রাজ্যেরসব কনসার্টে, সঙ্গীতের তাবৎ আসরে। ঘরোয়া জলসা বা উন্মুক্ত কনসার্টে মুখ্যশ্রোতা আর বিজ্ঞ সমঝদার আমাদের এই ফার্নান্দো!

গানের সুরতাল ঠিক থাকলে চোখ তার চকচক করে ওঠে, আনন্দে লেজ নাড়াতে শুরু করে। আবার হঠাৎ কারো তাল কেটে গেলে বিরক্তিতে গোঁ গোঁ করতে থাকে, আসর ছেড়ে চলে যায়! কুকুর নিধকদের খপ্পরে পড়লে জনতা তাকে মুহূর্তেই ছাড়িয়ে আনে অথবা গাড়ির ধাক্কায় আহত হলে শহরের সেরা ডাক্তার তার চিকিৎসা করে। সদর রাস্তা আর উন্মুক্ত উদ্যান তার লীলাময় বৃন্দাবন! তার নির্লজ্জ মিথুনক্রিয়া সহ্য করতে না-পেরে হিংসুটেরা কষে লাথি বসিয়ে দেয় তার গায়ে! খুঁড়িয়ে চলতে দেখে প্রোগ্রেসো ক্লাবের বালকদল বিপুল উৎসাহে তার পরিচর্যা শুরু করে।

আর্জেন্টিনার চাকো প্রদেশের রেজিস্টেনশিয়া শহরের গৌরব বাড়িয়েছে সবার প্রিয় এই ‘ফার্নান্দো’ – সঙ্গীতবোদ্ধা এক সারমেয়! আজও নগরবাসীর ভালবাসায় সিক্ত হচ্ছে তার তিন তিনটা নিপুণ ভাস্কর্য!

মে ২৮
অসভিইনচিম

২০০৬ সালের এইদিনে পোপ বেনেডিক্ট পোল্যান্ডের অসভিইনচিম শহরের একউদ্যানে আয়েশি পায়চারি করছিলেন।

শহরটির নাম বা নামের উচ্চারণ হঠাৎ তাঁর ভাবনার জগৎ আমূল
পাল্টে দেয়! পোলিশ ভাষায় যার উচ্চারণ অসভিইনচিম জর্মনে তাই আউশভিৎস!

পোপ সেদিন আবেগদৃপ্ত ওয়াজ করলেন আউশভিৎসের অভিশপ্ত মাটিতে, ‘ হা ঈশ্বর! সেদিন তুমি কোথায় ছিলে.. ?’
ভাগ্যিস মাহফিল থেকে কেউ বলে ওঠেনি, ‘ হুজুর, ঈশ্বর তো আপনার মতো ঠিকানা পাল্টান না।’

পোপ বয়ান করে যাচ্ছেন, ‘ হে পরওয়ারদেগার, কেন তুমি সেদিন নীরব নিশ্চুপ ছিলে..?’
কেউ তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেয়নি, ‘ ঈশ্বর নন সেদিন মৌনব্রতের ধ্যান করছিলেন স্বয়ং পোপ আর তাঁর শান্তিকামী চার্চ।’

মে ২৯
ভ্যাম্পায়ার

১৭২৫ সালে মৃত পিটার জাগোজেভিচ কবর থেকে উঠে এসে নয়জন প্রতিবেশীকে কামড়ে দেয়, তাদের রক্ত চুষে খায়। অস্ট্রিয়ার প্রতিরক্ষা বাহিনী তাকে জীবিত ধরে আনে। শেষে তার হৃদপিণ্ড এফোড়-ওফোড় করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

পিটার ইতিহাসের প্রথম রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার এবং তুলনামূলক কম ক্ষতিকর ও স্বল্প পরিচিত।

সব থেকে বেশি পরিচিত ব্রাম স্টকারের ‘কাউন্ট ড্রাকুলা‘!

কয়েকশো বছর পর পৃথিবী থেকে সমস্ত ড্রাকুলা নির্বংশ হয়ে যায়। তাদের নিশ্চিহ্ন হওয়ার কারণ হলিউডের ভয়ংকর বোকা-সোকা ড্রাকুলা নয়। এসব কৃত্রিম ড্রাকুলা তাদের কিছুই করতে পারেনি।

নতুন বহুমুখী ড্রাকুলার রক্তের চাহিদা অফুরান অনিঃশেষ! তারা একের পর এক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান তৈরি করছে, ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করছে আর যুগের পর যুগ সারা পৃথিবীর রক্ত শুষে খাচ্ছে।

এদের ভয়ে আদি ও আসল ড্রাকুলা পালিয়েছে সেই কবেই!

মে ৩০
ওগো সাহসী নারী, তোমার নিয়তি

১৪৩১ সালের এই দিনে উনিশ বছরের তরতাজা এক যুবতীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় রুয়েঁ শহরের জনাকীর্ণ বাজারের মধ্যেখানে!

বিশাল লম্বা এক টুপি মাথায় সেই নারী ধীরস্থির নির্বিকার উঠে আসে বধ্যমঞ্চের মাঝখানে। টুপির গায়ে লেখা ছিল –

খারিজি
বদ্ধ অপরাধী
ধর্মচ্যুত
পৌত্তলিক।

তাঁকে পুড়িয়ে হত্যা করে ছাইভস্ম সীন নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়, যাতে তাঁর সব স্মৃতিচিহ্ন পুণ্যভূমি ফ্রান্স থেকে অনেক দূরে চলে যায়।

ফ্রান্সের তৎকালীন রাজন্যবর্গ ও ক্যাথলিক চার্চের প্রতিহিংসার শিকার এই অভাগা সাহসী তরুণীর নাম-
‘জোয়ান অফ আর্ক‘

তাঁর প্রতিটি ছাই কণা থেকে এখনো এক একজন জোয়ান অব আর্ক জন্ম নিচ্ছে, আর নির্মমসব অবিচার সহ্য করছে!

আমরা কী তাঁদের চিনি?

মে ৩১
অগ্নিকন্যা

সিনোরা জিরারদেল্লি উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক জুড়ে ইউরোপীয় জনতাকে বিশ্বয়াভূত করে রেখেছিলেন!

আগুনকে তিনি ভালোবেসেছেন অতুল মমতায় আর পরম পরশের মতো তার উষ্ণতা নিয়েছেন আপন শরীরে।

প্রিয়তম পুরুষের গাঢ় স্পর্শের মত জলন্ত মোমবাতির উত্তাপ নিয়েছেন হাতে,শরীরে। নগ্ন পদে নেচেছেন দগদগে লোহার পাটাতনে, গনগনে আগুনের লেলিহান শিখা ঝর্ণাধারা ভেবে স্নান করেছেন অবিরাম। ফুটন্ত তেল গোগ্রাসে পান করেছেন আর প্রজ্জ্বলিত আগুন গিলে খেয়েছেন সহজ স্বাভাবিকতায়। গলিত সীসা মুখে পুরে পাউন্ড স্টারলিং-এর ঝা ঝকঝকে মুদ্রা তৈরি করেছেন।

এই নিবিড় প্রদর্শনীর পর তিনি তাঁর শরীরের অসংখ্য অজস্র ক্ষত, দগদগে পোড়া দাগ নিশ্চুপ দেখিয়েছেন মেলে।

অবিশ্বাসীরা বলে, ‘সব ভাঁওতাবাজি!‘
তিনি তখনও চুপ, চোখের গভীরে শুধু জ্বলে দগদগে গ্লানি!

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top