একটি বন্য স্বপ্নের অন্ধ যাত্রা (২১তম পর্ব) // নীলিম কুমার II অসমিয়া থেকে অনুবাদ: বাসুদেব দাস

(৬১)
সনন্ত মহাজনের কথা ভাবলেই রাহুলের অন্য একটি কথা মনে আসে। আর সে কথাটা ভালোভাবে মনে করে মনটা একটু হালকা করে নেয়। প্রকৃতপক্ষে সনন্ত মহাজনের কথা বলে বলা যায় না। কিন্তু সাধারণত মহাজনের বড়ো ছেলে সিনেমা হলের শর্মা টকিজের মালিক এবং শেষের দিকে ধাপে ধাপে উন্নতি করা ঠিকাদার দীনেশ শর্মার কথা! ছেলের কথা হলে কী হবে! সমস্ত ছেলেই তো বাপের রক্তের প্রতীক। ছেলের নিশান হেলে পড়লে বাবার মাথাটাও নিচু হয়ে যায় নাকি?
তখন বিদেশি বহিষ্কার আন্দোলন তুঙ্গে। স্কুল-কলেজগুলি বন্ধ হয়ে গেছে। ছাত্র-ছাত্রীদের শৈক্ষিক জীবনের এক বছর লোকসান। সান্ধ্য আইন, লাঠিচার্জ, কাঁদানো গ্যাস, মারপিট, নরহত্যায় উত্তপ্ত অসম।সদৌ অসম ছাত্র সংস্থার নেতৃত্বে আন্দোলন চলছে। এরকম একটি দিনে একদিন আন্দোলনের নেতৃত্ব আহ্বান দিয়েছে জনতা সান্ধ্য আইন। অর্থাৎ অসমের জনসাধারণ সেদিন নিজেই সান্ধ্য আইন জারি করে প্রবল প্রতিবাদ করছে অসম সরকারের বিরুদ্ধে। সেদিন অসমের সমস্ত প্রান্তে হওয়ার মতো পাঠশালা বজালীতেও সমস্ত দোকান-পাট বন্ধ। রাস্তায় একটিও মানুষ নেই। শূন্য রাস্তায় টহল দিচ্ছে পুলিশ- মিলিটারি। পুলিশ মিলিটারি জনতায় দেওয়ার সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে ।
শর্মা টকিজে পুলিশ মিলিটারি ঢুকে গেছে। পুলিশ মালিক দীনেশ শর্মাকে জিজ্ঞেস করছে—’ কিউ বন্ধ রাখা হয় সিনেমা হল?’
দীনেশ শর্মা বলেছে—’ এক ভী আদমি নেহি হ্যায়, ইসলিয়ে।’
আর্মি একজন দর্শক হলেও এদিকে এদিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ঠিক সেই সময় রাহুল এবং জিন্টু দুপুর বেলার ভাত খেয়ে বাইরেটা কতটা নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে তা দেখার জন্য কৌতুহলবশত ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় বেড়িয়েছিল মাত্র! সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন আর্মি ওদের দুজনের দিকে রাইফেল লক্ষ্য করে—’ রুক যাও ‘বলে চিৎকার করে উঠল। ওরা দুজন যেখানে ছিল সেখানেই থেমে গেল। তিনজন আর্মি ওদের কাছে এসে ‘চল’ বলে ওদের ঘিরে ধরে নিয়ে গেল—আগে আগে একজন পেছন পেছন দুজন। শর্মা টকিজের বারান্দায় দাঁড় করাল দুজনকে।
শর্মাটকিজের বারান্দায় সুন্দর ধবধবে সাদা ধুতি এবং ক্রিম রঙের পাঞ্জাবি পরিহিত সনন্ত মহাজনের বড়ো ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একজন মিলিটারি সিনেমা হলের মালিক, বজালী অঞ্চলের একমাত্র ইটভাটার মালিক, দুটি ট্রাক অ্যাম্বাসেডর গাড়ির মালিক, এই সময়ের প্রতিপত্তীশালী ঠিকাদার দীনশ শর্মার এক গালে সজোরে একটা চড় কষিয়ে দিয়ে বলল—’ সিনেমা হল বন্ধ রাখতা হ্যাঁয়! খোল।’
এত বড়ো ধনী মানুষটাকে এভাবে চড় মারতে দেখে রাহুল জিন্টু ভয়ে কেঁপে উঠল। রাহুল খুব সাহসের সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা প্রচার সমিতিতে শেখা হিন্দিতে বলল—’ ইয়হ ফিল্ম হামনে পহলে দেখা হ্যাঁয়। দুবারা দেখনা নেহি হ্যাঁয়।’
আর্মি বলল—’ দেখনা পড়েগা!’
রাহুল বলল—’ লেকিন হামারা পাস পয়সা নেহি হ্যাঁয়।’
‘ হাম দে দুঙ্গা’—- আর্মিটা বলল।
আর্মি দীনেশ শর্মাকে নির্দেশ দিল—’ টিকেট কাউন্টার খোল।’
দীনেশ শর্মার নির্দেশে একজন কর্মচারী টিকেট কাউন্টার খুললেন।রাহুলের হাতে আর্মি পয়সা দিল। টিকিট কাউন্টারের ফুটো দিয়ে রাহুল পয়সা ঢুকিয়ে দিল । উইকেটের দাম রেখে বাকি পয়সা মানুষটা ঘুরিয়ে দিল টিকিটের সঙ্গে। টিকিটটা হাতে রেখে রাহুল বাকি পয়সাটা আর্মিকে ফিরিয়ে দিল।ঠিক তখনই ভয়ে পালাতে চাইছিল জিন্টু। কিন্তু আর্মি তার হাতটা খপ করে ধরে ফেলল।
মেটিনি শো আরম্ভ হওয়ার সময় হয়েছে। সিনেমা হলের দরজা খোলার দীর্ঘ বেল বেজে উঠল। গেটকিপার দরজা খুলে দিল। রাহুল গেটকীপারকে টিকেট দেখাল— দুটো ভয়ের টিকেট!
গেট কীপার টিকেট দুটোর এক দিক ছিঁড়ে অন্য দুটি দিক ফিরিয়ে দিল রাহুলকে। আধা ভয় আধা ছেঁড়া টিকেট দুটিতে তখনও লেগে রইল!
এখন আর্মি সমস্ত কিছু লক্ষ্য করছিল। জনতা সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করায় তারা সফল হল। তারপরে রাহুলরা কিছুই জানে না। সিনেমা হলের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
রাহুল এবং জিন্টু দুজনেই এভাবে গায়ে গা লাগিয়ে দুটি চেয়ারে বসে পড়ল যেন দুজনে দুজনের ভেতরে লুকোতে চাইছে! একটা প্রকাণ্ড হলে শূণ্য চেয়ার গুলির মধ্যে মাত্র দুজন অল্পবয়সী দর্শক। সিনেমা হল অন্ধকার হয়ে গেল। সিনেমা চলতে লাগল। ওদের ভয়গুলি কণিকা কণিকা হয়ে সিনেমা হলের প্রত্যেকটি খালি চেয়ারে বসে রইল…
সিনেমার কোনো একটি দৃশ্যই রাহুলের চোখে পড়ল না। সে অন্য একটি সিনেমা দেখতে লাগল—কীভাবে আর্মি ওদের দুজনকে ধরে নিয়ে এল…। কীভাবে দীনেশ শর্মাকে আর্মি প্রচন্ড জোরে একটা চড় কষাল…
চড়টা গজেন্দ্রনাথের নাতি রাহুল এবং জিন্টুর সামনে দীনেশ শর্মাকে মেরেছিল আর্মি । দীনেশ শর্মার কোনো সম্পত্তি আর প্রতিপত্তি সেই চড় থেকে তাকে বাঁচাতে পারল না। সেই চড়টা খাবার সময় কীভাবে দীনেশ শর্মা অসহায় ভাবে রাহুল এবং জিন্টুর দিকে তাকিয়ে ছিল। একজন পরাজিত মানুষের চাহনি ছিল সেটা…। দীনেশ শর্মার কাতর চোখ দুটি যেন রাহুল জিন্টুকে বলছিল— এই চড়টির কথা কারও কাছে প্রকাশ না করার জন্য!
সেটা ছিল রাহুলের শৈশবের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য। কেননা সেটাই ছিল গজেন্দ্রনাথের রক্তের কাছে সনন্ত মহাজনের রক্তের পরাজয়ের ঘটনা।

(৬২)
তৃতীয়জন মহাজন ছিল মোহন তালুকদার। লম্বা,ক্ষীণ ‌এবং স্বল্পভাষী মোহন মহাজনের টাক মাথায় থাকা মাত্র কয়েকটি চুল,চুলের গৌরব নষ্ট করেছিল।রাহুল সেই মাথাটা দেখলে ভাবে–সেই চুল কয়েকটি মোহন মহাজন কেন রেখে দিয়েছে?কামিয়ে ফেললে চুল কয়েকটির মুক্তি!একটি নিঃসঙ্গ দ্বীপে যেন মাত্র কয়েকটি গাছের অরন্য!সেই চুল কয়েকটি কামিয়ে ফেললে যেন আরও বেশি মহাজন বলে মনে হত!
মোহন মহাজনের একমাত্র ছেলেটির নাম সনাতন।তার ওপরে দুই বোন।নাম দুটি মনে রাখার মতো নয়।সুন্দর করে শরীরের ভাঁজগুলি চোখে পড়ার মতো করে টেনে টেনে সেফটিপিন মেরে শাড়িগুলি পরে। বেশিরভাগ সময় ওরা রাস্তার দিকেই তাকিয়ে থাকে।কিন্তু সেই সময় রাস্তাগুলিতে কোনো রোমান্টিকতা ছিল না।ছেলে-মেয়ে এক সঙ্গে কথা বলতে বলতে রাস্তা দিয়ে চলাচল করাটায় সমাজের সম্মতি নেই।সেই পদক্ষেপের ভার সইতে রাস্তাগুলি ছিল অনিচ্ছুক।
রোমান্টিকতার চলাচল ছিল বই খাতার মধ্য দিয়ে—ইতিহাসের বই বা ভূগোলের বইয়ের মানচিত্রের নিচে নিচে সন্তর্পণে।সেইসবের মধ্য দিয়ে চিঠির আদান-প্রদান হত।হৃদয়ের বার্তা,প্রতিশ্রুতি,কখনও প্রতিজ্ঞাও!কিন্তু মোহন মহাজনের মেয়ে দুটিকে দেখলে এরকম মনে হয় যেন ওদের হৃদয়ের কোনো বার্তা থাকতেই পারে না। আর ছিল যদিও কিছু, প্রকাশ করার জন্য হৃদয়টাকে খুঁজে পাওয়া যেত না!
সনাতন রাহুলদের সঙ্গে একসঙ্গে পড়ত। সুন্দর হাতের লেখা ,সোনালি ঢাকনার ফাউন্টেন পেনে। শিক্ষক বাড়িতে পড়াতে আসে। ও বলতে ভুলে গেছি— ছোটো হলেও পাঠশালার একমাত্র দোতলা ঘরটি ছিল মোহন মহাজনেরই।
উপরতলার একটি ঘরে পাঠশালার ভেতরে সবচেয়ে সুন্দর হাতের লেখা সনাতনের পড়া এবং শোবার ঘর। কিন্তু রাহুলের ইচ্ছা করে—’ পাঠশালার ভেতরে’ শব্দ দুটি কেটে’ পৃথিবীর ভেতরে’ বলতে।
মোহন মহাজনের বাড়ির চৌহদে পরিবারের মানুষ ছাড়া অন্য মানুষের প্রবেশ নিষেধ। এর মূল কারণ হল সুন্দর সাজসজ্জায় সজ্জিত হয়ে থাকা মেয়ে দুটি। ওরা যাতে কারও সংস্পর্শে আসতে না পারে তার জন্যই এই ব্যবস্থা। কেবল গজেন্দ্রনাথের নাতি বলেই রাহুল আসতে পেরেছিল সেই ঘরে। সে মূল ঘরে প্রবেশ না করে বাইরে বাইরে সোজা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে যায়, সনাতনের ঘরে প্রবেশ করার আগে সে ওপর থেকে পৃথিবীটাকে দেখে। সে দেখে ওপর থেকে পৃথিবীটাকে সুন্দর দেখায়।
সনাতন থাকা ঘরের সিলিং থেকে একটা ফ্যান ঝুলে থাকে।ফ্যানের সুইচটা দিলেই ফ্যানটা তীব্রভাবে ঘোরে, রেগুলেটর নেই, ডাইরেক্ট।এত ঘুরে। রাহুলভাবে ফ্যানটা বলছে আমি ঘুরছি। এভাবে ভাবতে রাহুলের আনন্দ হয়। তার হিংসা হয় না, কিন্তু সে তুলনা করে সনাতনের ফ্যান এবং তার বাঁশের পাখা!
সনাতন তার রুমে থাকা প্রকাণ্ড আলমারিটা খুলে একটা ক্যামেরা বের করে এনে একদিন রাহুলকে দেখিয়েছিল। রাহুল ছুঁয়ে দেখেছিল কালো রঙের একটি ঠান্ডা ক্যামেরা। ক্যামেরাটার পেছন দিক থেকে দুটো ছোটো ব্যাটারিও খুলে এবং ঢুকিয়ে দেখিয়েছিল। একটা চোখ বন্ধ করে সনাতন ক্যামেরার লেন্স দিয়ে রাহুলকে দেখেছিল। রাহুল সামান্য হেসে পোজ দিল। কিন্তু সনাতন ক্লিক করল না। সনাতন বলল— রীল শেষ হয়ে যাবে!’
তথাপি রাহুল মাঝে মধ্যে সনাতনদের বাড়িতে যায়। সনাতন রুমের সামনে থেকে পৃথিবীটাকে দেখে। সে কেউ না দেখা একটা ক্যামেরা দিয়ে ফোটো তুলে আনে তার ছোটো ছোটৌ পৃথিবীটার। কেউ তার রীল শেষ করতে পারেনা। আসলে রাহুল মোহন মহাজনের পৃথিবীটার সঙ্গে গজেন্দ্রনাথের পৃথিবীটা তুলনা করার জন্য এভাবে যেতে থাকে! কী কী আছে মোহন মহাজনের আর কী কী আছে গজেন্দ্রনাথের ? হিসেব করে করে রাহুল দেখে গজেন্দ্রনাথ অনেক ধনী!

(৬৩)
সাধারণত পাঠশালায় বন্যা হত না। কিন্তু এবার বিশ্বর্নলা খালটি উপচে ওঠে আজাদ ভবন,শহীদ ভবনের বারান্দা ডুবিয়ে ফেলেছিল। পাঠশালার পথঘাট এভাবে ডুবিয়ে ফেলল যেন সেটা হয়ে উঠল জলের উৎসব! মানুষ যেভাবে উৎসব দেখতে আসে সেভাবে বাড়ি থেকে মানুষগুলি বেরিয়ে এল। মানুষের মুখগুলোতে যেন উৎসব দেখার হাসি। প্রত্যেকে স্যান্ডেল খুলে খালি পায়ে জলের তলায় ডুবে যাওয়ার রাস্তায় কাপড় গুটিয়ে এতদিনে অকর্মণ্যের মতো থাকা বিশ্বৰ্নলা খালটির উগ্রমূর্তি দেখতে এল। জলের ঠান্ডা স্পর্শ এবং স্রোত গুলি মানুষের যেন রক্তের ভিতরে ঢুকে গিয়েছিল…
সনাতন এল গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে। বন্যার ছবি তুলল। তারও উৎসাহের শেষ ছিল না। অতি উৎসাহিত হয়ে সে বিশ্বৰ্নলা সেতুর নিচের ঢেউ গুলি ধরতে চাইছিল তার ক্যামেরার রীলে, যেভাবে মাছ ধরে! তখনই সে পিছলে গেল, গেল যে গেলই,বিশ্বৰ্নলার তীরে তীরে মানুষ খুঁজে বেড়াল সনাতনকে।
সমগ্র পাঠশালার মানুষগুলির মধ্যে হইচই শুরু হয়ে গেল —- মোহন মহাজনের ছেলেকে বন্যার জল ভাসিয়ে নিয়ে গেছে —যার যেখানে যা ছিল জাল জাকৈ নিয়ে বিশ্বৰ্নলার তীরে তীরে মানুষ খুঁজে বেড়াল সনাতনকে ।
কাঁদতে কাঁদতে শালগ্রাম শিলার কাছে প্রার্থনা জানাল—পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর হাতের লেখা থাকা ছেলেটি যেন পৃথিবী থেকে হারিয়ে না যায়!
অবশেষে অনেক দূরে মানুষগুলি খুঁজে পেল সনাতনকে। তখনও তার গলায় ঝুলছিল সেই কালো ক্যামেরাটা। কিন্তু একটা চোখ বন্ধ করে অন্য চোখ ক্যামেরার লেন্সে রেখে ফোটো তোলার জন্য সেই চোখদুটো চিরদিনের জন্য স্থির হয়ে গিয়েছিল।
মোহন মহাজন চোখের জল রুমাল দিয়ে মুছছিলেন। একমাত্র পুত্রকে হারানোর দুঃখেও তিনি হাউ মাউ করে কাঁদলেন না। কারণ কান্না মানুষের দুর্বলতার দৃশ্য বলে মোহন মহাজন জানত। সুন্দর করে শাড়ি পরা দুই দিদি চিৎকার করে কাঁদছিল। কান্নার সময়ও ওদের কাপড় ছিল সুন্দর হয়ে। মা কান্নার সময় নিজের বুকে কিল মারছিল। কাঁদতে কাঁদতে কেউ নিজের বুকে কিল মারতে রাহুল সেদিনই প্রথম দেখেছিল।
সেই ক্যামেরাটার কী হল জানা যায় না। কিন্তু রাহুল মাঝেমধ্যে মনে করে— তাতে রীলগুলো থেকে গেল!

(৬৪)
সমস্ত শহরে কোথাও না কোথাও একজন নারী থাকেই।
যার কাছে সবাই যেতে পারে কেবল কিশোররা ছাড়া! রাহুলভাবে, কবে বড়ো হবে—চম্পার কাছে যাবে!
পাঠশালা নামের জায়গাটা প্রকৃতপক্ষে শহর হয়ে উঠেনি, কিন্তু পৌরনিগমের অফিস হওয়ার জন্য এটাকে শহর হতে হল! তথাপি চম্পারই প্রধান ভূমিকা ছিল এটিকে শহর করে তোলায়!
সেই তখনকার দিনে আসা গজেন্দ্রনাথও এটাকে শহর করে তুলতে পারলেন না। গজেন্দ্রনাথ যেভাবে এই জায়গায় পদার্পণ করেছিল, যেন একটি আধ্যাত্মিক শহর গড়ে তুলবেন এখানে। শালগ্রাম ধোয়ার সময় কাশি বাজানোর শব্দ পূবদিকে, পশ্চিম দিকে ,উত্তর দিকে, দক্ষিণ দিকে প্রায় এক কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। দুর্গাপূজাও এই পাঠশালায় আরম্ভ করেন এই গজেন্দ্রনাথ। কিন্তু এসব দিয়ে একটা শহর হয় না!
টংকে মহাজন ,সনন্ত মহাজন, মোহন মহাজন নামের তিনজন মহাজন থাকলে কী হবে, তাদের ট্রাকের ড্রাইভার গুলি পাঠশালায় শহরত্ব এনেছিল! হেমন্ত মহাজনের ছেলে শর্মা টকীজ বানালে কী হবে, সেই শর্মাটকীজে চম্পা সিনেমা না দেখা পর্যন্ত পাঠশালা শহরের তকমা লাভ করেনি।
একটা সময়ে পাঠশালার মধ্য দিয়ে যাওয়া মূল পথটার নাম ছিল’ গোঁসাই কমল আলি’। সেই ‘গোঁসাই কমল আলি’ নামটা ঢেকে পাঠশালা শহরের তকমা লাভ করার জন্য ‘ কলেজ রোড’ নামের একটি প্রলেপ লাগানো হল। অর্থাৎ কলকাতায় থাকা একটা পথের মতো শহরের নাম রাখা হল। কিন্তু সেই কলেজ রোডে চম্পা না হাঁটা পর্যন্ত পাঠশালার বাসিন্দারা পাঠশালায় শহরের মহিমা আনতে পারলেন না। তাই কলেজ রোডের মধ্য দিয়ে বেণী নাচাতে নাচাতে পায়ে হেঁটে যায় । তখনকার দিনে সালোয়ার আদির মতো পোশাক তখনও অসমে আসেনি। অন্তত পাঠশালায়! চম্পা একটা টকটকে লাল রং এবং গোলাপি রঙের কমদামি সিল্কের শাড়ি পরেছিল।
পাঠশালা শহরের যেখানে যাওয়া যায়— দেখা যাবে কোথাও না কোথাও মর্ম বেদনার মতো একজন শিক্ষক দাঁড়িয়ে থাকেই। শিক্ষকরা কলেজ রোডের সেই পাঠশালায় পিল পিল করতে থাকে! বজালী কলেজটা হওয়ার পরে অধ্যাপকও বেড়েছে প্রিন্সিপাল রাজেন্দ্র শর্মার উদ্যোগে। সত্য নারায়ণ পূজা করা পুরোহিতরা দিনে দিনে বেড়ে গেছে, মংলীয়া মালচন্দের নেতৃত্বে কয়েকটি মারোয়ারি পরিবার বৃদ্ধি পেয়েছে। বিহার থেকে কয়েকজন রাজমিস্ত্রি এসে রেলস্টেশনের আশেপাশে জমায়েত হয়েছে। একটা জৈন মন্দিরও হয়েছে। ঝুলন যাত্রায় গিয়ে রাহুল নিপা জিন্টুরা ঝুলনে বসে থাকা রাধা কৃষ্ণের ঝুলনের রশিটা টেনে আনন্দ পেয়েছে, ওদের জিভায় লাগল পৃথিবীর ভেতরে সবচেয়ে মিষ্টি বাতাসার স্বাদ…! মোটের উপর শিক্ষা ধর্ম আর ব্যাবসায়ের সমাহারে একটি বিরক্তিকর শহর হয়ে উঠতে চাইছিল পাঠশালা!
কিন্তু এই বিরক্তিকর প্রস্তাব থেকে পাঠশালাকে রক্ষা করেছিল একমাত্র চম্পা। চম্পা ছিল একা। তার কথা বলার সময় প্রত্যেকেই তাকে চম্পা রেন্ডি বলে উল্লেখ করেছিল। রাহুল তজোকে জিজ্ঞাসা করেছিল—-‘ রেন্ডি মানে কি?’
তজো বলেছিল—’ পয়সা দিলে প্রত্যেকেই যাকে করতে পারে( অশ্লীল)!’
চম্পার জন্য রাহুলের দুঃখ হয়েছিল।
প্রত্যেকেই চম্পাকে ঘৃণা করলে কী হল—রাস্তা দিয়ে একটা হাতি গেলে মানুষ যেভাবে পথে এসে দেখে, সেভাবে চম্পা যেখানে যায়, মানুষগুলি তার দিকে তাকিয়ে থাকে— দুটো পরিপূর্ণ স্তনে সুন্দর বুকটা, দুটি উজ্জ্বল চোখের তিরবির করতে থাকা, কথা বলা মুখটি তার, দেখে দেখে যেন পাঠশালার আশ মিটে না। কিন্তু পাঠশালা এরকম একটি শৈক্ষিক জায়গার নাম, যা গোঁসাই কমল আলিকে প্রলেপ মেখে কলেজ রোড করেছে, সেরকম একটি শহর বেশি সময় তাকিয়ে থাকতে পারে না চম্পা রেন্ডির দিকে!
গজেন্দ্রনাথের ভোরের সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠা রাহুল প্রায়ই দেখে কুয়াশার মধ্য দিয়ে আসা ট্রাক থেকে সিনেমা হলের সামনে চম্পা নামছে। আর কুয়াশার মধ্য দিয়ে দ্রুতগতিতে চলে যাচ্ছে। যেন সমারসেট মমের উপন্যাসের একটি চরিত্র! বিকেলের মালভর্তি ভারি ট্রাকে পাঠশালা থেকে নিয়ে যাওয়া চম্পাকে ভোরের খালি ট্রাকে পাঠশালাকে ফিরিয়ে দেয়। এখন পারলে সে বাড়িতে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেবে ! শাড়িগুলি রাখার জন্য একটা আলনা সহ ঘর রয়েছে । রাহুল ভাবে — ট্রাক ড্রাইভার রাতের রাত চম্পার সমস্ত কাপড় খুলে ফেললেও তাকে উলঙ্গ করতে পারবে না!
কেন জানা যায় না এই রাহুল কিশোরটি ভাবে বড়ো হতে তার অনেক বাকি। তাই এখনই একদিন চম্পা রেন্ডি তাকে পালিয়ে নিয়ে যাক। পাঠশালা ছেড়ে… বেনারসে। গজেন্দ্রনাথের মুখে সে শুনেছিল বেনারস একটি আধ্যাত্বিক শহর । আধ্যাত্বিক শহর মানেই ভগ্ন স্তুপের শহর! তার কোনো একটি ভগ্নস্তূপের ছায়ায় জড়োসড়ো হয়ে দুজন শুয়ে থাকে— চম্পা আর রাহুল…
দুজনেরই বেঁচে থাকার জন্য চাই অনেক ভালোবাসা। কেননা জীবন দুজনকেই ভালোভাবে ব্যবহার করেছে!

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top