রুশা চৌধুরীর কবিতাগুচ্ছ // দূরতম কোনো অজানা নক্ষত্রের কাছে

অভিমান

ভুল বা ভালোর আলোয় ভরা অল্পে
একটা শীতকাল, আর আদরের কিছু গল্পে;
আলোর বাতি হাত ফসকায় ছাদে
দাবানল জ্বলে জড়োসড়ো কিছু রোদে,
ধোঁয়ার চাদরে ঢেকে যায় সেই ছাদ
বছর শেষে বেদনার যত দাগ।
তবু ভালোবাসা বেঁচে যায় এই শীতে
একাকি বিকেলে আলোছায়া শুধু কাঁদে।

তারপর আসে বিষন্ন কিছু ছায়া
চরাচর জুড়ে আদরের উল বোনা
বুননে বুননে কার যেন নাম লেখা
সে লেখার ভাষা নয় তো তাহার জানা!
অভিধান খুলে, খুলে দ্যাখে সব স্মৃতি
বোঝে ভুলে গেছে কবে শেখা সব গীতি!
বাকি কিছু আশা তবুও পোড়ায় তাকে
কিছু ভুল পুড়ে, স্মৃতি শুধু মোমবাতি
মাঝরাতে কাঁদে ভুল, ভেসে যায় প্রীতি
কেউ থাকে, কেউ ভুলে যায় সম্প্রীতি!
ভুল জুড়ে কিছু রডোডেনড্রন ফোটে
যেমন ফুটত  ‘শেষের কবিতা’ জুড়ে!

শেষ হয় কেন? কেন শেষ হয় সব?
কেন কবিতার বুক জুড়ে কোলাহল?
কেন আকাশের বুক ঢেকে যায় মেঘে?
কেন ফাল্গুন ঢেকে থাকে শুধু রঙে?
কেন পুরানোকে সাজাই নতুন ঢঙে?
কেন প্রশ্নেরা শান্তি আনে না মনে?
এইসব কথা তোলা থাক আজ গানে,
সুর নাই থাক, বেজে যাক মনে প্রাণে
‘হৃদয় আকাশ’….নামে যদি কিছু থাকে
ভরে যাক আজ শুধু কুয়াশার গানে;
সে গানের সুরে অমরাবতীর আলো
কেউ না বাসুক আমি যে বেসেছি ভালো।

পুনর্জন্ম

রাত্রির প্রথম প্রহর,
পাখিদের হালকা কথামালা শেষে
নীল আকাশে কালপুরুষের উজ্জ্বলতা,
সুখনিদ্রায় তন্দ্রাচ্ছন্ন ক্লান্ত মানুষ।

ঠিক তখনই,
অভ্রভেদী স্বর্গের সোপান বেয়ে ‘তার’ পুনর্জন্ম হলো।
নিমেষের দান মুগ্ধ কান্নার মীড় হয়ে বাজছিল প্রাণে
ব্যস্ততা ছিল খুব,
পুননির্মাণের জন্য বরাদ্দ সামান্য কিছু মুহূর্তে
সাজাতে হবে নিযুত স্মৃতির মিনার।
মধ্যরাত থেকে সূর্যোদয়…
এটুকু সময় বরাদ্দ থাকে প্রতিবার।

আনকোরা ভোর, মন্দ্র স্বরে ডাক দিয়ে যায় ‘তাকে’…
পথ জুড়ে দ্যুতিময় গুচ্ছগুচ্ছ লাল, সবুজ, হলুদ,
এমনকি কিছু বেগুনী- নীলও আছে ।
সেই রঙ কিছু কুড়িয়ে, কিছু এড়িয়ে, পথে নেমেছে
নানা বয়সী মানুষ।
আনন্দিত মুখোশ আটা ঝলমলে মুখগুলো।
শরীর ছাড়িয়ে হৃদয়ে ছুঁয়ে যায় সেই রঙের ছোঁয়া।
এতো রোশনাই আর উল্লাসে স্মৃতিরা এসে
বারবার ছুঁয়ে যায় ‘তাকে’!

কোথা থেকে এলো সে? কেমন সেই জন্মকথা?

নিটোল, মসৃণ, আলোকিত সময়,
সে জন্ম থেকে পায়নি।
আজও সেইসব দিন থমকে আছে,
দূরতম কোনো অজানা নক্ষত্রের কাছে।

নবজন্মের সেই ভয়ানক জঠর যন্ত্রণা, জীবন, ভালবাসা, রক্ত।
আত্মাহুতি মাটি, শরীর, মন, মননের…
সব হারিয়ে, সেই কাঙ্খিত অমোঘ জন্ম
প্রসব বেদনার থেকেও আনন্দময় সে কষ্ট ।

স্মৃতির তোরঙ্গ খুলে অনাদিকালের
মলিন শাড়ীটা শরীরে জড়ায় সে
বন্ধ চোখর পাতায় অজানা ঘ্রাণ……..
মলিন ভাঁজে ভাঁজে
ফেলে আসা অযুত নিযুত গল্প
বহু দ্বিধাগ্রস্ত চিঠি, না ফেরা  সন্তান
মৃত স্বজন, যোদ্ধা, ধর্ষিতা
মুখ ফেরানো আপনজন।
সব তার ভীষণ আপনার।
পরম মমতায়,
সে শরীরে জড়িয়ে নেয় গল্পগুলো।

সেখানে, সেই সব অভিমন্যুর কথা ,
যাদের  সপ্তরথে ছিল শুধুই ভালোবাসা,
অদম্য সাহস রক্ষাকবচ।
চক্রবুহ্য ভেদের রহস্য অজানা
তবু হার মানল না।

বন্ধ চোখ মনে করায় সেইসব মুখ।

এমন ভালবাসার সমুদ্র মন্থনেই
এ’দেশে তার অমৃত জন্ম হয় বারবার
এলোচুল বেঁধে চোখ ফেরায় সে
পরম মমতায়,
বেঁচে থাকা সন্তানদের দিকে।
ভালোবাসার নিঃশ্বাস বয়ে যায়,
বাতাস হয়ে, স্বপ্নের মতো দেশটির বুক জুড়ে।

 দেশ

পুনর্জন্মের বহু আগেই
সে জন্মেছিল।
তবু আজ,
সকাল থেকেই পাখিরা তাদের
হালকা কথাগুলো
খুব দ্রুত শেষ  করে নিয়েছে।
এখন খুব ব্যস্ততার সুরে
তারা একটা আনকোরা নতুন গান গাইছে।

পথ জুড়ে আজ শুধু  গুচ্ছগুচ্ছ লাল,
সবুজ, হলুদ, নীল আলোর সাজ।

সেই রঙের কিছু কুড়িয়ে, কিছু এড়িয়ে
হেটে যাচ্ছে নানা বয়সী মানুষ।
তাদের মুখোশ আটা
মুখগুলোতেও আজ উজ্জ্বল আভা।
সবার হাতে, মুখে, চোখে বা মনে
একটু হলেও
আজ রঙের ছোঁয়া।

অনেক কথা আজ বারবার মনে পড়ছে তার।
নিটোল, মসৃণ, এমন আলোকময় জীবন….
সে তো জন্ম থেকে পায়নি।
তার সে সময় যেন থমকে আছে আজো,
দূরতম কোনো এক নক্ষত্রের কাছে।

নবজন্মের প্রস্তুতির সেই ভয়ানক জঠর যন্ত্রণা।
জীবন, ভালবাসা, রক্ত, আত্মাহুতি, কী নেই তাতে?
সেই কাঙ্খিত জন্মের অমোঘ বার্তা,
প্রসব বেদনার মতোই,
আনন্দময় এক কষ্ট ছিলো যেন।

সে আজ তার স্মৃতির বাক্স থেকে বহু পুরনো
একটা শাড়ী বের করে শরীরে জড়ায়।
চোখ বন্ধ করে ঘ্রাণ নেয়……..
সেখানে ফেলে আসা গল্পেরা
সব ভাজে ভাজে সাজানো।
লক্ষ, লক্ষ গল্প……

বহু দ্বিধাগ্রস্ত চিঠি, না ফেরা  সন্তান
মৃত স্বজন, সাহসী যোদ্ধা, ধর্ষিতা মা, বোন,
মুখ ফিরিয়ে নেয়া আপনজন।
সবগুলো গল্পই তার বড্ড আপন, চেনা।
সে শরীরে জড়িয়ে নেয় সেই গল্পগুলো
পরম মমতায়।

সেই যে অভিমন্যুদের দল,
যাদের  সপ্তরথ ছিলো না,
ছিলো শুধু ভালবাসা।
রক্ষাকবচ  ছিলো না, ছিলো অদম্য সাহস।
দুচোখ বন্ধ করে সে মনে করে তাদের কথা।

এই সব ভালবাসার সমুদ্র মন্থন করেই
তার এই অমৃত জন্ম।
এলোচুল বেধে সে চোখ মেলে চায়
পরম মমতায়,
তার বেঁচে থাকা সন্তানদের দিকে।
ভালোবাসার নিঃশ্বাস বয়ে যায়,
বাতাস হয়ে, দেশ জুড়ে।

উজ্জীবন

বেলাশেষের বাঁশি বেজে উঠে
কনে দেখা আলোয় হেঁটে যায় তারা,
সে হাসিতে কবেকার ফেলে আসা দিনের আলো,
গোধূলিকে ছুঁয়ে যায় তারা একবার
তারপর, শূন্য চরাচরে নতুন করে রাত্রি নামে।

সেই নিবিড় আঁধারে ঝিঁঝিঁ পোকার গান
জোনাকির শরীর নিঙড়ানো আলো
মানুষের অন্ধকার আদর,
টুকরো কিছু ভালোবাসাও থাকে।
ফেলে দেয়া ভাতের কনা চেটে নেয়ার আগে
কুকুরটা হাঁক ছাড়ে,
কাঁথার ওমের সাথে মায়ের ওম খোঁজে শিশু।
মলিন রাতে
সধবার লাল চুড়ি ভাঙার শব্দ মেশে
সফেদ ভোরে লাল মোরগের ডাকে।

লালচে আকাশ তার রঙ ফিরে পায় যখন
বর্ণমালার দল ফিরে আসে আবার
কলসের গায়ে চালগুঁড়োর আলপনা,
ভাঙা চুড়ি কাদায়, পুঁই বীজের রং ঠোঁটে,
মোরগ ঠনঠন ফুল খসে পড়ে চুল থেকে,
মৌরির গন্ধে মেশে হাসি!
শুকনো পায়ের ছাপে রঙ দেয়-
মান্দার, নাঁটার ফুল।
ভিজে উঠবার আগে
সেই পথ নিঃশ্বাস ফেলে!
প্রান্তর জুড়ে জেগে থাকে সময়
জীবন জেগে উঠে বারবার।

খেলাঘর

কল্পনার ছবিটাকে
বুক থেকে কোলে নামিয়ে,আবার বুকে জড়ায়।
এক অসহ্য টান প্রায়ই এমন টানে,
টেনে নিতে চায় তাকে।
ফেলে আসা  মায়ের টানের মতো,
বসন্ত দিনের মধুর হাওয়ার মতো,
প্রাণবধুর জন্য হাহাকারের মতো,
বিদায়বেলায় ছেড়ে যাওয়া স্পর্শের মতো
যেতেই হবে কিন্তু, ঠিকানাই জানা নেই তার।

না গেলে কত কিছু বাকি থেকে যাবে…
নতুন গোলাপী পেয়ালায় সোনালী চা,
ফুলেরা সুপ্রভাত বলে যাবে,
বর্ষার নরম নীলমণিলতার অদেখা রূপ
ঝরে যাবে বাদল দিনের প্রথম কদম
খয়েরী দোতালা বাড়িটা অচেনা থেকে যাবে
থেমে থেমে একটানা ডেকে যাওয়া ভুলে যাবে কোকিলটা!
এই সবকিছু একটুও গায়ে মাখে না সে,
শুধু এক নিষ্ঠুর উদাসীনতা গ্রাস করে তাকে।

অভিমানের মূল্য ছিল না কোনো,
তাই আজকাল সবার মনে খুব
অভিমান জাগিয়ে তুলতে ইচ্ছে করে।
শ্রাবণের গন্ধমাখা এই উদাস বসন্ত দিনে
এমন কথামালা ভীষণ অবান্তর – অবাস্তব
তবু ভাবনারা রঙিন এক খেলা খেলে যায়
অভিমানের সাথে, হারিয়ে ফেলবার সাথে,
নির্বিশেষ জীবন আর একাকী নিজের সাথে।
খেলে যায় সে খেলা আপন মনে!

এ খেলাই,
খেলাঘর বাঁধতে শিখেছিল অদৃশ্য গোপন সুতোয়।

এ কালের রূপকথা

আলস্যের গহ্বরে ঘাসফুল ঢাকা ছায়াপথ
কিছু চেনা মুখের গল্প
ঘাসের মাথায় অপরূপ মেঘ,
সাতমহলা প্রাসাদ
প্রাসাদচূড়ায় টুনটুনি’র বাসা।
সে..ই পাখিটা
যে ‘একশ পনের’ বছর আগে
বেগুন গাছে সংসার করত!

একটু দূরেই নয়নতারার শরীর জুড়ে
নীল অন্ধকার, দলছুট পিঁপড়ে
গর্বিত চড়ুইকে খোঁজে দিনভর,
স্বজাতির হিংসায় অভিমানি বাবুই
আজকাল বাসা বোনে না।
বিশাল কারখানায় কঙ্কাবতী,
মনিমালা, কিরণমালারা
কাপড় সেলাই করে।

বাড়ি ফেরার সংকীর্ণ পথের ধারে
অন্ধকারে ঘাপটি মেরে থাকে
অরুণ বরুণ ডালিমকুমারেরা
সামান্য সুযোগে বাবুই কিরণ কঙ্কাবতীর
সর্বস্ব কেড়ে নেয়ার খেলা।
আঁচড়ে কামড়ে নর্দমায় ছুঁড়ে মেরে
যুগ যুগ ধরে মলাটবন্দি রাজকুমার
থাকার শোধ তুলে নেয়!
অবরুদ্ধ রাতের অট্টহাসি শেষে
বিবস্ত্র সকাল আসে,কেটে যায় বছর।
ওদের বেকসুর খালাস দেয়ার আগে
পরচুলাটা ঠিকঠাক করে নিয়ে
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ‘ইওর অনার’!

মাটির তলায় জেগে থাকে
স্বপ্নের ছাই মনিমালার
ছাদের কার্নিশ ছুঁয়ে নিচে পড়বার আগে
বাবুই হয়ে ওঠে নয়নতারা
চোখ থেকে অশ্রু গড়ায়
যেখানে ফোঁটায় ফোঁটায় মিশে থাকে
কালচে সবুজ ভালোবাসা!

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top