১৪
কেউ পোড়ে কেউ পোড়ায়
কারোর পোড়া সামনে,
আজ যে পোড়ায়
কাল সে পোড়ে
পিছন থেকে সামনে!
রাতে দিপেন একা একা গজগজ করতে থাকে।সুবোধ আধশোয়া হয়ে বিড়ি টানছে।চুলোর আগুনে কয়েকটা মিষ্টি আলু দেয়া,
দিপেন : এরাম কল্লি কাজ করা যায়? ছুটিছাটা দেবে না। মাসে তিরিশ দিন খাইটে মরো। এট্টু ছুটি চালি গালিগালাজ। ক্যান নিজের নায় বউ মইরে ভূত। বাড়ি যাবার টান নেই। আমাগের তো বউ সংসার আছে?
সুবোধ বিড়ি এগিয়ে দিয়ে চুলর কয়লায় আলু খোঁচাতে থাকে।
সুবোধ : নে টান।
দিপেন : আলু পালা কুয়ানে?
সুবোধ : হে হে। দেছে।
দিপেন : খিডা?
সুবোধ : আছে আছে। লোক আছে। দেয়ার লোক আছে।
দিপেন : কোন ছেমড়ি দিছে সেইডে কও। ছিমড়া কেউ দিই নি যে বুঝিছি।
সুবোধ : কলি চিনবি?
দিপেন : তা না চিনি তাতে কি? তুমি তো বড়শি ফেলায়ে খালি ছিমড়ি তোলো।
সুবোধ : যে দেছে তারে দেখলি তোর মাথা ঘোরবে। ফাইন চিহারা।
দিপেন : আমার যা ঘুরার ঘুইরে গেইছে। তুমি এহন ঘুরোও।
কাঠিতে গেঁথে একটা গরম আলু তুলে দিপেনের শিশ্নের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে সুবোধ বলে, ন্যে খা!
১৫/১
ডাকার মতন ডাকলে তিনি
আপনা হতে আসেন।
রাতের অন্ধকারের মধ্যে খচমচ শব্দ হয়। একটা ছোট্ট পাল নিয়ে কেউ একজন হাজির হয়।
মঙ্গল : খিডা ওহেনে?
হরিপদ : কারো পাল আসলো মনে হচ্ছে কাকা?
মঙ্গল : খিয়াল রাখ। দেখিস অন্য কেউ না হয়।
দিনেশ এগিয়ে আসে। হাতে লাঠি তুলে নেয়। একটা শান্ত গলার স্বর ডাক দেয়।
আনন্দ : মঙ্গল আছো নাকি? মঙ্গল সর্দার?
মঙ্গল দুপা এগিয়ে গিয়েই দেখে আনন্দ ঠাকুরের মুখ ভেসে উঠেছে। মঙ্গল হামলে গিয়ে প্রানাম করতে যায় আনন্দ ঠাকুর তাকে বুকে ধরে। সবাই স্তম্ভীত হয়ে যায়।
মঙ্গল : হা ভগবান। এ কিরাম লীলে?
আনন্দ : আরে করো কী করো কী।
মঙ্গল : যারে আমি খুঁইজে মরি সে এম্নি ধরা দেয়? তুমি কি ঠাকুর সত্যিই অন্তর্যামী?
আনন্দ : তা জানি না, তয় টের পালাম সুতোর টান। তাই আসলাম।
মঙ্গল : অথচ আমি লোক পাঠায়েও খুঁইজে পাইনি তোমারে।
আনন্দ মুচকি হাসে। উত্তর দেয় না। মধু হিজড়ের দিকে তাকিয়ে মঙ্গল বলে,
মঙ্গল : ও খিডা ঠাকুর? লোক নেছো পালে?
আনন্দ : ওর নাম হচ্ছে মধু। হিজড়ে। পথে আমার সাথে দেহা। কলো আমার সাথে যাবে। আমি কলাম, ন্যে চল্। যাতি থাউক। দেহি কদ্দূর যায়।
মঙ্গল হাঁক দেয়,
মঙ্গল : হেঁই সুবোধ, হুঁকো সাঁজ। খাবার দে।
আনন্দ : ব্যস্ত হয়ো না। আস্তে ধীরে করো। তোমাগের সাথে অন্ন সেবা নেবো। থাকপো কয়দিন। আস্তে ধীরে করো।
১৫/২
নয়নে নয়ন রাখি
দেখি উড়ে পাখি!
মধু হিজড়ে আর সুবোধ মুখোমুখি হয়। সুবোধের হাতে হুঁকো। কল্কে দিয়ে ধোঁয়া উঠছে। তারা দুজন দুজনের চোখের মধ্যে ডুবে যায়। যেন রাধা-কৃষ্ণের লীলাচক্র ঘুরতে থাকে তাদের চারপাশে আর খোলের বাজনা বাজে।
১৫/৩
সঙ্গে তোমার কেউ যাবে না
তাই তো সঙ্গ করা,
আমারে তোমার মধ্যে ধরা।
আনন্দ ঠাকুর গাঁজা কুঁচোচ্ছে ছোট্ট একটা পিড়ির উপর। অন্যরা তাকে ঘের দিয়ে বসে। মঙ্গল আনন্দের গা ঘেঁষে বসে আছে। দূরে মধু আর সুবোধ।
মঙ্গল : এহন তুমি ছাড়া পালের এই অসুখ সারানোর অন্য কোন উপায় নেই। এট্টা ব্যবস্থা নেও।
আনন্দ কল্কেতে গাঁজা পুরে মঙ্গলের দিকে এগিয়ে দেয়।
আনন্দ : ধরাও।
মঙ্গল পরম আরাধ্যে কল্কে স্পর্শ করে। অন্যরা তাদের দুজনকে দেখতে থাকে।
১৫/৪
মন রাখি কার হাতে?
যে আজলা পেতে ধরে?
তার হাতেও না-রে!
রান্নার চুলোর পাশে মধু হিজড়ে আর সুবোধ। একটা মাখোমাখো অবস্থায় আছে তারা দুজন চুলোর পাশে পোড়া আলু।
মধু : আলু পোড়া তোর ভাল্লাগে?
সুবোধ : না। তয় খিদে লাগ্লি সব ভাল্লাগে।
মধু : তাই নাকি রে? সব কিছু?
সুবোধ : তুমি কলাম জম্মের ফাজিল।
মধু : আমারে ভাল্লাগে না?
সুবোধ : জম্মের।
মধু : ইস।
সুবোধ : আমারে কিরাম লাগে তোমার?
মধু : তোর যে আলুর দোষ আছে সেডা তো বোঝাই যায় ঐ পোড়া আলু গুলো দেখলি। হি হি হি
সুবোধ : ওরে না একজোন দেলো তাই পোড়ালাম।
মধু : কে দিয়েছে রে? কোন মাগী?
সুবোধ : তুমি জাইনলে কি কইরে?
মধু : ও জানা যায়। তুই কি প্রেম ছাড়া থাকতে পারিস নাকি।
সুবোধ : ওরে না। আসলে হয়ে গেইছে বুইঝলে?
মধু : মাখিছিস গায়ে?
সুবোধ : ধুর।
মধু : এট্টু এট্টু তাই না?
সুবোধ : ওরে বাবা না। সে তোমার মতন।
মধু : মানে? হিজড়ে নাকি? তোর কি হিজড়ে রাশি?
সুবোধ : ওরে আমি কী এইরে বুঝোই। বলতিছি তুমি যিরাম কাওড়া না হয়ে আমাগের মধ্যি আইসে জুটিছো সেইরাম।
মধু : অন্য জাতের মেয়ে?
সুবোধ : হয়।
মধু : সর্বনাশ। কারো বউ নাকি?
সুবোধ : না, আবার হয়। মানে স্বামী বিবাগী হইছে অনেক বচ্ছর।
মধু : ও। আমার চেয়ে সুন্দর তাই না?
সুবোধ : কি যন্ত্রণা তুমি ইরাম কত্তিছো ক্যান?
মধু : হিংসেয়। হা হা হা।
১৫/৫
যেই চান্দে মন কান্দে
সেই চান্দে ছিঁড়ে ঘর,
পায়ে ঠেলে যাই সংসার!
আনন্দ ঠাকুর গান ধরেছে পোটলা থেকে একটা জুড়ি বের করে। সবাই মগ্ন। আকাশে চান্দ তিরতির করে কাঁপছে।
মরি ভাবনায় কোন দেশে যায়
আমার এ দেহ চরণে চরণ
ধুলিপথে এঁকে চিহ্ন আজ
যে আমি ছিলাম (কাল) সে তো হারায়ে যায়!
অকাজের গাছে জল দিয়ে হায়
দিনমণি গেলে চাঁদ এসে যায়
কাজ তবু কিছু হল না সারা
মন ভরে ফুল ফুটেছে যাতনায়!
কোনদিকে আজ শেষ হল কাজ
খুলে ফেলো মন গুপ্ত সুপ্ত ভাঁজ
মায়া জল মাটি কোরে মাখামাখি
মায়ার ফাঁদ ধরে নেমে এলো সাঁঝ!
দিনেশ হুহু স্বরে কেন্দে ওঠে। অন্যদেরও মনে বিবাগী হাওয়া লাগে। আনন্দ ঠাকুর শান্ত স্বরে সবাইকে ঘুমিয়ে যেতে বলে, নিজের শোবার আয়োজন করে। মঙ্গল সর্দার থম মেরে থাকে, তার ঘোর যেন কাটে না।
১৬
এমন মন্ত্র তুমি
নিদান আমার,
ভরসার সিন্দুক মানি
তোমারে আমার!
ভোরে আনন্দ ঠাকুর পালের মধ্যে ধীর পায়ে হাঁটছে আর হাতের লাঠি দিয়ে একেকটা শুয়োরের গায়ে খোঁচা মারতেই সেই শুয়োরাটাকে তুলে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে আদালা করে। আনন্দ ঠাকুর মঙ্গলের হাত ধরে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ছে। সামনে ধুপ জ্বলছে। একপাশে হরিপদ পালে ছেড়ে দেয়া মালিকের মানতের শুয়োরটা ধরে আছে ঘেটি চেপে। চোখ খুলে আনন্দ একটা সুতো একটা রক্ত ভেজানো কাপড় গিট দিয়ে শূয়রটার গলায় বেঁধে দেয়। আর একটা টুকরো একটা পলথিনে পেঁচিয়ে পুটুলি বানিয়ে মঙ্গলের বাজুতে বেন্ধে দেয়।
ঠাকুর বলে,
আনন্দ : পাল দুই ভাগে ভাগ কইরে দিলাম। আগামী পনেরো দিন পাল দুইভাগে আলাদা চড়বে। রাতে থাকপে আলাদা। দুই পালের কাওড়া কেউ কারোর সঙ্গে মেলামেশা করবে না কাছের থে।
মঙ্গল : তারপর ঠাকুর?
আনন্দ : দেহা যাক। দেবি প্রসন্ন হলি তোর কপালের থে মরা নাম্বে। নালি আরও যন্ত্রাণা।
মঙ্গল : তালি কি করবো?
আনন্দ : বললাম তো যা বলার। জন্মালি যন্ত্রণা বয়ে যাতি হবে, আবার যন্ত্রণা আছে বইলে তোর আমার দেখাসাক্ষাৎ আছে। যন্ত্রণা না থাকলি তো রাজত্ব শেষ, জ্বরার মরা।
মঙ্গলের চোখ দিয়ে জল পড়ে।
আনন্দ : ন্যে পাল মাঠে ন্যে যা।
মঙ্গল ইশারা দেয়। অসুস্থ পাল্টা নিয়ে যায় দিনেশ। অন্যটা হরিপদ। দুইদিকে যায় তারা। ঠাকুরের পাশে বসে থাকে মঙ্গল।
মঙ্গল : তুমি কিন্তু ঠাকুর আজকে থাইকে যাবা।
আনন্দ : নাহ। পাল ন্যে বের হবো। যদি মন চায় ফেরব। না চালি ফেরব না।
মঙ্গল : একসাথে দুপুরে চাইরডে ভাত খাতাম।
আনন্দ : আজকেই শেষ দেহা না তোর আমার।
মঙ্গল : তুমি কী আর গিরামে যাবা না?
আনন্দ : যে দায়িত্ব ঘাড়ে দেছে তা ফেইলে যাবার উপায় কই? সব কাইড়ে নিয়ে এই বানাইছে আমারে। আমি কেম্নে যাবো ক?
মঙ্গল : বুঝি না আমি। তয় তুমি আছো বইলে ফাঁকা ফাঁকা বিলের মদ্দি মনে হয় আমি আছি। একা লাগে না।
আনন্দ : তোর মাইয়েডা আছে ভালো?
মঙ্গল : আছে। নাতিনডারে নিয়ে আছে। উরা নাতিনডারে ন্যে যায় বছরে কয়েকবার।
আনন্দ : ভালো তো। এমন যত্ন কয়জন করে?
মঙ্গল : ভাবতিছি ঠাকুর…
আনন্দ : কী?
মঙ্গল : মাইয়েডারে এট্টা বিয়ে দেবো।
আনন্দ : আচ্ছা।
মঙ্গল : আমার পালে রান্ধে যেই কাওড়া, সুবোধ, ওরে ভাবিছি মনে মনে। ছেলে খারাপ না। সামনের বছর আমিও পাল নামাবো। ওর এট্টা হিল্লে হয়ে যাবেনে।
মঙ্গল : তোমার কি মত?
আনন্দ মুচকি হাসে শুধু।
মঙ্গল : হাসো ক্যান ঠাকুর?
আনন্দ : এম্নিই।
মঙ্গল : বুঝি নি।
আনন্দ : কে যে কী শিকার করতিছে আমরা কী তার জানি ছাতারমাথা?
মঙ্গল বুঝতে না পারার চোখে তাকিয়ে থাকে।
কাওড়ামঙ্গল (পর্ব ৩) II রোমেল রহমান