পৃথিবীর সবচেয়ে নীচু জায়গা ডেড সি – রঙিন এক মৃতসাগর // ক্ষমা মাহমুদ

আশ্চর্য রকমের শান্ত, স্থির, ঢেউহীন, সবুজাভ নীল রঙের বিশাল এক পানির আধার, শেষ বিকেলের স্নিগ্ধ সূর্যরশ্মি পড়ে ঝিকমিক করছে! কমলা রঙা বিষন্ন আলোর সাথে সবুজাভ নীল রঙের মিলনে যে চিত্র তৈরি হয়েছে তাকে এই পৃথিবীর সাধারণ কোন পানির রঙ বলে মনে হয় না, কেমন যেন অপার্থিব, অন্য ভুবনের কিছু বলে মনে হয়। ঢেউ এর পর ঢেউ এসে ফেনা তুলে তটে এসে মিলিয়ে যাচ্ছে না, এমনকি জলের বুকে নেই কোন উথাল পাতাল ঢেউয়ের মাতামাতি, বুঝি ধ্যানমগ্ন এক বিষন্ন মৌনী যোগী! পুরো পরিবেশের থম ধরা সৌন্দর্য দেখে ভাস্কর রদ্যার সেই অসাধারণ ভাস্কর্য ‘দি থিংকার’ এর কথা আমার মনে পড়ে গেল- থুতনিতে হাত দিয়ে চুপ করে ধ্যানস্থ হয়ে বসে শুধু ভেবেই যাচ্ছেন যিনি! এমন এক জায়গায় বসে এই জগত আর তার বিচিত্র সবকিছু নিয়ে বুঝি ভেবে ভেবে সারা হওয়াই সাজে! রামাদা রিসোর্টের ব্যলকনি থেকে পৃথিবী বিখ্যাত ডেড সি বা মৃত সাগরকে প্রথম দেখে আমার ঠিক এমনই মনে হয়েছিল।

পেট্রা থেকে বেশ অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এসে দুপুর যায় যায় মুহূর্তে আমাদের বারোজনের নারী দলটি ডেড সি সংলগ্ন রামাদা রিসোর্টে এসে নেমেছি দুদিনের জন্যে। রুমে ঢুকে বিশাল কাঁচ দেয়া জানালার পর্দা সরিয়ে দিতেই লাগোয়া বড় বারান্দা দেখে আমি একেবারে মুগ্ধ, দুটো চেয়ারও সেখানে পেতে রাখা আছে-তাড়াতাড়ি গ্লাসটা খুলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই থমকে গেলাম শেষ বিকেলের আলোয় সামনে মৃত সাগরের এমন রঙীন চেহারা দেখে! এটা আসলে রিসোর্টের পেছন দিক, যার সামনের বেশ বড় এলাকা ধরে বালিয়াড়ি আর মরুভূমির মত কিছু অংশ, তার পরেই সেই নীলকান্তমণি রঙের পানি, সোনার মত চিকচিক করছে – শেষ বিকেলের কনে দেখা আলো সেই সৌন্দর্যকে যেন কয়েকশো গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। বালিয়াড়ি জুড়েই কিছুদূর পরপর সবুজ গাছপালা আর ঘাসের আলামত আছে, তার মধ্যেই কিছু উট আর ঘোড়া এদিক সেদিক চরে বেড়াচ্ছে। সমতল ভূমির মানুষ আমাদের চোখে সে দৃশ্য খুব অচেনা আর অন্যরকমের বলে মনে হয়।

ব্যলকনি থেকে প্রথম দেখা ডেড সি

প্রথমদিন পুরো বিকেল-সন্ধ্যেটা দূর থেকেই এভাবে হোটেলের ব্যলকনি থেকে এই ঐতিহাসিক সাগর দেখে কাটালাম যতক্ষণ না দিনের আলো একেবারে মিলিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে দেখি একটা চড়ুই পাখিও এসে বসলো কিচির মিচির করতে করতে আমার কাছে, দূর দেশে দেশী চড়ুই দেখে বড় আপন মনে হলো তাকে। এক অচেনা দেশের অজানা বালিয়াড়ির ফিরোজা জলের কার্পেটে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসা দেখলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, চড়ুইপাখিটা ছিল আমার সঙ্গী, বাকী সব চরাচর, নির্বাক, স্তব্ধ!

রাতে সাগরের পাড়ে আমি বা আমার সঙ্গীরা কেউ গেল না – বিশাল রিসোর্টের মধ্যেই ঘুরে ফিরে রাতের খাওয়া সেরে সবাই ঘুম, পেট্রা থেকে বেশ অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি… সবারই বিশ্রাম দরকার। সাগর থেকে রিসোর্ট বেশি দূরে নয়, আমাদের কক্সবাজার হলে এমন জায়গা থেকে ঢেউয়ের শব্দ শোনা যেত- এখানে তো ঢেউই নেই শব্দ তো আরো দূর কা বাত।

রিসোর্টের সামনে ঘুরে বেড়ানোর সময় স্টাফদের সাথে কথায় কথায় জানতে পারলাম ডেড সির ওপারেই জেরুজালেম আর প্যালেস্টাইন; এখান থেকে জেরুজালেম নগরীর দূরত্ব মাত্র ১৫ মাইল। মৃত সাগরের পূর্ব সীমান্তে রয়েছে জর্ডান এবং পশ্চিম সীমান্তে যথাক্রমে ইসরাইল ও প্যালেস্টাইন। তথ্যটা জানা ছিল না তাই এত অবাক হলাম যে বলার মত নয় সেই সাথে খুবই শিহরিতও হলাম! প্যালেস্টাইন, জেরুজালেম এত কাছে! বুঝতে শেখার পর থেকেই আমরা ইয়াসির আরাফাতের প্যালেস্টাইন সংকটের সাথে পরিচিত। কি অত্যাচারই চলছে এই জনপদের উপরে বছরের পর বছর ধরে! আমার কৈশোর বয়সে বাড়িতে বড় বড় পোস্টার লাগানোর চল ছিল- মনে পড়ে আমাদের একটা শোবার ঘরে, আমি আর আমার ভাই, প্যালেস্টাইনের দুটো দেবশিশুর মত বাচ্চা ছেলে ও মেয়ের চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে গন্ড বেয়ে- এমন দুটো পোস্টার লাগিয়ে রেখেছিলাম বেশ অনেকদিন ধরে। সেই প্যালেস্টাইনের সীমানা আমি এই হোটেল থেকে দেখতে পাচ্ছি ভাবতেই অদ্ভুত লাগছিল। রাতের বেলা রামাদা রিসোর্টের ব্যলকনি থেকে দূরে তাকিয়ে জর্ডানের বর্ডারের ওপারে প্যালেস্টাইনের শত শত বাতিগুলো চোখে পড়ে সত্যি এক অদ্ভুত অনুভূতি তৈরি হচ্ছিলো মনের ভেতরে। এমন কোন ব্যাপার ছিল আমার কল্পনারও বাইরে। মূলত মনুষ্য তৈরি পৃথিবীর সপ্তমাশ্চর্যের অন্যতম এক আকর্ষণ পেট্রা দেখার জন্যে জর্ডানে এসেছি, কিন্তু আসার পর এই দেশের ব্যাপারে যতই জানছি ততই অবাক হয়ে যাচ্ছি। ঐতিহাসিক ভাবে এই দেশের এত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান জানা ছিল না, বহূবছর ধরে জেনে আসা বহু ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক বিষয়গুলোর সাথে এই দেশের ভূ-অবস্থানগত সম্পৃক্ততা যে এত ঘনিষ্ঠ সেটাও এত বিশদভাবে জানা ছিল না, তাই যত জানছি মনে হচ্ছে নিজের অজান্তেই আমি যেন মণিমানিক্যের এক অজানা খনি আবিষ্কার করে ফেলেছি, যার ভেতর থেকে একের পর এক খুবই ঐতিহাসিক আর মূল্যবান সব জায়গার খোঁজ পাচ্ছি!

ব্যলকনির পেছনে ফিরোজা নীল পানির মৃত সাগর

পরদিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। বারান্দা যেন পা দুটোকে টেনে নিয়ে গেল সেখানে। রবিমামার আভা ছড়ানো গোটা ফিরোজা কার্পেটের জলের উপর, কি অদ্ভুত সুন্দর সেই দৃশ্য! কোথাও কোন শব্দ নেই। এত ভোরে হোটেলের সবকিছুই শুনশান, নিশ্চুপ। একা দাঁড়িয়ে মৃত সাগরের ধারে সূর্য ওঠা দেখার সেই শান্ত, নির্জন অভিজ্ঞতার সাক্ষী হওয়া এই জীবনে পরম পাওয়া।

বেলা একটু বাড়তেই প্রাতরাশের দিকে গেলাম। রামাদার বিশাল ডাইনিং হলে বুফে ব্রেকফাস্ট সারি দিয়ে সাজানো। দারুণ সুন্দর দুজন অল্পবয়স্ক আরব ছেলে বেশ খেলাচ্ছলে ডিমের অমলেট শূন্যে তুলে দিয়ে খপ করে আবার ফ্রাইপ্যানের মধ্যে নিয়ে নিজেদের বাহাদুরি দেখাচ্ছে, রকমারি ক্যাপসিক্যাম, টমেটো, পেয়াজ কুচি, নানা রকম মশলা হালকা মিশিয়ে ডিমের ওমলেট বানিয়ে দিচ্ছে এক এক জনের প্লেটে- দেখে খুব মজা লাগলো।

জর্ডানের যেখানেই ঘুরছি মানুষগুলেকে আমার খুব উষ্ণ মনে হয়েছে, বেশ হাসিখুশী, অথচ শুনেছিলাম আরবরা নাকি বেশ উগ্র এবং রাগী প্রকৃতির হয়। আমার ছয় দিনের জর্ডান ভ্রমণের অভিজ্ঞতার সাথে বিষয়টা তেমন মেলেনি। আমাদের দলের অন্যরাও আস্তে ধীরে নাস্তার টেবিলে আসতে শুরু করলো। ধীরে সুস্থে গল্পে আড্ডায় প্রাতরাশ সেরে সবাই ডেড সি সৈকতে যাওয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। রিসোর্টের পেছন দিকে ছড়িয়ে আছে মৃতসাগরের সৈকত। সেদিক দিয়ে দল বেধে সবাই বের হতেই চোখে পড়লো সারি দিয়ে লাগানো গোলাপী রঙের রক্ত করবী ফুল গাছের ঝাড় আর তার চারপাশে আরাম করে বসার সুন্দর আয়োজন। ঝলমলে রোদেলা সকালে পর্যটকরা বিশাল রিসোর্ট জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরাম করছে, গল্প করছে, মগ্ন হয়ে আছে ছুটির আমেজে। এত পরিচিত ফুল এখানে দেখে চোখের ও মনের মুগ্ধতা আরো বাড়লো- সামনেই বালুর রাজ্য তার ওপাশেই ফিরোজা নীল রঙের টলটলে পানি।

সাগরের দিকে একটা মিনিবাস বা কোস্টার ধরনের গাড়ি কিছুক্ষণ পরপরই টুরিস্টদের আনা নেয়া করছে। আমরা পায়ে হেঁটেই বালুময় রাস্তায় চলা শুরু করলাম। মার্চের মাঝামাঝিতেও এখানে যথেষ্টই ঠান্ডা এবং হাঁটা পথের প্রবল বাতাসে আমাদের রোদ ঠেকানোর ছাতা বারবারই কুপোকাত হয়ে পড়ছিল যদিও রোদ ঠেকানোর কোন দরকারই ছিলনা। শীতের রোদ যথেষ্টই মিষ্টি আর ভিটামিন ডি’র যোগানদাতা, যা গায়ে লাগানোই তো উচিত।

হাঁটতে হাঁটতে সাগরতটে পৌঁছতেই, ও হরি! এ যে এলাহি অবস্থা। সমুদ্রতট সারা পৃথিবী থেকে আসা পর্যটকে ঠাসা! তারপরও অবশ্য আমাদের কক্সবাজারের মত অবস্থা নয়, যথেষ্টই প্রশস্ত চারপাশ। রামাদার নিজস্ব সৈকত এটা, তাই মনে হচ্ছে রিসোর্ট থেকে বেশিরভাগ মানুষই চলে এসেছে এখানে আর তাদের বড় একটা অংশ শরীরে কাদা লাগানো নিয়ে মহাব্যস্ত। বেশ বড় বড় সব পাত্রে এখানে ওখানে কাদা নরম করে রাখা হয়েছে ক্রিমের মত আর সেখান থেকে কাদা নিয়ে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সারা শরীরে ক্রিম মেখে কাদার ভাস্কর্য সাজছে। আসল ব্যাপারটা হলো, অনেকেই বিশ্বাস করে যে, এই সাগরের মাটিতে রোগ নিরাময়ের উপাদান আছে। চর্মরোগের চিকিৎসায় এ কাদামাটি ব্যবহার করা হয় আর ত্বকের জন্যেও নাকি এই কাদা দারুণ ভালো- সে কারণে হাজার হাজার পর্যটক সমস্ত শরীরে কাদা লাগিয়ে ত্বকের পরিচর্যা করতে এখানে আসে। তো সেই ত্বক ভালো রাখার জন্যে কাদা নিয়ে যা চলছে এখানে, তাকে জলকেলি না বলে কাদাকেলি বলাই শ্রেয়।ছেলে, বুড়ো, ছুঁড়ি, বুড়ি- সব বয়সের মানুষ এই ভরদুপুরেও সারা গায়ে কাদা মেখে রোদে শুয়ে আছে। পর্যটকরা প্রাকৃতিক প্রসাধনী হিসেবে এই কাদা গায়ে মেখে সূর্যস্নান করে কারণ এই অঞ্চলে অতি বেগুনী রশ্মির স্বল্পতা সূর্যস্নানের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে।

অনেকেই সূর্যস্নান শেষ করে সাতার কাটছে বা পানির উপরে আরাম করে ভেসে রয়েছে – ভেসে না থেকে উপায় নেই, চাইলেও এখানে কেউ ডুবতে পারবে না। ইন্টারনেটে একটা ছবি খুবই পরিচিত, ডেড সি’র পানিতে শুয়ে একজন পত্রিকা পড়ছে! কাদা ও পানি নিয়ে একেবারে অন্যরকম এক তেলেসমাতি এখানে!

ছবি- ইন্টারনেট

শোনা যায় এই মরুসাগরের কাদার ভেষজ গুণের কারণে স্বয়ং রাণী ক্লিওপেট্রা এই কাদা মিশরে নিয়ে গিয়ে রূপচর্চা করতেন! প্রাচীনকাল থেকেই এই হ্রদটি মিশরের মমি তৈরির জন্য, সার উৎপাদনের জন্য পটাশসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক খনিজ পদার্থের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এখানকার এই লবনাক্ত কাদা ঔষধী এবং প্রসাধনী গুনের কারনে এবং এই হ্রদ থেকে পাওয়া লবণ ও খনিজ পদার্থ বিভিন্ন প্রসাধনী ও সুগন্ধি দ্রব্য তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। জর্ডানের দোকানগুলোর যেখানেই গিয়েছি সেখানেই দেখেছি ‘ডেড সী’ প্রসাধন সামগ্রীতে ভরপুর, যথেষ্ট দাম দিয়েই লোকজন সেগুলো কিনছে।

তবে সমুদ্রের কাছে এসে দূর থেকে দেখা সেই সবুজাভ নীল ফিরোজা রঙের পরিবর্তে বেশ ঘোলা পানিই দেখলাম, আর ঢেউও যে একেবারে নেই, সেটা নয় – ছোট ছোট ঢেউ ভালোই আছে। দূর থেকে দেখা সেই অতিপ্রাকৃত ছবিটাকে এখন যেন শুধু ছবিই মনে হলো – বাস্তবে চেহারা বেশ অন্যরকম। দূর থেকে দেখা আর কাছ থেকে দেখার মধ্যে যে কত পার্থক্য থাকে তা আর একবার মালুম হলো।

সাঁতার জানিনা বলে আমার পানি ভীতি যথেষ্ট, এখানে ডুবে যাওয়ার ভয় না থাকলেও পানিতে নেমে হুটোপুটি করার চেয়ে দাঁড়িয়ে থেকে এদের কান্ডকারখানা দেখতেই বরং ভালো লাগছিল। ডেড সি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র, যেখানে সারা বিশ্ব থেকে প্রতিদিন শত শত পর্যটক আসে। এই সাগরের উৎপত্তি নিয়ে যে কত গল্প, লোককথা, উপকথা প্রচলিত রয়েছে, দাঁড়িয়ে চারদিক দেখতে দেখতে সেসবই মনে পড়লো। যেমন, অনেককাল আগে ফেদেরা নামে এক রাজার রাজ্য  ছিল এই সমুদ্রের পাশেই। সর্বগ্রাসী সমুদ্রকে সন্তুষ্ট করতে প্রতি ছয় বছরে উৎসর্গ করা হতো চারজন প্রজাকে। উঁচু পাহাড় থেকে তাদের ছুঁড়ে ফেলা হতো সমুদ্রের পানিতে। এমনি একবছর চারজন প্রজাকে বাছাই করা হল। প্রথম তিনজনকে উৎসর্গ করা হল কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই কিন্তু বিপত্তি ঘটলো চতুর্থ জনের বেলায়, সে এতই মোটা ও ভারি ছিল যে রাজার একার পক্ষে কিছুতেই তাকে ঠেলে ফেলা সম্ভব হচ্ছিল না। কিছু সহযোগীকে ডাকা হল, তারা লোকটিকে এত জোরে ধাক্কা দিল যে রাজার নিজেরই পা ফসকে গেল। তিনি পাহাড়ের একটি পাথর আঁকড়ে ধরে রাখলেন এবং প্রচণ্ড ঘামতে লাগলেন, অবশেষে পাথরটি ছুটে গেলে সরাসরি সমুদ্রের পানিতে পড়ে গেলেন। শাস্তি হিসেবে সমুদ্রের দেবতা পোসাইডন তাকে পানির নীচে পাঁচ ঘন্টা জীবিত রেখেছিলেন, এরপর থেকেই এই সমুদ্র পরিচিতি পায় ডেড সি বা মৃত সাগর নামে।

ইসলাম ধর্মেও মৃত সাগরের উল্লেখ আছে। পবিত্র কোরআন ও হাদিস অনুযায়ী- হযরত লুত (আঃ) এর জাতি পার্থিব উন্নতির চরম উৎকর্ষে পৌঁছে, চরম বিলাসিতায় গা ভাসিয়েছিল, সীমালঙ্ঘনের দিক দিয়ে তাদের আগের গজবপ্রাপ্ত জাতিগুলোকেও তারা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আল্লাহ হযরত লুত (আঃ) কে তার জাতির জন্যে সতর্ককারী নবী মনোনীত করে, আল্লাহকে ভয় করে তাদের এসব কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিলেন। হযরত লুত (আঃ) দীর্ঘ সময় ধরে সতর্ক করার পরও যখন তাদের পরিবর্তন হল না তখন আল্লাহ চুড়ান্ত বিপর্যয়ের মাধ্যমে সডম ও গোমারাহ নামের সমগ্র এলাকা উল্টিয়ে দেন, আকাশ থেকে একভাবে বৃষ্টি ও পাথর বর্ষণ করে এ জনপদের চার লাখ মানুষকে বাস্তুভিটাসহ বিধ্বস্ত করে দেন। আরো বলা হয়, জিবরাঈল ফেরেস্তা তার দুই ডানা শাদুর ও এর আশপাশের এলাকার মাটিতে প্রবেশ করে সম্পূর্ন এলাকাটি শূন্যে তুলে ধরে উপর থেকে নীচে এবং নীচ থেকে উপরে সজোরে ফেলে দেয়, ফলে সাগরের সৃষ্টি হয়। প্রায় ছয় হাজার বছর আগের ঘটনা এটা। কোরআনের বর্ণনা অনুযায়ী বর্তমান মৃত সাগর বা ডেড সি হলো, হযরত লুত এর জাতির সেই বাসস্থান যেখানে তাদেরকে ধ্বংস করা হয়েছিলো।

এতো গেল এই জায়গা নিয়ে নানান গল্প কথা, তবে বলাই বাহুল্য, মৃত সাগরের সবচেয়ে মজার ব্যাপারই হলো পানির উপরে এই ভেসে থাকা; হাত-পা ছোঁড়ার কোন দরকার নেই, শুধু চিৎপটাং হয়ে শুয়ে থাকলেই হলো। আসলে ব্যাপারটা হলো, এই সাগরের পানির লবনাক্ততার কারণে কোন প্রাণি এখানে টিকে থাকতে পারেনা।

বিজ্ঞানীদের মতে, প্রায় ২০ লাখ বছর আগে মৃত সাগরের উৎপত্তি। সাগর বলা হলেও এটি মূলত: একটি হাইপারস্যালাইন হ্রদ যার সর্বোচ্চ গভীরতা ৩০৪ মিটার। এই সাগরের পানিতে লবনাক্ততার পরিমান সমুদ্রের পানির চেয়ে আট গুণ বেশী। লবনাক্তত পরিবেশে জলজ প্রাণীরা জীবনধারণ করতে পারেনা বলেই এই সাগরে কোন প্রাণীর বাস নেই বললেই চলে। আর এ কারণেই এর নাম মৃতসাগর। তবে নামেই ‘মৃত সাগর’, শত চেষ্টা করলেও কিছুতেই এখানে মরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই, ধাক্কা মেরে ঠেলে উপরে পাঠিয়ে দেবে কারণ লবনাক্ততা বেশি হওয়ার কারণে পানির প্লবতা অনেক বেশি। গুগল আপা ঘেটে ঘুটে দেখলাম, প্লবতা হচ্ছে বস্তুর উপর প্রযুক্ত পানির উর্ধ্বমুখী বল। কোনো বস্তু পানিতে ডুবানো হলে বস্তুর ওজন নিচের দিকে একটা বল প্রয়োগ করে। পানিও বস্তুকে উপরের দিকে বল প্রয়োগ করে। যদি বস্তুর ওজন বেশি হয় বস্তু ডুবে যায়, আর প্লবতা বেশি হলে বস্তু ভেসে থাকে। মৃত সাগরের পানির প্লবতা এতই বেশি যে বস্তুর ওজন অনেক বেশি হলেও বস্তুকে ঢুকানো বেশ কঠিন। প্লবতা শক্তির কারণেই এই সাগরে কোনো কিছু ডোবে না, যে কেউ মৃত সাগরের পানিতে ভেসে থাকতে পারে। তবে বর্ষাকালে পানির পরিমাণ বাড়লে লবনাক্ততা কমে কিছু ব্যাকটেরিয়ার জন্য বাস যোগ্য হয়ে ওঠে।

সমুদ্রতীরে এসেই দেখেছি বেশ বড়সড় একটা সাইনবোর্ডে লেখা- You Are At The Lowest Point On Earth. এই ব্যাপারও একদমই জানা ছিল না। সাধারণত কোন জায়গায় ঘুরতে গেলে, সেটা সম্পর্কে একটু লেখাপড়ার করে যাওয়া আমার অভ্যাস কিন্তু এবার আসার আগের নানান ব্যস্ততায় সেই লেখাপড়ার বিষয়টা কমই হয়েছে তাই প্রতি পদে পদে আমি অবাকও হচ্ছি বেশি। জর্ডান ঘুরতে এসে এখনও পর্যন্ত এত নতুন সব বিষয় জানা হচ্ছে, এমন সব অভিজ্ঞতা হচ্ছে যা আসলে আমি কল্পনাও করিনি- ভ্রমণ যে মানুষের জ্ঞানচক্ষুর উন্মিলন ঘটায় তা আবারো বেশ বুঝতে পারলুম। গুগল দেখালো, আমাদের এই রামাদা রিসোর্ট সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩৫০ মিটার নীচে আর এর তটে যেতে আরো ১০০ মিটার নামতে হয়। মৃতসাগরের পৃষ্ঠভাগ ও তীরদেশ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪২৯ মিটার নিচে অবস্থিত, তাই একে ভূপৃষ্ঠের সবচেয়ে নীচু জায়গা হিসেবে গণ্য করা হয় আর সেখানেই, না জানতেই এসে দাঁড়িয়েছি আমি!

আরো কিছু তথ্য জেনে খুবই চমৎকৃত হলাম, যেমন মৃত সাগর প্রাণীর জীবনধারণের জন্য অনুপযোগী হলেও এই স্থান বর্তমানে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার অন্যতম কেন্দ্রস্থল এবং মানুষের শরীরের জন্য অত্যন্ত আরামদায়ক। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক নীচুতে অবস্থানের কারণে পৃথিবীর অন্য যেকোন স্থানের তুলনায় এখানে অক্সিজেনের মাত্রা প্রায় ১০ শতাংশ বেশী আর এখানকার বাতাস প্রাকৃতিক ভাবেই উৎফুল্লকারক। এতক্ষণে বুঝলাম কেন সবাই এত হাসিখুশী হয়ে আছে এখানে! বিশেষ করে শ্বাস কষ্টে কষ্ট পাওয়া মানুষের জন্যে এখানকার বায়ুমন্ডলীয় চাপ বেশ উপকারী। এখানে পরাগ ও এলার্জি উৎপাদক দ্রব্যের উপস্থিতি খুবই কম, আর নীচু জায়গা হওয়ার কারণে  সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মির প্রভাবও কম। এছাড়াও উচ্চ ভূমণ্ডলীয় চাপ, উচ্চ বায়ুমণ্ডলীয় চাপ, আর বিভিন্ন ধরণের খনিজ পদার্থের বিপুল উপস্থিতি রোগ নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে মৃত সাগরকে বর্তমানে চিকিৎসাশাস্ত্রের অন্যতম গবেষণা ক্ষেত্র হিসেবে গণ্য করা হয়।

পূব দিকে জর্ডান এবং পশ্চিম সীমান্তে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের অবস্থানের কারণে ভূ- রাজনৈতিক দিক থেকেও কি অসাধারণ একটা জায়গায় এই সাগরের অবস্থান সেটা ভেবেও তাজ্জব হতে হয়। অল্প কিছু ইতিহাস জেনে, মূলত পেট্রা শহর দেখার জন্যে এই জায়গায় এসেছি কিন্তু এত নতুন কিছুর সাথে একসাথে পরিচয় হলো যে, এখানে ভ্রমণের এই সিদ্ধান্তকে আমার জীবনের সেরা সিদ্ধান্ত বলে মনে হয়েছে সবসময়। তবে আসার পরে ঘুরে বেড়ানোর ফাঁকে নানান তথ্য ঘেটে এই মৃতসাগরের জন্যে আমার কি যে দুঃখবোধ হলো তা আর বলার নয়। আমরা ভাবি, আমরাই বুঝি আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ বা ঐতিহাসিক স্থাপনা গুলোর যত্ন করিনা। আসলে পশ্চিমা দেশগুলো এবং তাদের দোসর দেশগুলো ছাড়া বাকী বিশ্বের সবকিছুই মনে হয় অযত্নে আর অবহেলায় আছে আর এর পেছনে এসব জায়গা থেকে শুধু মুনাফা তুলে নেয়ার পশ্চিমা ধান্ধার ভূমিকা ষোলো আনা।

মৃত সাগর নিয়ে বিভিন্ন লেখা থেকে জানলাম, এই এলাকা প্রাকৃতিক সম্পদের আধার এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে পশ্চিমা মদদপুষ্ট ইসরায়েল এখান থেকে বিপুল পরিমাণ মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ তুলে নিচ্ছে অকাতরে। ১৯৬০ এর দশকে ইসরায়েল মৃতসাগরে পতিত জর্ডান নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে দেয়। এরপর জর্ডানও তাদের ইয়ারমুখ নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে দিলে কার্যত মৃত সাগর আবদ্ধ হয়ে পড়ে, বাইরের কোন প্রাকৃতিক পানির উৎস তখন থেকে মৃতসাগরে গিয়ে আর পড়েনি। প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৫ মিটার করে এ সাগরের জলের স্তর নীচে নামতে নামতে বিগত মাত্র ৫০ বছরে এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪০০ মিটারেরও বেশী নীচে নেমে গেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে নীচু স্থান দিন দিন আরো নীচু থেকে নীচু হয়ে যাচ্ছে। সমুদ্রের পানি কমে যাওয়ার সাথে সাথে বেড়ে গেছে এই পানিতে লবনের পরিমান। এর কোন প্রাকৃতিক শাখা প্রশাখা না থাকায় শুধুমাত্র সূর্যের তাপে এর পানি বাষ্প হয়ে উড়ে যাচ্ছে কিন্তু পানি বাষ্প হয়ে উড়ে গেলেও এতে দ্রবীভূত লবন তলানি হিসেবে পড়ে থাকে। ফলে দিনদিন এটি পৃথিবীর সবচেয়ে লবনাক্ত পানিতে পরিণত হচ্ছে। খনিজ উপাদানে ভরপুর, ভৌগলিকভাবে অনুপম, এ সাগর বর্তমানে মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, ভাবা যায়!

ইসরায়েল ও জর্ডান মৃত সাগর সংরক্ষণ করার ব্যাপারেও এখনও পর্যন্ত একসাথে কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি; বরং এর পাড়ে কে কত বেশি অবকাঠামো গড়ে তুলতে পারবে তা নিয়ে এই দুদেশের  মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। এখানকার খনিজ সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করছে মৃত সাগর পাড়ের এই দুই দেশ। এর জলে মিশে থাকা পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালসিয়াম এবং লবন আহরণের জন্য ইসরায়েল ও জর্ডানের দুই পাড়েই গড়ে উঠেছে অসংখ্য কারখানা, যার কাঁচামালের জন্যে সাগরের মূল্যবান পানি কৃত্রিমভাবে খনন করা খালের মাধ্যমে প্রবাহিত করা হয়। অগভীর এসব খালে প্রবাহিত সমুদ্র জল সূর্যের তাপে দ্রুত বাষ্প হয়ে যায়—আর নীচে তলানি হিসেবে পড়ে থাকে মূল্যবান খনিজ লবণ।দুই  দেশের জন্যেই এটি অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা। কিন্তু সামান্য ব্যবসায়িক মুনাফার জন্যে এই দুই দেশের কারখানাগুলো মৃত সাগরের প্রায় অর্ধেক জল অতি দ্রুত বাষ্প করে উড়িয়ে দিয়েছে । মৃতসাগরের পাড়ে বিশৃঙ্খল ভাবে গড়ে ওঠা এই সব শিল্প কারখানার কারণে দিন দিন আরো হুমকির মুখে পড়ছে এই হ্রদটি।

বিগত কয়েক শতাব্দীতে মৃতসাগরের আয়তনও পরিবর্তিত হয়েছে আশংকাজনকভাবে। বর্তমানে এ সাগরের গভীরতা সবচেয়ে কম। অতীতে বহূবার এর গভীরতা কমে গেলেও তা আবার বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা ছিল কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী এ সাগরের বৃদ্ধির আর কোন সুযোগ নেই কারণ অস্বাভাবিক মাত্রায় এর খনিজ সম্পদ আহরণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে একে ধ্বংস করার পেছনে  সবচেয়ে জঘন্য ভূমিকা পালন করছে মধ্যপ্রাচ্যের ভূঁইফোড় রাষ্ট্র ইসরায়েল । উনিশ শতকের শেষের দিকে ইউরোপ থেকে আসা ইহূদিরা ফিলিস্তিন ভূখন্ডে বিট্রিশদের সক্রিয় সহায়তায় ইসরায়েল রাষ্ট্র গড়ে তোলার পর থেকেই এ অঞ্চলে অশান্তি লেগেই আছে। এটা সেই জনপদ এই মুহূর্তে ইসরায়েলিরা যে এলাকার খুব কাছেই গাজাবাসীদের জীবনে নরক গুলজার করে তুলেছে।

যে তথ্য পেয়ে সবচেয়ে অবাক হলাম সেটা হলো যে আমাদের দেশের মতই, এখানেও প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রেখে এই সাগরকে কেন্দ্র করে পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্যে কোন সঠিক পরিকল্পনা নেই। খেয়াল খুশীমত এখানে গড়ে তোলা হয়েছে বিলাসবহুল সব স্থাপনা,হোটেল, মোটেল ইত্যাদি। আমি নিজেও এমন একটা হোটেলের দুইদিনের বাসিন্দা হয়েছি সেটা মনে করে একটা অপরাধবোধ কাজ করা শুরু হলো। কিন্তু আবার ভাবলাম কিছুই কি আছে আমাদের হাতে? ডেড সি’র এই ক্ষতির পেছনে পৃথিবীর সব বড় বড় চক্র রয়েছে, আমরা অসহায় সাধারণ মানুষেরা তাদের ক্ষমতার দাপটের কাছে একবারেই পাপেট, দাবার বড়ে ছাড়া আর কিছুই নই।

অসহায় হয়ে ভাবি, পশ্চিমা বিশ্ব তাদের অঞ্চলগুলোকে বেহেস্ত বানিয়ে রেখেছে, কোন দেশের এতটুকু ক্ষমতা নেই তাদের দেশের উপর চড়াও হয়ে তাদের ভূ-খন্ডের কোন ক্ষতি করে,  কিন্তু নিজেদেরকে সুসভ্য দাবি করা এই সব দেশগুলোর ধুরন্ধর রাজনীতিবিদরা নিজেদের ভূখন্ডের বাইরের সমস্ত জায়গাগুলোর উপর তাদের খেয়াল খুশীমত ধ্বংস, লুটতরাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতার আকর, মধ্যপ্রাচ্য যেন এদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য। সেই দিনের দিকেই আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকি যেদিন পৃথিবী নামক গ্রহটার মানুষের শুভবুদ্ধির উদয় হবে আর পৃথিবীর এসব মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদগুলোকে মিলিতভাবে তারা রক্ষণাবেক্ষণ করবে।

যা হোক, যথেষ্ট জল ও কাদাকেলি করে, আমাদের দলের সবাই বেশ পরিশ্রান্ত হয়ে আস্তে আস্তে রামাদার দিকে ফিরতে শুরু করলো। রিসোর্টে ঢোকার আগেই কয়েকটা জায়গা রাখা হয়েছে যেন সবাই কাদা পরিষ্কার করে তবেই ভেতরে ঢোকে। আমিও ফিরে যাওয়ার আগে  ঢেউয়ের সাথে গড়িয়ে আসা কতগলো রংবেরঙের ছোট ছোট পাথর নিয়ে এলাম এই ঐতিহাসিক, মহামূল্যবান সাগরের একটু স্মৃতি হিসেবে।

মধ্যাহ্ন ভোজনের পর আরেকটা গোটা বিকেল সন্ধ্যে পাওয়া গেল এখানে কেননা পরদিন সকালেই এখান থেকে সোজা রাঝধানী আম্মান এবং সেখান থেকে আমাদের দেশে ফেরার ব্যবস্থা। ভেবেছিলাম হোটেলে আবদ্ধ না থেকে এই সময়টা ডেড সির আশেপাশে যেয়ে আরো একটু ঘুরে দেখবো কিন্তু একা এত অজানা যায়গায় সেটা আর সম্ভব হলো না। রিসোর্টটাও বেশ একটু বিরান জায়গায়, গাড়ি না থাকলে বের হওয়া মুশকিল। আমাদের গাড়িকে বলে দেওয়া হয়েছে সকালে এসে একবারে তুলে নেবে আমাদের। পরিকল্পনাটুকু যদি আগে থেকে করতে পারতাম তাহলে হয়তো আশপাশের অঞ্চল আরো একটু বেশী দেখতে পারতাম। সন্ধ্যাটা ছিল স্বাধীন- যার যার মত করে কাটাবে সবাই। দলের কেউই আর বাইরে বের না হওয়ায় যোগ দিলাম শিশা খাওয়ার আয়োজনে, যা এখানে খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার, কিন্তু আমার মন চাচ্ছিলো এদিক ওদিক যেয়ে স্থানীয় মানুষ আর লোকালয় দেখতে। বিভিন্ন জায়গায় পড়েছি, কোনদিকে জানি রয়েছে ইজরায়েলের কাঁটাতারের বেড়া, কোন এক রাস্তা আছে যার একপাশে মৃত সাগর আরেক পাশে বিচিত্র সব পাহাড়। মনে পড়লো, ডেড সি নিয়ে নেটে ঘাটাঘাটি করার সময় দেখেছিলাম একজন তার ব্লগে লিখেছেন, ‘হোটেল আর রিসোর্টগুলো থেকে মৃতসাগরের যথার্থ মাহাত্ম্য অনুভব করা যায় না। অন্তত চোখে দেখে আর দু-দশটা সাধারণ হ্রদের থেকে এর পার্থক্য করা যায় না। ডেড সী’র তীর বরাবর একটা রাস্তা চলে গেছে দক্ষিণ পানে। সেই রাস্তা ধরে মাইল দশেক নিচের দিকে এলে এর রূপ খোলতাই হয়। পাড়ের কাছে লবণ জমে জমে কতকটা স্ট্যালাকটাইট আর স্ট্যালাগমাইটের মত ভূমিরূপ তৈরি করেছে। তার ওপর দিয়ে খালি পায়ে চলতে গেলে পা কেটে ফালা ফালা হবার জোগাড় হয়, বেশিক্ষণ সেখানে থাকা কষ্টকর, গা-হাত-পা জ্বালা করে, অস্বস্তি হয়। কিন্তু হ্রদের দিকে তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায়। ফিরোজা রঙের জলের মাঝে মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা লবণের স্তূপগুলো দেখলে মনে হয় কোন অপ্সরা যেন তাঁর কল্কা করা নীল শাড়িখানি মেলে দিয়েছেন শুকোবার জন্য। সে দৃশ্য এতই সুন্দর এবং অবাস্তব যে মনে হয়, যে কোন মুহুর্তে সুন্দরী শাড়িখানা গুটিয়ে নিয়ে সমস্ত কিছু ঘুচিয়ে দেবেন।’ – রিসোর্টে বসে শিশা সন্ধ্যা কাটানোর ফাঁকে আমার মন পড়ে রইলো ঐ অদেখা ‘ফিরোজা রঙের জলের মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা লবণের স্তূপগুলো’র মাঝে!

——-

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top