লেনিন ।। পর্ব-১৭ ।। আশানুর রহমান

সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরের রেল স্টেশন থেকে দক্ষিণ দিকে নেভেস্কি প্রসপেক্ট ধরে নেভা নদীর দিকে এগোতে থাকলে শীত প্রাসাদের বেশ খানিকটা আগে হাতের বামে অনেকটা জায়গা নিয়ে তৈরী হয়েছে ভলোকভো সিমেট্রি। সেই সিমেট্রির লুথেরিয়ান অংশে ওলগার অন্তেষ্টিক্রিয়া শেষে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত মারিয়া আলেকজান্দ্রাভনাকে নিয়ে ভ্লাদিমির ফিরলো সামারায়। ওলগার কফিন নিয়ে সিমেট্রিকে গেলে ওখানকার কর্তৃপক্ষ জানতে চেয়েছিল ওলগার বাপ্টাইজড করা হয়েছিল কিনা। উত্তরে মারিয়া আলেকজান্দ্রাভনা বলেছিলেন,

-হ্যাঁ, অর্থোডক্স ক্রিশ্চিয়ান হিসাবে। কিন্তু আমি চাই তাকে লুথেরিয়ান ক্রিশ্চিয়ান হিসাবে কবর দিতে।

কর্তৃপক্ষ রাজী হতে চায়নি। তাদের কাছে সেটা ছিল একধরণের অনিয়ম। কিন্তু ভ্লাদিমির লক্ষ্য করে অবাক হয়েছিল ঐ রকম শোক এবং মানসিক যন্ত্রণার মুহূর্তেও তার মা নিশ্চল পাহাড়ের মত নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। দাফন করতে দেরী হচ্ছিল, কর্তৃপক্ষ তাকে বুঝানোর চেষ্টা করে বিফল হয়ে শেষ পর্যন্ত মেনে নিলেন। ওলগাকে দাফন করা হলো লুথেরিয়ান ক্রিশ্চিয়ান হিসাবেই। ভ্লাদিমিরের কাছে কে লুথেরিয়ান আর কে অর্থোডক্স সেটা অর্থহীন মনে হলেও এমন একটি চরম বিপদের মুখে দাঁড়িয়েও মায়ের সেই দৃঢ়তা এবং নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকবার বিশাল ক্ষমতা তাকে মুগ্ধ করেছিল। ভ্লাদিমির লক্ষ্য করেছিল যে নিজের মত করে ভাবার, জীবন-যাপন করার মুল্য মায়ের কাছে অনেক। কে কি ভাবলো, তাদের বড়লোক আত্মীয়রা কিভাবে নিল তাতে যেন তার মায়ের কিছুই যায় আসে না। আরো একটা জিনিষ আবিষ্কার করে সে চমকিত হয়েছিল যে, ওলগার এই দুঃখজনক মৃত্যুটাও মা সামলে নিলেন অবিশ্বাস্যভাবে। ভ্লাদিমির ভাবলো, আত্মনিয়ন্ত্রণ তাহলে কি উলিয়ানভ পরিবারের স্বভাবগত? সে নিজেও তো ওলিয়ার জন্য চোখের পানি ফেলেনি? ওলিয়ার এমন মৃত্যুটাও কি সেও স্বাভাবিকভাবে মেনে নিচ্ছে না?

মানুষের শোকের আয়ু কি তাহলে সত্যিই কম? সামারায় ফিরে এসে পরিবারে যে শোকের আবহ তৈরী হয়েছিল, ভ্লাদিমির দেখলো কয়েকদিন যেতে না যেতেই সবকিছু আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করলো। দিমিত্রি ও মিত্তিয়া স্কুলে যাওয়া শুরু করলো, আন্না স্কুল শিক্ষক হবার জন্য নির্ধারিত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকলো, মার্ক এলিজারভ সকালে অফিসে যেতে থাকে নিয়ম করেই। ভ্লাদিমির নিজেও আবার পুরাতন সার্কেলে যেতে শুরু করে। আর সেখানেই একদিন পরিচয় হল মারিয়া ইভানোভনা ইয়াসনেভার সাথে। উজ্জ্বল, আকর্ষনীয় চোহারার মারিয়াকে দেখে তার বয়স অনুমান করা কঠিন। সে তার নির্বাসনের মেয়াদ পূর্ণ করতে সম্প্রতি সামারায় এসেছে। ভ্লাদিমিরের ধারণা হল মারিয়া তার থেকে কয়েক বছরের বড়ই হবে কিন্তু ঠিক কতটা সে সেটা অনুমান করতে পারছে না। মারিয়া হাসে, অনর্গল কথা বলে, তার কথা বলার সাথে সাথে তার মুখের রঙ পাল্টে যায়-ঠিক যেন শরতের মেঘের মত-এই হাসিখুশি তো পরক্ষণেই গম্ভীর। সেদিন আড্ডা শেষে মারিয়ার সাথে হাঁটতে হাঁটতে যখন ভ্লাদিমির তার বাসার দিকে যাচ্ছিল, কথাবার্তার এক পর্যায়ে ভ্লাদিমির বুঝতে পারে যে মারিয়ার চিন্তাভাবনায় জ্যাকোবিয়ানদের প্রভাব মারাত্বক। ভ্লাদিমির তাই ঠাট্টা করে তাকে বলল,

-আপনার কথা শুনলে মনে হয় আপনি একজন জ্যাকুবিয়ান। কথাটা কি ঠিক?

ভ্লাদিমিরের কথায় মারিয়া হো হো করে হাসতে হাসতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর ভ্লাদিমিরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,

-আড্ডায় গত কয়েকদিন ধরে তোমার কথা শুনে আমার কি মনে হয়েছে জানো?

-কি?

-রাগ করবে না তো?

-রাগ করবো কেন?

-ভ্লাদিমির অনেক সময় তোমার কথা শুনে মনে হয় তুমি দ্বিতীয় বাকুনিন।

কথাটা মারিয়া এমনভাবে বললো যে তার কথায় দু’জনেই হেসে উঠলো।

আস্তে আস্তে তাদের দু’জনের মধ্যে ভাল সম্পর্ক তৈরী হতে থাকে এবং ভ্লাদিমির লক্ষ্য করে দেখলো চিন্তা-ভাবনায় তারা মোটামুটি কাছাকাছি। ফলে ভ্লাদিমির মারিয়াকে আস্তে আস্তে মার্কসের চিন্তার কাছাকাছি নিয়ে এলো খুব সহজেই। অল্পদিনেই সামারার সার্কেলগুলো তাদের দু’জনকেই মার্কসবাদী হিসাবে চিনে গেল। ভ্লাদিমিরের পরের পরীক্ষাগুলো আবার সেপ্টেম্বরে শুরু হবে। হাতে অবসর। এদিকে মারিয়া আলেকজান্দ্রাভনা সন্তানদের ভবিষ্যৎ চিন্তায় আগে যেমনটা উদ্বিগ্ন থাকতেন ওলগার মৃত্যুর পর যেন সেখান থেকে সরে এলেন। তিনি দেখলেন সন্তানরা তার পছন্দ মত হবে না ফলে তাদেরকে তাদের মত করে বেড়ে উঠতে দেয়ায় ভাল। আর তিনি এটাও ভাবলেন ভ্লাদিমির যেহেতু তার গ্রুপ এবং রাজনৈতিক ভাবনা ছাড়বে না তাহলে বরং সেগুলো চোখের সামনেই ঘটুক। তাই তিনি একদিন ভ্লাদিমিরের গ্রুপের কয়েকজনকে চায়ের দাওয়াত দিলেন। আলেক্সই, মি. ও মিসেস অ্যাপোলন-তারা কাজানে নির্বাসনে ছিলেন এবং মারিয়া ইভানোভনাও বাদ গেল না। ভ্লাদিমিরদের বাসায় এসে মারিয়া এতটাই হৈ চৈ করতে লাগলো যে দেখা গেল চা খাবার সময় সে কাপড়ে চা ফেললো, মেঝেতে জ্যাম ফেললো, আর পুরো সময়টা এক দন্ড চুপ করে থাকতে পারলো না। রান্নাঘরে মাকে এটো বাসনপত্র দিতে গিয়ে ভ্লাদিমির জিজ্ঞেস করলো,

-মাম্মাচুকা, মারিয়া ইভানোভকা অনেকটা আমাদের ওলিয়ার মত, না?

কথাটা শুনে মারিয়া আলেকজান্দ্রানা একটু চুপ করে গেলেন। তারপর হেসে বললেন,

-আমি এই মাত্র ভেবে দেখলাম, সে ঠিক তোমার মত।

ভ্লাদিমির কোন কথা না বলে ফিরে গেলো। অন্য সবাই ততক্ষণে চলে গেছে। মারিয়া ইভানোভকা ভ্লাদিমিরের জন্যই অপেক্ষা করছিল। ভ্লাদিমিরই তাকে বলেছিল পৌঁছে দেবে। আকাশে তখন শুক্ল পক্ষের চাঁদ। একটা ফাঁকা মাঠের পাশে এসে মারিয়া দাঁড়িয়ে পড়ল। ভ্লাদিমির তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই সে বললো,

-মাঝে মাঝে আমি কি ভাবি জানো?

ভ্লাদিমির কোন কথা না বলে তার মুখের দিকে তাকায়। চাঁদের আলোয়, ফাঁকা মাঠের সামনে মারিয়াকে যেন রহস্যময়ী এক নারী মনে হল। সে মারিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে আর দূরের চাঁদের দিকে তাকিয়ে মারিয়া বলল,

-মনে হয় আমি যেন গ্রীক পুরাণের সেই সব নিন্দিত মানুষগুলোর একজন। তখন মনে হয় একটা ভারী হাতুড়ি দিয়ে বিশাল মিথ্যার পাথরগুলো চূর্ণ-বিচূর্ণ করতে থাকি-যতক্ষণ না পর্যন্ত সত্যের কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারি।

ভ্লাদিমিরের মনে হল, সেও তো এমন করেই ভাবে। সে নিজেও তো সত্যের কেন্দ্রে পৌঁছাতে চায়। সেই মূহুর্তে তার মনে হল মারিয়া যেন তারই মত। ভ্লাদিমিরের মুগ্ধ চোখের দিকে চেয়ে মারিয়া তার হাতটা ধরে ভ্লাদিমিরকে কাছে টেনে নিল। ভ্লাদিমির নিজের বুকের মধ্যে দ্রিম দ্রিম শব্দ শুনতে পেল। আর মারিয়া ভ্লাদিমিরকে জড়িয়ে ধরে শুক্লপক্ষে চাঁদ দেখতে লাগলো।

ক্রমশঃ মারিয়া ইভানোভকা এবং ভ্লাদিমির মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। মারিয়ার অনুরোধে সেও তাকে তুমি করে বলতে শুরু করে। একদিন এক চায়ের আড্ডায় ভ্লাদিমির মারিয়াকে জিজ্ঞেস করলো,

-তোমার বয়স কত?

সে তখন চায়ে চুমুক দিচ্ছিল। ভ্লাদিমিরের কথা শুনে হাত তুলে দু’টো আঙুল তুলে বললো,

-আমাকে দেখতে যেমনটা দেখায় তার থেকে দু’বছরের ছোট।

তার একথায় সেখানে উপস্থিত অন্যরাও হেসে ফেলে। পরে লেনিন অবশ্য জানতে পারে মারিয়া তার থেকে নয় বছরের বড়। ভ্লাদিমির ভাবে আমি কি মারিয়ার প্রেমে পড়েছি? পরিবারের বাইরে বলতে গেলে এই প্রথম কোন নারীর সাথে সে এতটা ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করছে। মারিয়া চুরুট খায়, ভ্লাদিমির তার সাথে তর্ক করে, ভলগায় সাঁতার কাটে। ভ্লাদিমির জানে মারিয়া তার সঙ্গ পছন্দ করে। মারিয়াও কি তবে তাকে ভালবাসে? পরক্ষণেই এই কথাটা মনে হওয়ায় ভ্লাদিমিরের হাসি পায়। একজন বুদ্ধিমান মানুষের কাছে প্রেম হল ‘ a matter of choice’. ভ্লাদিমির মনে হয়-প্রেম মানুষের সবচেয়ে শক্তিশালী আবেগ ও উদ্দীপনার নাম। তবু তার মনে হয়- এমন আবেগের উপর, মানুষের মনের উপরও তার নিজের নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার। দু’জন মানুষকে সম্পর্কে জড়াতে গেলে একজন আরেকজনের শরীক, সহযোগী, সহযোদ্ধা হওয়াটা জরুরী-সেটা শারিরীক এবং মানসিক দু’ভাবেই। ভ্লাদিমির জানে নর-নারীর এই সম্পর্ক ভাবনায় সে হয়তো কিছুটা চেরনিশেভস্কির দ্বারা প্রভাবিত। তবু তার মনে হলো সমতার ভিত্তিতে প্রেম হওয়া উচিত। একজন যদি সম্পর্ক শেষ করতে চায়, আরেকজনের সেটা কোনভাবেই বাঁধা দেয়া উচিত নয়-বরং মেনে নেয়া উচিত। সে মনে মনে ভাবে-একজন যদি তোমাকে ভাল না বাসে তাহলে কিভাবে সম্ভব তাকে ভালবাসা? সেটা কোনভাবেই ভালবাসা নয়, বরং ভালবাসার নামে রীতিমতো স্বেচ্ছায় দাসত্ব করা।

কিছুদিনের মধ্যে গোটা ভলগা অঞ্চলে ভয়াবহ দূর্ভিক্ষ দেখা দিল। দূর্ভিক্ষের পাশাপাশি দেখা দিল কলেরা, বসন্ত, ও টাইফয়েড। মানুষ মরতে লাগলো পিঁপড়ের মত। খাবার, চিকিৎসা ও অন্যান্য জরুরী প্রয়োজনে সরকারী সাহায্য এতটাই অপ্রতুল যে মানুষ সামারার রাস্তায় ভিক্ষে করতে শুরু করলো। লেখক লিও তলস্তয় এবং আন্তন চেখভ রিলিফ ক্যাম্প করে সেখানে নোঙরখানায় মানুষকে দু’বেলা খাবার দেয়ার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু মানুষের প্রয়োজনের তুলনায় সেটা বিশ ভাগের এক ভাগ মাত্র। সামারার বুদ্ধিজীবী গ্রুপের সবাই জার সরকারকে দায়ী করলো এবং নিজেরা রিলিফ কাজে অংশ নিয়ে নিজেদের বক্তব্যগুলো জনগণের মধ্যে প্রচারের সুযোগ নিতে চাইলো। কিন্তু ভ্লাদিমির এবং মারিয়া ইভানোভকা সামারার বুদ্ধিজীবীদের বিপরীতে অবস্থান নিল। ভ্লাদিমির দূর্ভিক্ষের কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখলো- অতিরিক্ত মুনাফা এবং দূর্বল বিতরণ ব্যবস্থা, অপর্যাপ্ত খাদ্য মজুত এবং জীর্ণ খাদ্য গুদাম, রেলওয়াগনের ছিদ্র দিয়ে খাবার পড়ে যাওয়া, রাস্তাঘাটে ট্রাক ভেঙে পড়ে থাকা এবং সর্বপরি সরকারের চরম উদাসীনতা ও প্রসাসনের আমলাতান্ত্রিকতায় এর জন্য দায়ী। তাই সে বললো, ‘দূর্ভিক্ষ হল ধনীক শ্রেণীর শিল্পায়নের ফল’। একই সাথে সে অন্য বুদ্ধিজীবিদের সাথে তর্ক করলো এই বলে যে, ‘দূর্ভিক্ষ একটা প্রগতিশীল উপাদান হিসাবে কাজ করতে পারে’। অন্য সবাই তার এই মনোভাবকে নিষ্ঠুর এবং অমানবিক হিসাবে চিহ্নিত করলেও মারিয়া ইভানোভকা তার পক্ষ নিল। ভ্লাদিমিরের এমন মনোভাব এবং ত্রাণকাজের কঠোর সমালোচনায় উলিয়ানভ পরিবারের অন্যরা বিশেষত আন্না এবং মিত্তিয়া শুধু অখুশিই হল না, বিরক্তিও প্রকাশ করলো।

একদিন আন্না কিছু ঔষধপত্র ও খাবারসহ মিত্তিয়াকে নিয়ে ত্রাণকাজে অংশ নিতে যাবার সময় ভ্লাদিমিরকে যখন সঙ্গে যাবার অনুরোধ করলো তখন সে প্রবলভাবে না করলো। তার এমন আচরণে বিরক্ত আন্না বলল,

-ঠিক এই মুহূর্তে তোমাকে ভীষণ স্বার্থপর এবং নিষ্ঠুর মনে হচ্ছে। তোমার ভাবনার সাথে একমত হতে পারলাম না। আমরা যাচ্ছি তবে আমার কি মনে হয় জানো- আজ সাশা বেঁচে থাকলে তোমার মতো দেশের এই পরিস্থিতিতে এমন নির্বিকার থাকতে পারতো না।

ক্ষুব্ধ আন্না মিত্তিয়াকে নিয়ে চলে গেল। ভ্লাদিমির ভাবলো এরা চলে আবেগ দিয়ে। যুক্তি দিয়ে ভেবে দেখছে না সমস্যাটা কোথায়? এই ছিটেফোঁটা ত্রাণ দিয়ে মলমের মত প্রলেপ দেয়া যেতে পারে কিন্তু সেটা দিয়ে দূর্ভিক্ষের মত এত বড় রোগ সারানো যাবে না। কিন্তু কয়েক সপ্তাহের মধ্যে চার লক্ষ লোক মারা গেল। দুঃখ ভরাক্রান্ত ও ব্যথিত আন্না ভ্লাদিমিরকে যেন বুঝতেই পারছে না। মারিয়া আলেকজান্দ্রাভনাও অবাক হলেন আরেকটি ঘটনায়। গোটা অঞ্চলের মানুষ যখন যার যতটুকু সাধ্য, তাই নিয়ে আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে তখন ভ্লাদিমির এমন নিশ্চুপ থাকছে কি করে? নিজের এই সন্তানটিকে তাঁর নিজের কাছেই যেন অচেনা লাগে।

তখনও দূর্ভিক্ষের চিহ্ন সর্বত্র রয়ে গেছে। ফসল তোলা শেষ হয়েছে। একদিন ক্রুশভিটস এলো অর্থ দিতে। মারিয়া আলেকজান্দ্রাভনার সাথে যখন সে কথা বলছে, ভ্লাদিমিরও সেখানে উপস্থিত আছে। ক্রুশভিটস চুক্তি অনুযায়ী যে পরিমাণ টাকা দেবার কথা সেটা না দিলে মারিয়া আলেকজান্দ্রাভনা বললেন,

-টাকা কম দিচ্ছো কেন?

‘এবছর দূর্ভিক্ষের কারণ আদায়পত্র ভাল হয়নি।

মারিয়া আলেকজান্দ্রাভনার কারণটা যুক্তিসঙ্গত মনে হওয়ায় তিনি চুপ করে গেলেন। কিন্তু কথা বলে উঠলো ভ্লাদিমির। সে বলল,

-না, ক্রুশভিটস। সেটা হবে না। তোমাকে চুক্তি অনুযায়ী পুরো টাকাটাই দিতে হবে।

ভ্লাদিমিরের পাশেই আন্না বসে ছিল। ভ্লাদিমিরের কথাটা তার কানে নিষ্ঠুরের মত শোনালো। নিজের পক্ষে সমর্থন পেতে ক্রুশভিট একবার মারিয়া আলেকজান্দ্রাভনা, আরেকবার আন্নার দিকে তাকায়। ভ্লাদিমির সে দিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই বলল,

-অধিক ফসল হলে আমরা যেমন বেশী দাবী করি না, ফসল কম হলেও আমরা কম নেব কেন?

কথাটা ক্রুশভিটসের পিঠে যেন চাবুকের মত সপাৎ করে সজোরে আছড়ে পড়লো। আন্না রাগ করে সেখান থেকে উঠে চলে গেল। কিছুদিন আগে ভ্লাদিমির প্লেখানভের ‘আওয়ার ডিফারেন্স’ বইটি তাকে বুঝিয়েছিল। সেই বইয়ে রাশিয়ার কৃষকদের বিষয়ে প্লেখানভের কঠোর মনোভাবের কথা ভ্লাদিমিরই তাকে বলেছিল। আন্নার মনে হল ভ্লাদিমির প্লেখানভের যোগ্য শিষ্যই বটে!

দেখতে দেখতে আগষ্ট মাস এসে গেল। দ্বিতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা দিতে ভ্লাদিমির আবার রাজধানী গেল। এই পর্যায়ে তাকে দু’টি লিখিত পরীক্ষা এবং ১৩ টি মৌখিক পরীক্ষা দিতে হল। সেই মৌখিক পরীক্ষাগুলোর মধ্যে একটা ছিল গির্জা সংক্রান্ত আর অন্য একটি ছিল পুলিশ আইন বিষয়ক। ফল বের হলে দেখা গেল ১২৪ জন ছাত্রের মধ্যে ভ্লাদিমির সব বিষয়ে সর্বোচ্চ গ্রেড ৫ নিয়ে একাই প্রথম শ্রেণী নিয়ে পাশ করেছে। ফলাফলে খুশী এবং নিজের উপর প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে ভ্লাদিমির ফিরলো সামারায়। কাজান থাকতেই তার সাথে ব্যারিষ্টার আন্দ্রেই খারদিনের সাথে পরিচয় হয়েছিল। সামারায় আসার পর সেই সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়। জারের পুলিশ মনে করে ব্যারিষ্টার খারদিন সন্দেহজনক কাজের সাথে যুক্ত। পুলিশ তাকে নজরে রাখে। সে কথা জানার পর ভ্লাদিমিরের মনে হয়েছিল ব্যারিষ্টার খারদিনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়। তাই সঙ্গত কারণেই পাশ করে সামারায় ফিরে তার প্রথম পছন্দ খারদিনের অধীনে প্র্যাকটিস করার। প্রস্তাবটি খারদিনকে দিয়ে ভ্লাদিমির বলল,

-আমি আপনার অধীনে শিক্ষানবিশ আইনজীবী হিসাবে কাজ করতে চাই।

-সেটা তো ভাল খবর। আমিও একজন সহকারী খুঁজছি। কবে থেকে শুরু করবেন?

-আপনি যেদিন বলবেন।

-কাল ১২ ই জানুয়ারি। আগামীকাল থেকেই শুরু করুন!

ভ্লাদিমির আইন পেশায় যোগ দিল বটে তবে পেশাটাকে সে খুব বেশী সিরিয়াসলি নিল এমন না। সে রাশিয়ার কৃষি অর্থনীতিতে পুঁজিবাদ কতটুকু বিকশিত হলো সেটা নিয়ে ভাবছিল এবং তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছিল। আর সেই কাজেরই অংশ হিসাবে সে বছরই এক গরমের দিনে ভ্লাদিমির ও তার ভগ্নিপতি মার্ক এলিজারভ সামারা থেকে সিজরান হয়ে ভলগা নদী পার হয়ে বেষ্টুজভেকা নামের একটা গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। সেখানে মার্কের এক ভাই থাকেন। জমি কেনা-বেচা এবং বানিজ্যিকভাবে গবাদিপশুর ফার্ম করে সে অনেক টাকা-পয়সা করেছে। গন্তব্যে যেতে ভ্লাদিমির ও মার্ককে সিজরান থেকে ভলগা নদী পার দিয়ে ওপারে যেতে হবে। সিজরানে নেমে তাই তারা ঘাটের দিকে রওনা দিল।

একে গরমকাল তার উপর বেলা বাড়ার সাথে সাথে রোদ চড়ে ওঠায় প্রচন্ড গরম পড়ছে। ঘাটের ইজারাদার স্থানীয় ব্যবসায়ী-নাম আরেফায়েভ। সে জেটিতে এসে পৌঁছালে তার লোকজন জেটির একধারে একটি সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে তাকে বসতে দিল। অদূরে টেবিলে সামোভার থেকে গরম ধোঁয়া উড়ছে, আর তার পাশেই সাদা ঝকঝকে চায়ের পাত্র। আরাফায়েভ যেখানে বসে চারিদিকে নজর রাখছিলেন, সেখান থেকে কয়েক গজ দূরে রৌদ্রস্নাত ভলগা বয়ে যাচ্ছে যেন রাজসিক ভঙ্গিতে। একজন খানসামা এসে সামোভার থেকে সাদা চায়ের কাঁপে করে এক কাঁপ চা এনে তার সামনে রেখে গেল। গরম চায়ে একটা চুমুক দিয়ে তিনি ভাবছিলেন ঘাট বর্গা নিয়ে স্টীমার চালু করলেও এখনও নৌকা চলাচল বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। হারামী মাঝিগুলো ওৎ পেতে থাকে। সুযোগ পেলেই নৌকায় যাত্রী তোলে। ঘাটের পাশে মাছ ধরার ছলে ঘুরাঘুরি করে। নৌকায় যাত্রী বা মাল পরিবহন বন্ধ না হওয়ায় সে নিরুঙ্কুশ মুনাফা করতে পারছে না। নিজের লোক দিয়ে তাই সে পাহারা বসিয়েছে। তবু সে নৌকা চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করতে পারছে না। আর কি করা যায় সেই বিষয় নিয়ে চা খেতে খেতে সে যখন ভাবছে তখনই তার এক সাগরেদ দৌঁড়ে ছুটে আসে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,

-হুজুর, দেখলাম দু’জন নদী পার হতে চাচ্ছে কিন্তু তাড়া আছে বলে তারা স্টীমারের পরিবর্তে নৌকায় যেতে মাঝিদের পীড়াপীড়ি করছে। আপনি এখানে আছেন জেনে মাঝি একটু ইতস্তত করছে কিন্তু লোক দু’টোর মধ্যে যে বুক খোলা শার্ট পরা, সেই লোকটা মাঝিকে বলছে,-‘নদী কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয় এবং কাউকে পার করতে মানা করার কোন অধিকার কারো নেই’।

কোন ধরণের উত্তেজনা না দেখিয়ে আরেফায়েভ বলল,

-বটে! শুধু এটাই? ঠিক আছে। মাথা গরম করো না। বস এখানে। এক কাপ চা খাও। আমি দেখছি।

আরেফায়েভ ঝানু লোক। সে জানে কিভাবে এসব পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়। স্টীমারে যে চালক, সেই লোকটি পাশেই দাঁড়ানো ছিল। তাকে সাথে নিয়ে সে ঘটনাস্থলের দিকে এগোতে থাকে। কাছাকাছি যেতেই দেখতে পেলো-যে লোকটি একরোখা ভাবে মাঝির সাথে কথা বলছে তার বয়স ২২/২৩ এর বেশী নয় কিন্তু এই বয়সেই মাথার সামনের চুল পড়ে টাক দেখা যাচ্ছে। পাশের মাথাভর্তি চুলের ছেলেটি বয়সে রাগী ছেলেটির থেকে কয়েক বছর বড়ই হবে- পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মাঝির মুখে পাকা গোঁফ, সারা মুখে বলিরেখার ছাপ। মাঝি লোকটা তখনও ইতস্তত করছে দেখে রাগী যুবকটি বলছে-

-কাউকে যদি নৌকায় করে আপনি নদী পার করে দেন তবে কেউ আপনাকে বাঁধা দিতে পারে না-এটা কেন আপনি বুঝতে পারছেন না? এমন কোন আইন পৃথিবীর কোথাও নেই-আমাদের দেশেও নেই।

মাঝি লোকটি অভিজ্ঞ, সে জানে আইনে কি আছে সেটা বড় কথা নয়, এই ঘাটের ইজারাদার আরেফায়েভ যেটা বলবে সেটাই শেষ কথা। তাই সে বলল,

-এটা আমাদের এক্তিয়ারে নেই সাহেব। সওদাগর লোকটি জেটির ইজারাদার, আর সেই হল আইন।

আরেফায়েভ একটু তফাতে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনতে লাগলো। ঘাটে অগুনিত লোকের যাতায়াত, ভ্লাদিমির বা মাঝি কেউ তাকে খেয়াল করেনি।  আরেফায়েভ মনে মনে খুশী হল এটা জেনে যে মাঝিদের মধ্যে একটা ভয় ঢোকানো গেছে তাহলে! যুবক দু’জনের একজনকে যেন তার চেনা চেনা লাগছে।

মাঝির কথার জবাবে ভ্লাদিমির ভ্রুকুটি করে। গলায় জেদ এনে সে বলতে থাকে,

-যে পারঘাট ইজারা নিয়েছে সেটা তার ব্যপার। কিন্তু অন্য কেউ যাত্রী পার করতে চাইলে সে মানা করতে পারে না। এটা সোজা কথা। আপনি চাইলে তার বিরুদ্ধে মামলাও করতে পারেন।

আরেফায়েভ দেখলো যুবকটি ঝামেলা করতে চাইছে, আর সেই সুযোগ দেয়াটা ঠিক হবে না। অন্য যুবকটিকে এতক্ষণে সে চিনতে পারে। মার্ক তিমোফেয়িচ এলিজারভকে তিনি চিনতে পারলেন তার ভাইয়ের সুবাদে। তাই সেখান থেকেই গলা হাঁকিয়ে সে বলল,

-আরে, মার্ক তিমোফেয়িচ এলিজারভ যে! ভাইয়ের বাড়ি যাবেন বুঝি? আসুন, আমার জেটিটে। এক কাপ গরম চা খাবেন-তারপর যাবেন ক্ষণ। আমার স্টীমারে করে যাবেন! চা খেতে খেতে স্টীমারের যাত্রী ভরে যাবে। আপনার সঙ্গীটিকেও নিয়ে চলুন!

 

আরেফায়েভের গলা শুনে মার্ক এবং ভ্লাদিমির দু’জনেই ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। উত্তরে মার্ক কিছু বলল না। ভ্লাদিমির এমনভাবে মুখ ঘুরিয়ে মাঝির দিকে ফিরলো যেন তার কথাটা সে  শুনতেই পায়নি।

মাঝিটি বিড়িতে লম্বা একটা টান দিয়ে ধোঁয়াগুলো সবটুকু গিলে নিয়ে নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়াটুকু ছেড়ে হাতের বিড়ির আগুনটুকু থুথু দিয়ে নিভিয়ে অবশিষ্ট অংশটুকু কানে গুঁজে বলল,

-ঐ লোকটাকে দেখলেন না? সে টাকার কুমির। জজদের সে কিনে ফেলার ক্ষমতা রাখে। এখানে সবাই তার পক্ষে। বুঝলেন? কথায় বলে না-জোর যার মুল্লুক তার।

ভ্লাদিমিরের ততক্ষণে জিদ চেপে গেছে। অদূরে দাঁড়ানো ঘাটের ইজারাদারকে পাত্তা না দিয়েই সে উত্তরে বলল,

-এটা তো ঠিক নয়। লোকটা ভয় দেখিয়ে আপনাদেরকে কাঠ বানিয়ে রেখেছে। আইন ডিঙিয়ে সে নিজেই দন্ডমুন্ডের কর্তা সেজেছে। ওর নামে মামলা হলে আমি নিশ্চিত ওর শাস্তি হবে।

ভ্লাদিমিরের কথার প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে লোকটা ঘাড় গুঁজে বসে থাকে। পাশের আরেকটা মাঝি হাতের বৈঠাটি লগির পাশে রেখে এক পায়ের উপর আরেক পা তুলে এদের কথোপকথন শুনছিল আর যেন অসহায়ভাবে একবার জেটি আরেকবার ইজারাদারকে দেখছিল। ভ্লাদিমির সেই মাঝিটির দিকে একবার চেয়ে পাঁকা গোঁফওয়ালা মাঝিটির চোখে চোখ রেখে জানতে চাইলো,

-কি যাবেন?

মাঝিটি আরও একবার ইতস্তত করে বলল,

-কিন্তু ওরা আমাদের ফেরাবে, এটা জেনে রাখবেন।

তার একথায় ভ্লাদিমির আশান্বিত করে বলল,

-যাওয়া যাক, দেখি না চেষ্টা করে।

কথাটা বলেই মাঝির সম্মতির তোয়াক্কা না করে ভ্লাদিমির লাফ দিয়ে নৌকায় ওঠে। নৌকায় ওঠা বা চালানোয় তার দক্ষতা আছে। মার্ক একটু ইতস্তত করছে দেখে সে তার ডান হাতটি বাড়িয়ে দিয়ে টেনে তাকে নৌকায় তুললো। নৌকাটি বেশ একটু টলে উঠলো। ভ্লাদিমির পা সরিয়ে সেটাকে ব্যালেন্স করলো। ভ্লাদিমির গিয়ে বসলো হালের কাছে। মাঝি তখন জলে নেমে নৌকাটিকে ঠেলে দিয়ে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে লাফ দিয়ে নৌকায় উঠলো। নৌকায় লাফিয়ে উঠে মাঝিটি নিজেই অবাক হলো। কিছুক্ষণ আগেও সে অনড় ছিল যে ইজারাদারের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে সে এই অর্বাচীন যুবককে নিয়ে নদী পার হবে না। অথচ লোকটা কিনা তাকে রাজী করিয়ে ফেললো? সে দাঁড়ে হাতটি রেখে, তীরে দাঁড়ানো ইজারাদারের চোখের দিকে তাকালে সেই চোখে সে যেন আগুনের ফুলকি দেখতে পেল।

কিন্তু সেই অগ্নিচোখকে ভ্রুকুটি করে সে দাঁড় টানতে শুরু করে। দাঁড়ের বাঁধুনিতে একটা কিচ্ কিচ্ আওয়াজ উঠলো, জল আছড়ে পড়তে লাগলো দাঁড়ের উপর। মাঝি দেখলো সেই জেদী যুবক ভলগার বিস্তৃর্ণ পারের দিকে তাকিয়ে আছে। নৌকা চলছিল দ্রুত, কারণ বাতাস ছিল অনুকূলে। কূল থেকে অনেকটা দূর চলে এলেও অন্য পার তখনও অনেক দূরে। জেটির দিক থেকে চিৎকার ভেসে এলে মাঝি দেখতে পেল ইজারাদার জেটির কিনার ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসের তোড়েই হোক কিংবা ইন্জিনের শব্দের কারণেই হোক সেই শব্দটুকু হয়তো ভ্লাদিমিরের কানে পৌঁছালো না। ক্রুদ্ধ মাঝি তখন পানিতে দাঁড়ের ঝাপ্তা মেরে বলল,

-দেখছেন তো ব্যপার? আপনাকে আগেই বলেছিলাম। আপনি তো ভুল দিকে তাকিয়ে আছেন। পিছন দিকে জেটির দিকে তাকিয়ে দেখেন!

ওরা দু’জনেই দেখলো ইজারাদার, যার গায়ের জামাটা তার জ্যাকেট থেকে লম্বা, জেটির কিনার ঘেঁষে চিৎকার করে বলছে,

-এই, এই! ফেরো এখানে। ফে….রো!

ভ্লাদিমির লোকটির দিকে তাকিয়ে মাঝিকে প্রশ্ন করে,

-যে লোকটা গলা ফাটাচ্ছে-সেই ইজারাদার নাকি?

 -সে ছাড়া আবার কে? ও’ সবাইকে স্টীমারে যেতে বাধ্য করে। আমাদের রোজগারের কোন উপায়ই রাখছে না। সব ক্ষমতা ওর হাতে।

মাঝির কথা শেষ না হতেই ইজারাদার চিৎকার করে বলল,

-এই, তোমরা কালা নাকি? ফেরো বলছি!

এতক্ষণ মার্ক একটা কথাও বলেননি। ইজারাদারের কথা শুনে সে বলল,

-লোকটা বোধ হয় ঝামেলা করতে পারে। ভ্লাদিমির, চল, ফিরেই যাই!

ভ্লাদিমির উত্তরে বলল,

-ফিরে যাবার প্রশ্নই ওঠে না মার্ক তিমোফেয়িচ। আমি এর শেষ দেখতে চাই।

তারপর ভ্লাদিমির মাঝির দিকে ফিরে বলল,

-আপনার যদি আরেকটা দাঁড় থাকতো!

গোমরা মুখে মাঝি উত্তর দিল,

-তাতে কোন লাভ হত না। দেখুন না কেমন লোকজন জড় হতে শুরু করেছে। সব ওর কেনা লোক। ওরা স্টীমার নিয়ে আমাদের ধাওয়া করবে।

-তাতে কী হয়েছে। জোরে বেয়ে চলেন!

নির্দেশমত মাঝি জোরে চালাতে শুরু করে। যদিও সে জানে এটা নিষ্ফল চেষ্টা। ওরা মাঝ নদীর কাছাকাছি। এমন সময় স্টীমারের চিমনি দিয়ে যেন ধোঁয়ার মেঘ উড়তে শুরু করলো। একটা তীক্ষ্ণ এবং জোরালো সিটি পড়লো। স্টীমারের এক লোক দঁড়ির এক পাশ ধরলো। সারি সারি আন্দোলিত ঢেউ তুলে ছোট্ট স্টীমারটি জোরে চলতে শুরু করে। খালি পায়ের হাঁটু পর্যন্ত গোটানো প্যান্ট পরা মাঝি-মাল্লারা আঁকশি তুলে ধরে দাঁড়িয়ে গেল। সাদা নাবিক-টুপি পরা একজন, সম্ভবত সেই ক্যাপ্টেন ফ্যাসফ্যাসে গলায় হুকুম দিল,

-ডাইনে চালাও! জোরে চালাও!

ভ্লাদিমিরদের নৌকা এবং তাড়া করে আসা স্টীমারের মধ্যে দূরত্ব যখন কয়েক গজ তখন সেই ক্যাপ্টেনটি ষাঁড়ের মত চিৎকার করে বলল,

-নৌকা ফেরাও! থামাও নৌকা!

স্টীমার যখন নৌকার খুব কাছাকাছি এসে গেল, তারা সেটার ইন্জিন বন্ধ করে দিল। কয়েকটা বড় লগি দিয়ে আগন্তক মাঝি-মাল্লারা ভ্লাদিমিরদের ছোট্ট নৌকাটাকে আটকে ধরলো। কড়া গলায় ক্যাপ্টেন ভ্লাদিমির ও মার্ককে উদ্দেশ্য করে বলল,

-এখানে নৌকায় করে যাত্রী পার করায় নিষেধাজ্ঞা আছে। আপনারা পাটাতনে উঠে আসুন!

ক্ষুব্ধ ভ্লাদিমির বলল,

-আমাদের বাধা দেবার কোন অধিকার আপনাদের নেই। আর এজন্য আপনাদেরকে আসামীর কাঠগড়ায় উঠতে হবে।

উত্তরে বেশ অবজ্ঞার সুরেই ক্যাপ্টেন বলে,

-এটা আমার ব্যপার না। আমি আমার কর্তার নির্দেশ পালন করছি। নদী পার হতে চান, স্টীমারে উঠে আসুন। কিন্তু এই নৌকাকে আমরা এক চুলও আর যেতে দেব না।

মার্ক আবার কথা বলল,

-ভ্লাদিমির, চল ফিরে যাওয়া যাক!

ভ্লাদিমির মাঝিকে পুরো ভাড়াটা দিয়ে পাটাতন দিয়ে স্টীমারে ওঠলো। পিছুপিছু মার্ক। স্টীমারে উঠেই পকেট থেকে ছোট্ট নোটবুক ও পেন্সিল বের করে ভ্লাদিমির জিগ্যেস করল,

-আপনাদের সবার নাম ও ঠিকানা বলুন!

ক্যাপ্টেন লোকটি ভ্রুকুটি নিক্ষেপ করে, অবজ্ঞার সুরে বলল,

-লিখে নিন। যা খুশী আপনি করতে পারেন।

তারপর সে গড়গড় করে সবার নাম-ঠিকানা বলে গেল। এমন কি ইজারাদারের নাম ঠিকানাও বাদ দিল না।

ভ্লাদিমিররা জেটিতে ফিরে এলে ইজারাদার লোকটি এগিয়ে হেসে ব্যঙ্গের হাসি দিয়ে বলে,

-অত ঝামেলা করতে গেলেন কেন? যথেষ্ট যাত্রী হলে আমরাই আপনাকে নদী পার করে দেব-যেমনটা উচিত। তাই না? আর যতক্ষণ না স্টীমার ছাড়ছে ততক্ষণে না হয় আসুন, একটু চা খাবেন!

চা খাওয়ার কথা যেন শোনেই নি এমন ভাবে ভ্লাদিমির জানতে চাইলো,

-এই যে আপনি বললেন ‘যেমনটা উচিত’, সেই উচিতটা কে ঠিক করবে?

এবার মুখে বিরক্তি এবং কন্ঠে অসহিষ্ণুতা এনে লোকটি বলল,

-কেন? আমি। পারঘাটা আমি ইজারা নিয়েছি। আমি চাই না এখানে অন্য কেউ আমার সাথে পাল্লা দিক। কেউ সেটা চাইলে আমি হতে দেব না-এটা পরিস্কার? তা, চা কি একটু খাবেন? অবশ্য সেটা আপনাদের মর্জি।

এদিকে তল্পিতল্পা নিয়ে নানা লোক আসতে লাগলো। মাল বোঝাই কয়েকখানা ঘোড়ার গাড়িও আছে। স্টীমার থেকে বড় বড় তক্তাকে পাটাতনের মত বিছিয়ে দেয়া হল। স্টীমারের ইন্জিন চালু হল। এমন সময় নদীর পার থেকে বেশ কিছুটা দূর থেকে কিছু লোকের হাঁকডাক শোনা গেল। তারাও নদী পার হতে চায়-দেরী করে ফেলেছে। তারা হাত নাড়তে নাড়তে পায়ের ধুলো উড়িয়ে ছুটে আসছে। তারা পাটাতন দিয়ে না উঠা পর্যন্ত ক্যাপ্টেন অপেক্ষা করলো। পাটাতন তুলে স্টীমার ছাড়ার নির্দেশ দিলে তীক্ষ্ণ সিটি দিয়ে জেটি ছেড়ে স্টিমার চলে গেল। কেউ খেয়ালই করলো না ভ্লাদিমির এবং মার্ক নদী পার হতে স্টীমারে সওয়ার হলো কিনা।

তখন ইজারাদার লোকটিও তার টেবিলে ফিরে গেল। তার খানসামাটি এক কড়াই গনগনে কয়লা এনে দিল সামোভার গরম করতে। পরিচিত এক সরকারী চাকুরে যে পুরো বিষয়টা এতক্ষণ দেখছিল,-ইজারাদারের পরিচিত, এগিয়ে এসে টেবিলের অন্যপাশে বসলে ইজারাদার বলল,

-ছেলেটা বড্ড মেজাজী।

তারপর দু’জনেই জোরে জোরে হাসতে থাকে।

সেদিনের সেই ঘটনাটির যারা সাক্ষী বা যারা ঘটনার সাথে যুক্ত, সবাই যখন সেটা ভুলে গেছে বা যেতে শুরু করেছে তেমনি একদিনে ইজারাদার লোকটি খবর পেল সামারায় তার বিরুদ্ধে কে এক উলিয়ানভ নাকি মামলা রজ্জু করেছে। অভিযোগে বলা হয়েছে সে নাকি আইন অমান্য করে জোর করে ঘাটের নৌকা চলাচলে বাঁধা দিচ্ছে। আর তখনই কেবল তার মনে পড়লো কিছু আগে জেটিতে দেখা সেই যুবকটির দৃঢ় মুখ এবং প্রখর চোখ আর সেই চোখের তীব্র চাহনি। একই সাথে সাত ঘাটের পানি খাওয়া সওদাগর লোকটি ভাবলো, ‘বোঝ অবস্থা, একটা ছেলে-ছোকরা মামলা দিয়ে আমাকে ভয় দেখাচ্ছে?’ কিন্তু সে অবাক হল এই ভেবে যে-একটা হা-ভাতে ঘাটের মাঝির জন্য ব্যারিষ্টারের সহকারী মানে একটা ভদ্র ঘরের ছেলে-ছোকরার এতটা বাড়াবাড়ির করার কারণ কি থাকতে পারে। মামলা নয় বরং এই ভাবনাটায় যেন তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো।

আর সেই ভাবনা থেকে সে গেল উকিলের সাথে পরামর্শ করতে। সব শুনে উকিল বলল-মামলাটা তত জটিল না হলেও স্বেচ্ছাচারীতা সংক্রান্ত আইনের ধারায় এই মামলায় শুধু জরিমানা নয়, দোষী প্রমাণিত হলে এক মাসের জেল অবধারিত। উকিল লোকটির কথা শুনে তাকে ঝানু বলেই মনে হল। ঝানু না বলে ধান্দাবাজ বলাই ভাল। গায়ের কোটটি জীর্ণ বটে, তবে লোকটি ঘন ঘন নস্যি নিতে লাগলো। নস্যি নিয়ে বড় একটা হাঁচি শেষে নাক মুছতে মুছতে বলল,

-বুঝলেন কিনা-মামলা খুব ছোট তবে বিষয়টা হল-একটু অপ্রীতিকর। তবে চিন্তা করবেন না। উপরে ঈশ্বর আছেন আর নীচে আমি।

লোকটা উপরে ঈশ্বর আছেন বলে এমনভাবে উপরের দিকে তাকালেন যেন ঈশ্বর ঘরের ছাঁদেই বসে আছেন। কোন এক অজ্ঞাত কারণে সওদাগরও উপরের কড়িকাঠের দিকে তাকালো। পকেট থেকে টাকা বের উকিলের হাতে দিতেই বললেন,

-ঈশ্বর করুণাময়। মামলার দিনটি তো কাল- তাই না?

ইজারাদার মাথা নাড়ে।

-মামলাটি তো আবার আপনার বসতবাড়ী সংলগ্ন কোর্টে হবে। সেটা তো এখান থেকে বেশ দূরে। তবে চিন্তা করবেন না। সামারার উকিল সেখানে পৌঁছানোর আগেই আমি পৌঁছে যাব।

স্থানীয় জজের কার্যালয় হলেও কোর্ট চত্বরে বড্ড ভীড়। কত ধরণের লোক যে কোর্টে আসে তার ইয়াত্বা নেই। চারিদিক লোকে গিজগিজ করছে। জজ সাহেবের দপ্তরে ঢুকলে ইজারাদারের উকিল দেখতে পেল ফরিয়াদি যুবকটি আগেই এসে পড়েছে। মাথার সামনে বড়সড় টাকের পূর্বাভাষ থাকায় যুবকটি সঠিক বয়স আন্দাজ করা একটু কঠিন। তাকে সুপ্রভাত জানিয়ে সে প্রশ্ন করে,

-আপনি সেই সামারা থেকে এত সকালে চলে এসেছেন? এখান থেকে ১০০ মাইলেরও উপরে। তার উপর রাশিয়ার রাস্তাঘাটের যা ভয়ানক অবস্থা!

ভ্লাদিমির বুঝলো এই উকিলটির সাথেই লড়তে হবে। লড়ার মুহূর্তে শত্রুর সামনে বেশী খোলামেলা হবার প্রয়োজন নেই। তাই নিত্তান্নই ভদ্রতা রক্ষার্থে বেশ অনিচ্ছুক ভঙ্গিতে সে উত্তর করে,

-তা, দূর বটে।

উকিল লোকটি দেখলেন বয়সে যুবা হলেও ছোকরাটির মধ্যে একটা জেদ আছে, দৃঢ়তা আছে। তার এতগুলো বাক্যের উত্তর যখন কেউ দু’টি শব্দে দিতে চাই, তার অর্থ তো এটাই যে সে আলাপ চালিয়ে যেতে রাজী নয়। অগত্যা অভিজ্ঞ উকিলটি উঁকি দিয়ে জজ সাহেবের এজলাসের দিকে চেয়ে কড়িকাঠের দিকে চেয়ে এজলাস কক্ষে ডাকার অপেক্ষা করতে থাকলেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই এজলাস কক্ষে দু’পক্ষেরই ডাক পড়লো। জমকাল পোষাকের জজ সাহেব দু’পক্ষের বক্তব্য শুনে বললেন,

‘তুচ্ছ ব্যপার। আদালতের বাইরে দু’পক্ষ মিটিয়ে নিলে আদালতের সময়টা বাঁচতো!

জজ সাহেবের কথা ভ্লাদিমিরের পছন্দ হবার কোন কারণ নেই। তাই উত্তরে সে জানালো,

-কি এখন, কি পরে আদালতের বাইরে কোন ধরণের ফয়সালা করতে আমি রাজী নই। আমি আপনাকে অনুরোধ করছি মামলাটি পরিচালনা করুন!

জজ সাহেব বোধ করি একটু বিরক্ত হলেন, তবু নিয়ম রক্ষার জন্য বললেন,

-মামলাটি মুলতবি রাখছি-কেননা কয়েকটা বিষয় আগে পরিস্কার হওয়া দরকার।

অগত্যা দু’পক্ষই মেনে নিল। ইজারাদারের উকিল শহরে ফিরে সব ঘটনা তাকে খুলে বলার পরও বিষয়টা ইজারাদারের কাছে গোলমেলে লাগলো। সে বললো,

-সেই লোকটা এতটা কষ্ট করছে কিসের জন্য-আমি তো ব্যপারটা বুঝতেই পারছি না। এই যে আপনি-আমার জন্য যথাসাধ্য করছেন। কেন? কারণ আমি আপনাকে মোটা অংকের টাকা দিয়েছি। তা না হলে আপনি কিছু করতেন? বলুন, আমি ঠিক বলছি কিনা? কিন্তু লোকটা গাঁটের পয়সা খরছ করে এতটা পথ কষ্ট করে এমন একটা ফালতু মামলা লড়ছে। কেন? বলতে পারেন-কিসের জন্য?

ঝানু উকিল তার ফাইলপত্র গোছাতে গোছাতে বলল,

-কাঁচা বয়স, রক্ত গরম। তবে ছোকরাটি বেশ উচ্চাভিলাষী। তবে জজ সাহেবও কম যান না। মামলা আবার উঠতে অনেক সময় লাগবে।

অভিজ্ঞ উকিলের কথায় ঠিক হল। অনেকদিন পর শরতের শেষদিকে-যখন ভলগার জল ঠান্ডা আর সেই ঠান্ডা নদীর দুই পাড় যখন বড্ড নিষ্প্রাণ, তেমনি এক বৃষ্টি-বাদলার দিনে মামলার উভয়পক্ষই আদলতের সমন পেল। ইজারাদার লোকটি নির্দিষ্ট দিনে ভীষণ বিরক্তি নিয়ে তার উকিলের জন্য অপেক্ষা করছিল। নিজের চেম্বারে ঢুকে ইজারাদারকে দেখতে পেয়ে তার মুখের দিকে না চেয়েই সে বলল,

-জজ সাহেব মামলাটি আবার মুলতবি রেখেছেন।

কথাটা উকিল সাহেব বললেন এমনভাবে যেন বিষয়টি খুব আনন্দের বা একথা জেনে ইজারাদারের খুশী হওয়া উচিত। কিন্তু ইজারাদারের মুখে খুশীর পরিবর্তে বিরক্তি দেখতে পেয়ে সে আবার বলল,

-জজ সাহেব বিরাট কাজের লোক। তিনি মামলাটির ঠিকই একটা ফাঁক খুঁজে পেয়েছেন।

উকিলের একথায় ইজারাদার আগ্রহী হয়ে ওঠে। মুখের বিরক্তির রেখা মুছে গিয়ে একটা আনন্দের আভা যেন ফুটে উঠতে থাকে। আর তখুনি উকিল সাহেব বললেন,

-তবে সেই ছোকরাটি একেবারে অসহ্য। আপনি জেনে অবাক হবেন যে সে আদালতে এলো ভিজে জবজব হয়ে-জামা কাপড়ে কাঁদার ছাপ। জানেন তো আজকাল সামারার রাস্তার কি হাল? কিন্তু ছোকরাটার সেসব দিকে কোন খেয়ালই নেই। আজও আদালতের বাইরে ফয়সালা করার জন্য জজ সাহেব প্রস্তাব দিয়েছিলেন কিন্তু সে রাজী হল না।

উকিলের কথা তখনও শেষ হয়নি কিন্তু ইজারাদারের মুখটি এতটুকু শুনেই পাংশুবর্ণ হয়ে গেল। কথার তোড়ে উকিল লোকটির সেদিকে খেয়াল ছিল না। কিন্তু ইজারাদারের চোখের দিকে তাকিয়েই সে বুঝতে পারলো যে তার কথার বিপরীত ফল ফলতে শুরু করেছে। তাই একটু ঝুঁকে ইজারাদারের কাছাকাছি মাথাটা এনে সে বলল,

-কিচ্ছু ভাববেন না-আর কয়েকবার আদালতে হাজিরা দিতে দিন না-তাহলেই সে মত বদলাতে বাধ্য হবে। ওকে আমরা হয়রান করে ছাড়ব-দেখবেন সে কেটে পড়বে।

উকিলের কথাটা ইজারাদার শুনলো বটে তবে উকিলের সব কথায় তার কাছে অর্থহীন বক বকানি ছাড়া কিছু মনে হল না। তার বড় অদ্ভুত লাগছিল-তার মনে হল রাস্তায় চলতে চলতে পাথরের মত শক্ত কিন্তু অদৃশ্য কোন বস্তুতে তার মাথা ঠুকে গেছে। সে মাথা নাড়াতে লাগলো।

উকিল লোকটি জানতে চাইলো-

-মাথা নাড়ছেন কেন?

মাথা নাড়ছি কারণ আপনি নিজেও বুঝতে পারছেন যে যতটা হালকাভাবে আপনি ব্যপারটা আমাকে বলতে চাচ্ছেন-সেটা তা নয়। বৃষ্টি-বাদলা মাথায় নিয়ে, কাঁদামাখা জামা গায়ে যে ছেলেটি ১০০ মাইল রাস্তা পেরিয়ে আদালতে হাজিরা দিচ্ছে, জজ সাহেবের দু’দফা প্রস্তাব যে অবলীলায় প্রত্যাখান করতে পারে-এমন একগুঁয়ে, নাছোড়বান্দা লোকের সাথে লড়াইটা এত সহজ নয়-যেমনটা আপনি ভাবছেন। আপনি নিজেও জানেন যে কেসটা সে লড়ছে-সেখানে তার ব্যক্তিগত কোন স্বার্থও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

উকিল লোকটি চুপচাপ ইজারাদারের কথা শুনছিল। ইজারাদার চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল,

-এমন নাছোড়বান্দা লোকের সাথে জেতাটা সোজা না। আমার আরও একটু সাবধান হওয়া দরকার ছিল।

উকিল লোকটি ইজারাদারের চলে যাওয়াটা দেখতে থাকে এবং মনে মনে স্বীকার করলো-ইজারাদার লোকটি ঠিকই বলেছে।

শীত এসে গেল। ভলগা ঢাকা পড়েছে বরফে। ভলগা যেন এখন বিস্তীর্ণ শ্বেত প্রান্তর-এমনই এক প্রান্তর যেখান দিয়ে নৌকা তো দূরে থাক কোন শ্বেত ভল্লুকও কোনদিন চরেনি। ইজারাদের স্টীমার, জেটি সব কিছু ঢেকে আছে বরফে। তুষারপাত বন্ধ হলে, শুধু স্টীমারের মাস্তুলের বরফটুকু আলগা হয়ে যেন জানান দেয় এখানে এই ঘাট-এই স্টীমার মুখরিত ছিল মানুষের পদভারে।

সামনে নববর্ষ। ভ্লাদিমির এবং ওলগা দাবা খেলছে। এমন সময় সমনের চিঠি হাতে পিয়ন এসে হাজির। ভ্লাদিমিরের পক্ষে মারিয়া আলেকজান্দ্রাভনা চিঠিটি গ্রহণ করলেন। উলিয়ানভ পরিবারের সবাই মামলার কথাটি জানে। মারিয়া আলেকজান্দ্রাভনা ঘরে ঢুকার আগে নিবিষ্ট মনে ভ্লাদিমিরকে দেখলেন। ভাবলেন এই শীতের মধ্যে রাত জেগে প্রথমে ট্রেনে চেপে, তারপর ঘোড়া গাড়ি এবং শেষে হেঁটে ছেলেটিকে আবার আদালতে হাজিরা দিতে যেতে হবে। তিনি জানেন নিষেধ করে লাভ হবে না। তবুও মায়ের মন। তাই ঘরে ঢুকে বললেন,

-ভলোদিয়া, এই নাও, আবার আদালত থেকে সমন এসেছে। আমার ইচ্ছে ইজারাদারের বিরুদ্ধে মামলাটি তুমি ছেড়ে দাও! এই যাওয়া-আসা করতে করতে তুমি শুধু হয়রানই হবে।

দাবার ছক থেকে চোখ তুলে ভ্লাদিমির বলল,

-না, মা, আমাকে যেতেই হবে। এই মামলার শেষটি আমাকে দেখতেই হবে। এমন সুযোগ হাত ছাড়া করা যায় না। জজ সাহেব যতবারই মুলতবি রাখুন না কেন-শেষ পর্যন্ত তাঁকে দণ্ডাদেশ দিতেই হবে। গোটা শহর এবং অঞ্চলের মানুষ জানবে একটা অন্যায়কে কিভাবে রুখে দেয়া যায়-আর সেটাই হবে একটা উপযুক্ত শিক্ষা। জজ সাহেব যা করছেন সেটা আমার বোধগম্য-গত্যান্তর নেই বিধায় তিনি যতটা সম্ভব মামলাটিকে দেরী করাচ্ছেন।

মায়ের দিকে চোখ সরিয়ে সে এবার দাবার ছকের দিয়ে তাকিয়ে বলল,

-আর মিত্তিয়া-এখন তোমারও নিস্তার নেই-এই কিস্তিমাত।

কথাটা বলতে বলতেই ঘোড়াটা আড়াই চেলে ভ্লাদিমির ‘রাজা’কে চেক দিল। রাজার সরার কোন জায়গা নেই। মিত্তিয়া বড় বড় চোখ দিয়ে নিজের চালের ভুল বা করণীয় কিছু আছে কিনা যখন ভাবছে-তখন ভ্লাদিমির ঘুরে মায়ের মুখোমুখি ফিরে মায়ের হাত দু’টি ধরে বলল,

-জজ সাহেব আমাকে নিরস্ত্র করতে পারবেন না। আমার লক্ষ্য থেকে কোন বাঁধায় আমাকে সরাতে পারবে না। রাতের ট্রেনে যেতে হবে-এটাই কেবল অসুবিধা।

শীত শেষে বসন্ত এল। বরফ গলতে শুরু করেছে। স্ফীত ভলগার জলে ভেসে চলছে ভাসমান বরফ। কখনও কখনও ভাসমান সেই বরফের চাঙড়গুলো একটার সাথে আরেকটার ঠুকাঠুকি লাগছে। সেই সংঘর্ষে বরফের চাঙড়গুলো দূর্বল অংশগুলো ভেঙে জলে পড়ছে। দিন যত যাচ্ছে বরফমুক্ত স্বচ্ছ জলের এলাকা ততই বাড়ছে। স্টীমারের মাঝি-মাল্লারা ভাঙাগলায় নিজেদেরকে ডাকাডাকি করছে আর বরফমুক্ত অঞ্চল বাড়াচ্ছে। ছোট নৌকাগুলো যাত্রী তুলছে পারাপারের জন্য। আগের মত স্টীমারের লোকজন নিষেধও করছে না বা তেড়েও আসছে না। নৌকাগুলোর মাঝিদের মধ্যে সেই দাঁড়িওয়ালা মাঝিটি নিজেকে যেন কিছু নায়ক ভাবছে। যাত্রীদের শুনিয়ে শুনিয়ে সে সেইদিনের যাত্রীর গল্প বলছে। আর প্রত্যেকবারই সে বলছে নতুন কিছু যোগ করে। এই মাত্র তার নৌকায় ওঠা যাত্রীদের সে বলছে,

-সেই লোকটা, বুঝলেন কিনা-তিনি আমাদের এই ভলগা অঞ্চলেরই মানুষ-আর সেটা তাঁকে দেখলেই বোঝা যায়। জোয়ান ছেলে কিন্তু গায়ে-গতরে বিশাল, আর তাঁর গলার আওয়াজ তো নয় যেন বাজ পড়ার গর্জন। ইজারাদার নিষেধ করার পরও তিনি যখন বললেন, ‘বেয়ে চলো’ -তখন আমার দাঁড় যেন নিজ থেকে বাইতে শুরু করলো’।

যাত্রীরা কেউ বিশ্বাসের চোখে, কেউ কেউ বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে ভাসতে ভাসতে মাঝির গল্প শোনে। তার মধ্যে একজন বলে ওঠে,

-অত খুশী হও না-দাঁড়াও না, ইজারাদার জেল থেকে ছাড়া পেতে দাও-তখন কি হয় দেখ

লোকটার কথা শুনে মাঝি হাসে। তারপর বেশ জোর গলায় বলল,

-আরে না। শুনেছি ইজারাদারের গলা দিয়ে জেলের খাবার নামছে না। তিনি কি ফের আরেকবার জেলে যেতে চাইবেন? আর যদি একান্তই তার মনে তেমন কোন ইচ্ছে জাগে তাহলে আমরা তো আছি।

কথাটা বলেই শক্ত হাতে দাঁড়টা ডান দিকে উঁচু করে বামদিকে এনে জোরে জোরে নৌকা চালাতে থাকে।

পুরো বছরে ভ্লাদিমির মাত্র ১৪ টা কেস লড়লো। এর মধ্য ৮/৯ টা ডিফেন্স ল’ইয়ার হিসাবে। তার অধিকাংশ মক্কেলই ছিল আশেপাশের গরীব মানুষ। সে প্রত্যেকটা কেসে হারলো। ইজারাদারের কেসটি ছাড়া যে গুলোতে সে প্রসিকিউটিং ল’ইয়ার ছিল শুধু সেগুলোতেই সে জিতলো।

দিন গড়ায়। ভ্লাদিমির কেস তেমন নেয় না। সে ব্যস্ত সময় কাটায় পড়াশুনা ও নিজেকে বিপ্লবী হিসাবে তৈরী করার কাজে। একদিন মাসলভ নামের এক মার্কসবাদীর সাথে বাসায় ফেরার পথে ভ্লাদিমিরের সাথে তার তুমুল তর্ক শুরু হলো। মাসলভ বললো,

-মার্কস নিজেই যেখানে বলেছেন পুঁজিবাদ বিকাশের সর্বোচ্চ পর্যায়েই কেবল সমাজতন্ত্র কায়েম হবে সেখানে তোমাদের প্লেখানভ গায়ের জোর করে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চাচ্ছেন কেন?

ভ্লাদিমির তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে বললো,

-প্লেখানভ কিভাবে গায়ের জোরে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চাইলেন? কার্ল মার্কস এটাও বলেছেন যে অনুন্নত দেশেও সমাজতন্ত্র কায়েম হতে পারে। ১৮৮১ সালে ভেরা জাসুলিচের চিঠির উত্তরে মার্কস তো সেটাই বলেছিলেন, নাকি?

-সেটার সাথে এটাও বলেছিলেন যে ইউরোপের উন্নত দেশে সমাজতন্ত্র কায়েমের পরেই কেবল রাশিয়ার মত অনুন্নত পুঁজিবাদী দেশে বিপ্লব হতে পারে। আর এটা বলার মধ্যদিয়ে তিনি তো পরোক্ষভাবে রাশিয়ার এ্যাগারিয়ান স্যোসালিষ্টদের সমর্থন করে গিয়েছেন।

-তোমার কথা আংশিক সত্য মাসলভ। মার্কস রাশিয়ার কৃষি এবং শিল্প উৎপাদনের সব তথ্য জানতেন না। গ্রেগরি প্লেখালভ একারণেই তথ্য প্রমাণসহ মার্কসকে লিখেছিলেন। কিন্তু আমাদের দূর্ভাগ্য যে এ বিষয়ে কোন মতামত দেবার আগেই তিনি মারা গেলেন। কিন্তু আপনি জানেন কিনা জানি না যে এই কিছুদিন আগে এঙ্গেলস প্লেখানভের তথ্যের উপর ভিত্তি করে লিখেছেন যে রাশিয়ায় পুঁজিবাদ ইতোমধ্যে যথেষ্ট বিকশিত হয়েছে যদিও সেটা ইউরোপীয় কায়দায় নয়। তিনি এটাও লিখেছেন যে রাশিয়ার পুঁজিবাদ জার শাসনে আর বিকশিত হওয়া সম্ভব নয়। পুঁজিবাদের অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ

করার নেতৃত্ব শ্রমিক শ্রেণীকেই নিতে হবে। তাহলে এ্যাগারিয়ান স্যোসালিষ্টদের কর্মসূচী মার্কসপন্থীদের সমর্থনের প্রশ্ন আসবে কেন?

তাদের তর্ক শেষ না হলে বাড়ি ফেরার পথটুকু ফুরিয়ে এলে ভ্লাদিমির বাড়ির রাস্তা নিল। পথে বাকীটুকু সে ভাবতে ভাবতে এলো যে সামারার মত এই ছোট্ট পরিসরে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নিজেকে তৈরী করার সুযোগ কম। এখান থেকে তার আর বেশী কিছু নেবার নেই। নিজেকে বিপ্লবী হিসাবে তৈরী করতে গেলে তার সেন্ট পিটার্সবার্গে যাওয়া দরকার। কাজানে ফেদোসেভে ছিলেন কিন্তু ভ্লাদিমিররা কাজান ছাড়ার দু’মাসের মাথায় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে। মনে মনে রাজধানী যাবার সংকল্প নিয়ে বাড়ি ফিরে কথাটা মাকে বলতেই মারিয়া আলেকজান্দ্রভনা বললেন,

-দেখ ভলোদিয়া, আমি মনে করি এখনও তোমার এখানে থাকার দরকার আছে। আন্নার নির্বাসনের সময় শেষ হতে কয়েকমাস বাকী। দিমিত্রির স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হবে আগামী বছর। তাই আমার মনে হয় তোমার সামারা ছাড়ার সময় হয়নি।

ভ্লাদিমির হতাশ হলেও মায়ের সিদ্ধান্ত মেনে নিল। এর মধ্যে মি. এন্ড মিসেস এ্যাপোলনের একটা মেয়ে বাচ্ছা হল। তার নাম রাখা হল আসিয়া। মি. এ্যাপোলন ভ্লাদিমিরকে অনুরোধ করলো আসিয়ার ‘ধর্মবাপ’ হতে। ভ্লাদিমির রাজী হল। আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে এ্যাপোলন জানালো,

-ভ্লাদিমির, আমার নির্বাসনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে।

-এখন কি করবেন?

-ভাবছি জার্মানী চলে যাব।

-আপনারাও চলে যাবেন?

-এখানে থেকে কি করবো?

কথাটা ভ্লাদিমের মাথায় যেন হাতুড়ির মত বাড়ি দিয়ে গেল। মারিয়া ইভানোভকা চলে গেছে মস্কো, এ্যাপোলনরা চলে যাবে। তার মনে হলো সে একাই যেন কেবল সামারায় আটকা পড়েছে।

দেখতে দেখতে শীত চলে এলো। শীতকালটা সামারায় ভ্লাদিমিরের অসহ্য লাগতে লাগলো। প্রতিটি দিন সে অপেক্ষা করতে থাকে কবে মায়ের অনুমতি মিলবে। বাইরে ভীষণ তুষারপাত হচ্ছে। বাতাসের ঝাপটায় তুষার এসে জানালার কাঁচে এসে আঁচড়িয়ে পড়ছে। ভলোদিয়ার ঘুম আসছে না। ‘রুশস্কায়া মিছল্’ পত্রিকার নভেম্বর সংখ্যার পাতা উল্টাতে উল্টাতে তার চোখ গেল আন্তন চেখভের সদ্য লেখা একটি গল্প ‘ওয়ার্ড নম্বর ছয়’। রাত গভীর হলেও ভ্লাদিমির গল্পটি পড়তে শুরু করলো। রাশিয়ার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি হাসপাতাল। সেই হাসপাতাল থেকে নিকটতম রেল ষ্টেশনের দূরত্ব ১৫০ মাইল। হাসপাতালের বাইরে আছে একটা পোষ্ট অফিস। হাসপাতালে ঢুকতে হলে সামনের বিশাল শেঁয়ালকাটার ঝোঁপ পেরিয়ে সেখানে পৌঁছাতে হয়। পোস্টমাস্টার লোকটি যেন বাস করে অতীতে। বয়স্ক লোকটি তার কসাক জীবনের স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে আছে। হাসপাতালের যিনি পরিচালক এবং ডাক্তার তার নাম আন্দ্রে ইয়েফিমিচ। সে স্বপ্ন দেখে এমন কিছু মানুষের সঙ্গ যাদের সাথে সে তার বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরের বিষয় নিয়ে আলাপ করতে পারে। ভোর তিনটা পর্যন্ত সে পড়াশুনা করে। আধা ঘন্টা পরপর ভদকা খায় আর সাথে শশা চিবোয়। মাঝে মাঝে ভাবে সে বোধ হয় হাসপাতালটি ঠিক মত চালাতে পারছে না।  হাসপাতালের এক কোণায় পাগলদের জন্য একটি নির্ধারিত ওয়ার্ড আছে, যার নাম ‘ওয়ার্ড নম্বর ৬’। সেই ওয়ার্ডে এই মুহূর্তে একজন বাসিন্দা নাম ইভান গ্রোমোভ। ইভানের জন্ম স্বচ্চল পরিবারে। বাবা আদালতের উচ্চপদে চাকরী করতেন। একটা দূর্ঘটনায় তার বড় ভাইয়ের মৃত্যু পর পরিবারটির উপর একটার পর একটা বিপদ নেমে আসে। সেই ছোট বেলায় সে দেখেছিল পুলিশ এসে তার বাবাকে একদিন ধরে নিয়ে গেল অর্থ তসরুপের অভিযোগে। জেলেই তার মৃত্যু হয়। মায়ের কাছে বড় হতে থাকা ইভানের মায়েরও একসময় মৃত্যু হলো। সে তখন ভাল চাকরী করে, একা একটা বাসায় থাকে। হঠাৎ করে একদিন তার মনে হতে থাকে কেউ তার পিছু নিয়েছে। সারাক্ষণ আতংকের মধ্যে থাকতে থাকতে তার মধ্যে ভীষণ রকম পাগলামি দেখা দিল। তারপর তাকে এনে এই ওয়ার্ডে তোলা হয়। তার শরীরে ক্রমাগত খিঁচুনি ওঠে এবং নিজেকে সে পৃথিবীর সবকিছু থেকে তখন লুকাতে চেষ্টা করে আর চিৎকার করে বলে, ‘আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি, আমি বাঁচতে চাই’।

একদিন ৬ নম্বর ওয়ার্ডের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ইভানের চিৎকার শুনে ভিতরে ঢুকে ডাক্তার তার সাথে কথা বলে। দু/একটা কথা বলে ডাক্তারের ভাল লাগে। পরের দিনগুলোতে ডাক্তার নিয়মিত তাকে দেখতে যায়, গল্প করে। তারা গল্প করে- মানুষের তীথযাত্রা, জীবনের অসারতা, অর্থহীনতা, মহাজাগতিক তাৎপর্য এই সব নিয়ে। একদিন গল্পের ফাঁকে ইভান বলেে,

-তুমি যদি দেখ একজন তার বৌকে মারছে তুমি কেন নাক গলাবে? তারা দু’জনেই তো মরবে, আগে আর পরে?

ইভানের এই কথায় ডাক্তার চমকিত হয় এবং ইভানের প্রতি প্রবল আগ্রহ বোধ করে। ধীরে ধীরে হাসপাতালের নার্স এবং রোগীরা দেখলো ডাক্তার অধিকাংশ সময় কাটায় ইভান নামের পাগলটার সাথে। কয়েকদিন পর তারা খেয়াল করে ডাক্তার বিড় বিড় করে কথা বলছে, কোন প্রশ্ন করলে উদ্ভ্রান্তের মত চেয়ে থাকে। কিছুদিন না যেতেই সে হাসপাতালে আসা বন্ধ করে দিল। তারপর একদিন সকলে দেখলো ডাক্তারকেও ৬ নম্বর ওয়ার্ডে ঢুকানো হলো পাগল হিসাবে।

ভ্লাদিমির যখন গল্পটা পড়া শেষ করলো তখনও ভোর হয়নি। সে প্রচন্ড ভয় পেল। তার শরীর কাঁপতে থাকে। তার মনে হল তাকেও যেন ৬ নম্বর ওয়ার্ডে আটকে ফেলা হয়েছে। ভ্লাদিমির অস্থির হয়ে সারা ঘর পায়চারি করতে লাগলো। তার মনে হলো গল্পটা কাউকে বলা দরকার। কিন্তু ভোর হতে এখনও দেরী। এই অন্ধকার রাতে কাউকে ঘুম থেকে তোলা যায় না। তার মনে হল চেখভ যেন গল্পটা তার জন্যই লিখেছে। বাবার মৃত্যু, সাশার ফাঁসি, ওলগার এই অর্থহীন অকাল মৃত্যু, দূর্ভিক্ষের সময় যে সব মানুষ পিঁপড়ের মত মারা গেল, সবই তো জীবনের এক ধরণের অর্থহীনতায়। এই সব ভেবে সে ছটফট করতে থাকে। বিছানায় গেল কিন্তু সে চোখ বন্ধ করতে পারলো না। এক সময় পর্দাহীন কাঁচের জানালা দিয়ে ঘরে ভোরের আলো এসে পড়ে। সে ছুটে গেল আন্নার ঘরে। দরজায় দুমদাম শব্দ করতেই আন্না দরজা খুলে দেখে ভলোদিয়া দাঁড়িয়ে। তার মুখের তাকিয়ে আন্না ভয় পেল। তাকে হাত ধরে বিছানায় বসাতেই সে বললো,

-আমি কিছুক্ষণ আগে আন্তন চেখভের ‘ওয়ার্ড নম্বর ৬’ গল্পটি পড়ে শেষ করেছি। কিন্তু গল্পটা পড়ার পর আমি আর ঘরে থাকতে পারছি না। আমার ঘুম আসছে না। আমার কেবই মনে হচ্ছে আমি নিজেও যেন ‘ওয়ার্ড নম্বর ৬’ আটকা পড়েছি।

-কি বলছো ভলোদিয়া?

-আমি সামারা থেকে সরতে চাই।

-কেন?

-না হলে আমিও পাগল হয়ে যাব।

আন্না বুঝলো ভলোদিয়াকে আর সামারায় রাখা যাবে না। তার নির্বাসনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে শীগ্রই। মার্ক বদলি হয়ে যাচ্ছে মস্কোয়। সামারা থেকে তাদের গুটিয়ে ফেলার সময় এসেছে। সে নিজের বিছানায় ভ্লাদিমিরকে শুইয়ে দিয়ে বলল,

-তুমি একটু ঘুমাতে চেষ্টা করো। আমি তোমার পাশেই আছি।

ভ্লাদিমির আন্নার হাতটি মুঠোয় ধরে ঘুমিয়ে পড়লো ছোট একটা বাচ্ছার মতো।

 

Facebook Comments

comments

১ Reply to “লেনিন ।। পর্ব-১৭ ।। আশানুর রহমান”

  1. MD ASLAM HAYAT বলেছেন:

    পরবর্তী পর্বের জন্য অনেক দিন অপেক্ষা করছি। দ্রুত লেখা প্রকাশ করুন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top