একটি বন্য স্বপ্নের অন্ধ যাত্রা ( ৭ম পর্ব) // নীলিম কুমার II অসমিয়া থেকে অনুবাদঃ বাসুদেব দাস

(১৪)

ধীরে ধীরে গজেন্দ্রনাথের বাড়ির সবাই জেগে উঠল। গরু হাম্বা রবে ডাকতে লাগল। জেগে উঠল ঝাড়ু এবং উঠোন। বারান্দা এবং ঝাড়ু। জেগে উঠল চাপা কল। চাপা কল কি ঘুমোতে গিয়েছিল? কার পাশে ঘুমিয়ে ছিল চাপা কল? বালতির? ওহো! বালতি-মগ- লোটাগুলিকে রাতের বেলা গুণামস্তির ভয়ে বাথরুমে দরজা লাগিয়ে বন্ধ করে রাখা ছিল। ঠিক ভয়ে বলা যায় না, ভয় করার মতো গুনামস্তি কোনো অন্যায় করে না । সে কেবল বিরক্ত হওয়ার মতো কখনও অসুবিধায় ফেলে।

এই মনে করুন ভুলে দা-টা সেদিন রাতে বাইরেই পড়েছিল। গজেন্দ্রনাথ বা তজো সকালবেলা নারকেলটা কাটার জন্য উঠানে বের করে এনে দেখে যে দা নেই ! নেই তো নেই । দা তখন গুণামস্তির হস্তগত। এটা নির্ঘাত অসুবিধা– সবকিছু ওলট-পালট হয়ে যাওয়ার মতো বিরক্তিকর। কারণ নারকেলের নাড়ু আর তৈরি হল না।

কেন জানিনা, এই বাড়িতে নারকেলের নাড়ুকে এক অসাধারণ জিনিস বলে ভাবা হয়। লবঙ্গ বরফির চেয়ে বেশি সম্মান দেওয়া হয় নারকেলের  নাড়ুকে। নারকেল কুড়িয়ে কার্পাসের মতো সাদা গুড়োগুলি শশী চিনির সঙ্গে কড়াইয়ে ভাজে । কারও কষ্টের নয়, এক প্যাকেট কর্পুরের গুড়ো শশী তার মধ্যে ঢেলে দেয়। তারপরে অমৃত প্রভার সঙ্গে পিঁড়ি পেতে বসে নেয়। হাতে পাকিয়ে পাকিয়ে সেগুলিকে গোল করে। তারপরে ধবধবে এক থালা সাদা নাড়ু সবার চোখের সামনে উপচে পড়ে। কখনও কখনও নাড়ু তৈরি করার জন্য রাহুল এবং নীপার মা এবং ঠাকুমার মধ্যে থাকা ফাঁকা জায়গাটিতে ঢুকে পিঁড়ি পেতে বসে পড়ে। ওরা বসে পড়ে কিন্তু তাড়া খায়। ওরাও সমূহ করে সেই সাদা গোলগোল মূল্যবান নাড়ুগুলিকে।

নাড়ু তৈরি হওয়ার পরে সেইসবের ওপরে অধিকার থাকে কেবল বাবা বরুণের। সেই নাড়ু কখন কাকে দিতে হবে তার নির্দেশ কেবল বরুণই দিতে পারে। এমনকি গজেন্দ্রনাথও সেই নাড়ুগুলির কাছে অসহায়। আমুল দুধের পাউডারের কৌটোতে বন্দি হয়ে থাকা নাড়ুগুলির গায়ে যখন তুলোর মতো ছোটো ছোটো লোম গজায় এবং কষ্টের মতো সত্যিই কর্পুরের গন্ধ কোথাও চলে যায় এবং অন্য এক গন্ধ বের হয় তখন বরুণ স্ত্রী শশীকে বলে – নাড়ুগুলিতে যদি গন্ধ করছে ওদের দিয়ে দাও।’

শশী ডাকে ‘ নীপা, রাহুল, অনুপ তোরা  কে কোথায় আছিস তাড়াতাড়ি চলে আয়– নারকেলের নাড়ু ,নারকেলের নাড়ু…’

যে যেখানে ছিল সবকিছু ফেলে সবাই এসে শশীকে ঘিরে দাঁড়ায়। শশীর হাতে নাড়ুর কৌটাটা এবং সামনে ১০-১৪ টা হাত ( কেউ কেউ দুটো হাত এগিয়ে  দিয়েছে)। শশী একটা নয় দুটো করে নাড়ু ওদের হাতে হাতে তুলে দেয়।

রাহুল এবং নীপা শুঁকে দেখে– কর্পুরের গন্ধ নেই, কারও পছন্দ না হওয়া অন্য একটি গন্ধ। ওরা ভাবে– নাড়ুগুলি যদি আরও এক সপ্তাহ আগে  দিত, প্রকৃতই নাড়ুগুলি কত সুন্দর তা ওরা জানতে পারত।

অভিমানে সেই নাড়ু একদিন রাহুল শশীকে ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিল ‘ আমি গন্ধ বের হওয়া নাড়ু খাই না।’

বরুণ শুনে মুখ ভেংচে বলে উঠেছিল–’ইস বড়ো লাট সাহেব এসেছেন, গন্ধ বের হওয়া  নাড়ু খেতে পারে না।

(১৫)

বজালী অঞ্চলের বিখ্যাত চোর ছিল গুণামস্তি। তার বিরুদ্ধে পাঠশালা থানায় কারও মামলা ছিল না। চুরি করে ধরা পড়লে লোকেরাই তাকে উত্তম মধ্যম দিয়ে দিত। আর ধরা না পড়লে সে বুক ফুলিয়ে রাস্তার ঠিক মধ্য দিয়ে পাকা সুপুরি নিয়ে পায়ে হেঁটে শনিবার বা মঙ্গলবারের হাটে যেত।

কোনো কারণে সেদিন বাবা বরুণ বারান্দার বদলে দাড়ি কামানোর সরঞ্জামগুলি পেছনের উঠোনে এনেছিল। মুখে শেভিং ক্রিম ঘষে ঘষে সাদা ফেনাগুলিতে গালটা আধা ইঞ্চি পুরু করে ফেলেছিল। তার পিঠের পেছনদিকে ছিল বাগানটা এবং সামনে ছিল আট দশ ইঞ্চির আয়নাটা। বাগানের সুপারি থেকে বাঁশবন পর্যন্ত সমস্ত কিছু প্রতিবিম্বিত হয়েছিল আয়নাটিতে। উইয়ের ঢিবি এবং ঝরা পাতাগুলি ছাড়া। হঠাৎ বরুণ সেই প্রতিবিম্বের মধ্যে দেখল সুপুরি গাছে কেউ একজন রয়েছে!

ধীরে ধীরে বরুণ মুখটা ধুয়ে ফেলল। তজোকে নিয়ে গজেন্দ্রনাথের চাকর বাহিনীর পাঁচটার মতো সৈন্য এবং হাতে লাঠি, দা, রশি নিয়ে বাগানে সন্তর্পণে ঢুকে পড়ল। রাহুল, নীপা, অনুপ, বিভু রিকিরা সেই সৈন্যদলের পেছনে পেছন নিঃশব্দে বাগানের দিকে এগিয়ে গেল, যেখানে অপার কৌতুহল এবং আনন্দ জমা হয়ে আছে।

তজো বলল,’ওই তো গুণামস্তি।’

পিতা বরুণ ওপরের দিকে তাকিয়ে ডাক দিল –’ ভালোয় ভালোয় নেমে আসবি? না হলে তোকে কোটা দিয়ে টেনে নামাব।’ বরুণ সুপারি গাছটার ওপরে খামচে থাকা গুণামস্তির দিকে তাকানোর সময় আকাশটা দেখতে পায়নি। রাহুল  এবং নীপারা দেখেছিল আকাশে গুণামস্তি বেয়ে উঠছে, যে আকাশে ধপধপ করে দুটো অপরিচিত পাখি উড়ে যাচ্ছে।

একটা জাতি বাঁশের ডগায় কাঁচি বান্ধা প্রকাণ্ড দীর্ঘ ভয়ংকর একটা কোটা রাহুলদের ছিল সুপারি পাড়ার জন্য। দুজন সৈন্য সেই কোটাটা ওপরের দিকে তুলে ধরে গুণামস্তিকে দেখাল। গুণামস্তির  চোখের সামনে কোটাটা নাচালো। আর আকাশের উপরের আস্তরণ একটুখানি ছিঁড়ে গেল।

গুণামস্তি সহজে হার মানার লোক ছিল না। সুপুরি গাছটাতে এভাবে একটি দোল দিল যে গাছটা যেন ভেঙ্গে যাবে, এক গাছ থেকে অন্য গাছে চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে গুণামস্তি আগের সুপারি গাছ থেকে নাই হয়ে গেল। সে অন্য একটি সুপারি গাছের শীর্ষে উঠল। এভাবে সে একটি সুপারি গাছ থেকে অন্য গাছে দোলা দিয়ে ঝাঁপ মেরে বরুণদের দেখাল। রাহুল নীপারা সেই সার্কাস দেখে খুব মজা পেল। আনন্দে ওরা হুল্লোড় করতে লাগল। যদিও বিনা পয়সার সার্কাস ছিল,তজো ভাবল এই সার্কাস গজেন্দ্রনাথকে ডুবিয়ে ফেলতে পারে!

সার্কাস প্রায় শেষ হয় হয়। কেননা এক গাছ থেকে অন্য গাছে লাফাতে লাফাতে গুণামস্তি ক্লান্ত হয়ে পড়ল। বাগানের প্রতিটি সুপারি গাছে লাফিয়ে লাফিয়ে শেষ করল। তারপরে শুধু বাকি রইল আকাশে লাফানো। সেই মুহূর্তে সে যদি কোনো পাখি পেত সে হয়তো পাখির ডানায় চড়ে বহু দূরে কোথাও চলে যেত। কিন্তু তখন গজেন্দ্রনাথের বাগানে কোনো পাখি ছিল না। এত চিৎকার চেঁচামেচি আর সুপারি গাছগুলিতে হওয়া প্রলয়ের পরে পাখি থাকবে কোথায়? পাখিগুলি গজেন্দ্রনাথের পশ্চিমের দিকে থাকা প্রতিবেশী ডেকাদের অযত্নে পড়ে থাকা গভীর এবং কাঁটা গাছের বাগান থেকে গুণামস্তির সার্কাস দেখছিল।

শেষ সুপারি গাছটাতে খামচে ধরে গুণামস্তি ফোঁপাতে শুরু করেছিল। পিতা বরুণ এবং তাঁর সৈন্যদল কোটাটা নিয়ে গিয়ে তার চোখের সামনে নাচালো।

বরুণ বলল,’ ভালো চাস যদি নেমে আয়। না হলে তোর পা টা এখন যাবে।’

সবাই যেমন জানে, তেমনই গুণামস্তিও ধর্মপ্রাণ গজেন্দ্রনাথকে জানে। গজেন্দ্রনাথের বেলের নিচের চায়ের দোকানে সে মাঝে মাঝে লবঙ্গ- চা খায়। গজেন্দ্রনাথের বাড়ির অন্য সদস্যদের স্বভাব প্রকৃতি কী ধরনের তাও সে অনুমান করতে পারে। কিন্তু এই ভুড়িওয়ালা  হিন্দি মাস্টারটা কী প্রকৃতির সে একেবারেই জানে না। সেই জন্যই সে এত সময় সার্কাস দেখালো এবং অবশেষে ভাবল–কী  ঠিক, যদি কোনো অঘটন ঘটে যায়! এই মানুষটা একেবারে বিশ্বাসযোগ্য নয়। এই ভেবে গুনামস্তি হড়হড় করে নেমে এল।

তুচ্ছ একটা চোর সার্কাস দেখিয়ে এত সময় নষ্ট করার জন্য গজেন্দ্রনাথের বড়ো ছেলে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল। সৈন্য দুজনের সাহায্য নিয়ে বরুণ নিজের হাতে নারকেলের রশি দিয়ে গুণামস্তির হাত দুটি পিঠের দিকে শক্ত করে বেঁধে ফেলল।

গুণামস্তি একবার তাকিয়ে বলল,’ নারকেলের রশি দিয়ে বাঁধবেন? এই নারকেলের রশিতে  বড়ো ব্যথা লাগে। অন্য কোনো রশি নেই?

‘ চুপ করে থাক। তোর মুখ ভেঙ্গে দেব’– বরুণ বলল।

‘এটাকে লাইট পোস্টে বেঁধে রাখতে হবে’– একজন সৈন্য ক্ষীণকণ্ঠে বলল। বরুণের ঠিক মনের মতো কথাটাই যেন সে বলে দিল।

রাহুল একবার ভেবেছিল উইয়ের ঢিবিটাকে গুণামস্তি দেখানো সার্কাসের কথাটা জানিয়ে আসবে। কিন্তু গেল না। এই বন‍্য নায়কের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে একটা মধুর মুহূর্তও তার নষ্ট করতে ইচ্ছে হল না।

বরুণ, বরুণের সৈন্যদল এবং রাহুলরা হইচই করে গুণামস্তিকে উঠোনের মধ্য দিয়ে বাড়ির সামনের দিকে অর্থাৎ রাস্তার দিকে টেনে টেনে নিয়ে গেল। উঠোনটা পার হতেই গজেন্দ্রনাথের  ছোটো বৌমা ভানু নতুন ঘরের  বারান্দা থেকে গুণামস্তিকে দেখল। তরুণী পিসি মৃগী রোগ কাবু করে ফেলা তার শরীরটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে সেই চেয়ারে বসেই তাকাল। শশী দেখল চাপাকলের কাছ থেকে, অমৃতপ্রভা উঠানে নেমে এসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল‐- ‘ছেড়ে দে, যা। ওকে কিন্তু মারধর করবি না।’ কিন্তু এই উত্তেজনার মুহূর্তে অমৃতপ্রভার কথা শোনে কে? মালিনীদি সেই মুহূর্তে বাথরুমে ছিল। বরুণ গায়ে ঘষা  পিয়ার্স সাবানের টুকরা চোখের সামনে এনে সাবানের টুকরোর ভেতরটা দেখছিল। দেখছিল সাবানের টুকরোর ভেতরটা কমলা রঙের।

অবশেষে সেদিন সকালের নায়ক গুণামস্তিকে লাইটের খুঁটিতে বেঁধে রাখা হল। এবার তার পেছনদিকে থাকা হাত দুটির গিঁট খুলে সামনের দিকে এনে বাঁধা  হল। দুটো পা আর কোমরটা রশি দিয়ে লোহার শীতল খুঁটিটিতে এভাবে বেঁধে রাখা হল যেন তার পিঠে ভর দিয়ে খুঁটিটা দাঁড়িয়ে রয়েছে।

মিষ্টি জিনিসের ওপরে মাছি পড়ার মতো রাহুলদের সেই শীর্ণ  দলটিও , তাতে আরও দুই একজন যোগ দিল বাবুল- বিনীতা, গুণমস্তিকে ঘিরে ধরল। রাহুল তো একবার গুণামস্তির কাঁধটা ছুঁয়ে দেখল‐ কত শক্তিশালী এই নায়ক, কিছুক্ষণ আগে কী সার্কাস দেখিয়েছিল! তার মাংসল দুই বাহু থেকে ঝরে পড়া ঘামের বিন্দুগুলি দেখে প্রভাত সূর্য সবচেয়ে বেশি আনন্দ লাভ করল। কারণ এই পৃথিবীতে এই সকালে কারও বাহু ঘেমে উঠেনি, যেখানে সূর্য ঝলমল করছে!

লাই পেয়ে গুণামস্তি রাহুলের দিকে তাকিয়ে বলল–’ একটা বিড়ি দাও হে।’

রাহুল বাবাকে বলল–’ বাবা, ওর নাকি বিড়ি চাই।’

‘ বিড়ি লাগে। চলে আয় ওর কাছ থেকে।’– বাবা মুখ ভেঙ্গিয়ে  উঠল। আর মুখের অন্য পাশটিতে শেভিং ক্রিম মাখাতে লাগল।

গজেন্দ্রনাথ সাধারণত হুঁকো টানে। কিন্তু হুঁকো তো যখন তখন খাওয়া যায় না। অন্তত শালগ্রামের জন্য ফুল তোলার সময়, সুপুরি কুড়োনর সময়, বেড়া বাঁধার সময় হুঁকো  খাওয়া যায় না। কিন্তু এসব করার সময় ঠোঁটে একটা বিড়ি নিয়ে কাজটা করার একটা আমেজের কথা গজেন্দ্রনাথ জানে। তাই গজেন্দ্রনাথের বিছানায় বালিশের পাশে আধ প্যাকেটের মতো মলয় বিড়ির চেয়েও শক্তিশালী তুফানি বিড়ি থাকে ।

রাহুল গজেন্দ্রনাথের বিছানার বালিশের পাশ থেকে চুপিচুপি একটা বিড়ি চুরি করে এনে গুণামস্তির বন্দি হাতের মুঠোতে গুঁজে দিল, নীপা ছাড়া আর কেউ ব্যাপারটা জানল না। কিন্তু গুণামস্তি সেটা খাবে কীভাবে ?

রাহুল তজোকে গিয়ে কথাটা বলল। তজোর কাছে গুণামস্তির সমস্যা এবং কুটিল উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়ে গেল। তাই সে বিড়িটা গুণামস্তির  হাত থেকে নিয়ে তার কালো জামের মতো ঠোঁট দুটির মধ্যে গুঁজে দিল। আর দিয়াশলাই আনার জন্য বেলের নিচের চা-এর দোকানে ঢুকল।

গুণামস্তি আরও একটি সার্কাস দেখাল– বিড়িটা এক কৌশলে (মুখটা মেলে) মুখের ভেতরে ঢুকিয়ে নিল এবং বের করে আনল। রাহুল বলল,’ আরও একবার করুন আরও একবার করুন।’

গুণামস্তি আরও দুবার এভাবে করে রাহুলকে বিড়ির দাম দিল।

তজো একটা জ্বলন্ত কাঠি গুণামস্তির বিড়িটার মাথায় লাগিয়ে দিল। গুণামস্তি সজোরে টান দিয়ে নাক দিয়ে ধোঁয়া বের করে দিল– ঈষৎ নীল রঙের।

সেদিন শনিবারের হাট ছিল। হাটে আসা মানুষ গুণামস্তির করুণ অবস্থা দেখে দুই একজন তাকে শুনিয়ে কিছু মন্তব্য করে গেল। দুই একটি চ্যাংড়া ছেলে তাকে খ্যাপাল–’গুণামস্তি গুণামস্তি,আজ যমের হাতে পড়েছ…’

পিতা বরুণ দাড়ি কামিয়ে পিয়ার্স সাবানে স্নান করে ইস্ত্রি করা ধুতি পাঞ্জাবি পরে বজালী রাষ্ট্রভাষা প্রচার সমিতিতে অধ্যক্ষতা করতে বেরিয়ে গেল। তজো সাইকেলের চাকায় পাম্প দিয়ে এনে প্রতিদিন  হেলান দিয়ে রাখা  সেই লাইটের খুঁটিতে আজ গুণামস্তি বাঁধা রয়েছে বলে সাইকেলটা রাখতে পারল না। সাইকেলের স্ট্যান্ড নেই, তাই সাইকেলটা নিয়েই সে দাঁড়িয়েছিল।

বজালী রাষ্ট্রভাষা প্রচার সমিতির অধ্যক্ষ সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল–’ আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত কেউ তাকে ছেড়ে দিবি না।’

এ কথা বলে সাইকেলের প্যাডেলে পা দিয়ে লাফ দিয়ে উঠে অধ্যক্ষ বেল বাজিয়ে মানুষের সাইকেলে উঠে চলে গেল।

বিসন্নলা খালটার ওপরে থাকা কাঠের সেতুটা পার হয়ে বাঁদিকের একপাশের ঢালুতে যখন অধ্যক্ষ সাইকেলটা নামিয়ে দিল, তখন শহীদ ভবনে বিরাজ করছিল নীরবতা। এই শহীদ ভবনেই ক্লাস হত, পরিচয় থেকে বিশারদ পর্যন্ত। প্রচার সমিতির নিজস্ব কোনো ঘর ছিল না। সকাল আটটা থেকে সাড়ে নটা পর্যন্ত সেটি একটি স্কুল, তারপরে সেটি শহীদ ভবন– একটা হলঘর, যেখানে একাঙ্কিকা প্রতিযোগিতা হয়, বজালির সবচেয়ে বড়ো সভাগুলি হয়।

অধ্যক্ষ স্কুলে পৌঁছে দেখল– নাক দিয়ে শব্দ বের করা জগদীশ মাস্টার ‘ এক হৃদয় হো ভারত জননী’ বলে প্রার্থনার শেষ সারিটা গাইছে।

চলবে

একটি বন্য স্বপ্নের অন্ধ যাত্রা ( ৬ষ্ঠ পর্ব) // নীলিম কুমার II অসমিয়া থেকে অনুবাদঃ বাসুদেব দাস

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top