একটি বন্য স্বপ্নের অন্ধ যাত্রা ( ৯ম পর্ব) // নীলিম কুমার II অসমিয়া থেকে অনুবাদ: বাসুদেব দাস

(১৯)
সতিন মায়ের অপ্রেমে বেড়ে ওঠা শশীর মুখে স্থায়িভাবে লেগে থাকা এক ধরনের কারুন্য পাঠশালার সমস্ত মানুষকে, অবশ্য যারা শশীকে দেখেছিল-তাঁরা প্রত্যেকেই ক্রোধ অশান্তিকে পরাজিত করেছিল। তাই শশী ছিল প্রত্যেকেরই প্রিয়। সবাই শশীকে সমীহ করত। গজেন্দ্রনাথ এই পৃথিবীর কাউকে যদি বেশি ভালোবাসত, সে শশী। এই কথা ভানু সহ্য করতে পারত না। ভেতরে ভেতরে ভানু এক জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড হয়ে থাকলেও শশীর সুন্দর ব্যবহার সেই আগুনে জল ঢেলে দিয়েছিল।
কিন্তু একদিন বাড়ির প্রত্যেকেই এবং আত্মীয় স্বজন শশীকে এত ভালবাসার প্রতিশোধ নেবার ভানু কপট সুযোগ পেয়ে গেল। সেদিন গজেন্দ্রনাথ বাড়িতে পিতা চন্ডীচরণ শর্মার বাৎসরিক শ্রাদ্ধের আয়োজন করেছিল। রাতের বেলা সত্যনারায়ণ পুজো।
আগেরদিন কলকাতা থেকে গুয়াহাটিতে এসে পৌছান গজেন্দ্রনাথের দাদা ‘আবাহন’ পত্রিকার সম্পাদক দীননাথ শর্মা এবং ছোটো ছেলে দীপক শর্মার সঙ্গে পাঠশালার উদ্দেশ্যে এসেছিলেন। সঙ্গে এসেছে ‘আবাহন’এর সম্পাদকের বড়ো ছেলে দিলীপ শর্মা এবং বৌমা সুদক্ষিণা শর্মাও। লংপেন্ট-শার্ট পরা দীননাথ গজেন্দ্রনাথের সঙ্গে শিক্ষা-দীক্ষা, চিন্তা-চর্চা কোনোকিছুর সঙ্গেই বিন্দুমাত্র মিল ছিল না। দীননাথ, শ্রাদ্ধ, পূজা-পার্বণে বিশ্বাস করতেন না। তবু গজেন্দ্রনাথ দীননাথকে খুব সম্মান করতেন। দীননাথ গুয়াহাটিতে এলে একবার অন্তত পাঠশালায় আসতেন। কেবল ভাই গজেন্দ্রনাথের সরল,অপাপ মুখটা দেখে যাবার জন্য আসতেন। এই ভ্রাতৃপ্রেম প্রায় নিঃশব্দ ছিল।
দাদার পরিবারকে নিয়ে গজেন্দ্রনাথের বাড়িতে সেদিন দুপুরবেলা অতিথি ছিল প্রায় পঞ্চাশ জন। সমস্ত রানাবান্নার ভার পড়েছিল গজেন্দ্রনাথের বড়ো বৌমা শশীর ওপর। কপালের ঘাম মাটিতে ফেলে মাটির উনুনে খড়ির আগুনে শশী রেঁধেছিল মুগ-মসুরের ডাল, একটা তরকারি (যা বাজালি অঞ্চলে লাব্রা নামে বিখ্যাত) শোল মাছের ঝোল এবং পাঁঠার মাংসের ঝোল। অতিথিরা পরম তৃপ্তি সহকারে মাটিতে পিঁড়ি পেতে খেয়েছিল। দীননাথের পরিবারের এভাবে মাটিতে পিঁড়ি পেতে বসে খাবার অভ্যাস ছিল না।সেইকবে কোন যুগে বামুনকুছির বাড়ির মেঝেতে গজেন্দ্রনাথ-দীননাথ একসঙ্গে মাটিতে পিঁড়ি পেতে বসে খাওয়ার অভ্যাস ছিল, এখন সেটা দীননাথের কাছে ভুলে যাওয়া ইতিহাস। রাহুলের পিতা বরুণ দীননাথদের জন্য আলাদাভাবে চেয়ার-টেবিলে খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। রাহুল-নীপা কাঁচের গ্লাসে তাঁদের জল এনে দিয়েছিল। ভানু কাঁসার থালায় ভাত বেড়ে দিয়েছিল।
কিন্তু ডাল,তরকারি এবং মাছের ঝোল দেওয়ার পরে যখন প্রত্যেককে মাংসের ঝোল দেওয়া হল, প্রত্যেকে নাড়াচাড়া করে রেখে চলে গেল। কথাটা কি? কেউ মাংস মুখে দিল না যে?
দীননাথ-দিলীপ শর্মারা বরুণকে জিজ্ঞেস করল-মাংস কে রান্না করেছিল? -মাংসে মুখে দেওয়া যাচ্ছে না-এত নুন!
বাড়ির প্রত্যেকেই বলাবলি করল-মাংস তো শশীই রেঁধেছিল। শশী তো চিরকালের ভালো রাঁধুনি। কীভাবে কী হল আজ শশীর? শশী নিজেও কিছুই বুঝতে পারছিল না।
কেবল গজেন্দ্রনাথ জানত এই রহস্য। শশী শশী বলে কিছু একটার খোঁজে গজেন্দ্রনাথ রান্নাঘরের দিকে যাওয়ার সময় হঠাৎ তার চোখে পড়েছিল ভানু উতলাতে থাকা মাংসের ঝোলে নুন ঢেলে দেওয়ার দৃশ্য!
অতিথিরা যখন মাংসের ঝোল নুনের জন্য খেতে না পেরে উঠে গিয়েছিল,কলাপাতাগুলি থেকে মাংসের ঝোল মাটিতে ছড়িয়ে পড়েছিল,তখন গজেন্দ্রনাথের আর বুঝতে বাকি রইল না যে সম্পূর্ণ ঘটনাটা ছিল ভানুর ষড়যন্ত্র! গজেন্দ্রনাথ অমৃতপ্রভাকে বলল-‘যা,মাংসের কড়াইটা মালার সঙ্গে নিয়ে গিয়ে পেছনের বাগানে ফেলে রেখে আয়।’
চোখের জল মুছতে মুছতে মালা এবং অমৃতপ্রভা মাংসের কড়াইটা বাগানের দিকে নিয়ে গেল। মালা জিজ্ঞেস করল-‘মা কাজটা কী হল?’
অমৃতপ্রভা বল্ল-‘হয়েছে কিছু একটা। আমি সব কিছুই জানি।’
অগ্নিশর্মা হয়ে গজেন্দ্রনাথ ভানুকে তরুণীর বিছানার কাছে ডেকে নিয়ে গেল। আর দুই গালে দুই চড় বসিয়ে দিয়ে বলল-‘শশীর সঙ্গে কোনোরকম অন্যায় করবি না।’
তরুণীর কঙ্কালটা বিছানায় পাশেই জড়োসড়ো হয়ে শুয়েছিল। সে জাগল না। জাগলে সেও বলে উঠত-বে….বে….বে….বো….বো….বো….।’ অর্থাৎ বেয়া (খারাপ) বৌ!
ধীরে ধীরে সবাই ভুলে যেতে পেরেছিল সেই নুনের কথা। কিন্তু শশীর শরীরের মাংসগুলি চিরদিনের জন্য নোনতা হয়ে পড়েছিল।একথা ভেবে ভেবে যে ‘সম্পর্ক’ বলে কোনো জিনিস নেই।
(২০)
গজেন্দ্রনাথের লবঙ্গের অভাবে বজালীবাসী পুষ্টিহীনতায় ভুগেছিল কিনা সেই খবর করার মতো কেউ ছিল না। কিন্তু লবঙ্গের অভাবে যে দুজন মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগেছিল, সেকথা সত্য। তার একজন হল স্বয়ং গজেন্দ্রনাথ এবং অন্যজন হল রাহুল।গজেন্দ্রনাথ পুষ্টিহীনতায় ভোগার আভাস পেয়েছিল অমৃতপ্রভা, কিন্তু রাহুলের পুষ্টিহীনতার আভাস কেউ পায়নি। এমন কি রাহুলের মা শশীও! কারণ শশী কিছুদিন থেকে এক অচিন পেটের ব্যথার সঙ্গে খেলছিল।
শালগ্রাম থাকা ঠাকুরঘরের চেয়েও সুন্দর গন্ধ বের হওয়া রাহুলের মা বাবার ঘর থেকে এখন ডেটল আর ঔষধের গন্ধ বেরোতে থাকে। বেশিরভাগ সময় শশী সেই গন্ধের মধ্যে যন্ত্রণাকে গর্ভে ধারণ করে থাকে, যে যন্ত্রণা কোনো আকার ধারণ করতে পারে না। যা কেবল ধোঁয়ার মতো ছড়িয়ে যায়। কিন্তু ধূপের ধোঁয়ার মতো এই যন্ত্রণার সুগন্ধ নেই।
সেই ধোঁয়া রাহুল এবং নিপার বুকেও প্রবেশ করে। দুজনেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে–কী হয়েছে মায়ের? মায়ের কী হয়েছে?
নীপা এবং রাহুল যখন সেই স‍্যাঁৎসেতে বিছানায় পড়ে থাকা মায়ের কাছে যায়, শশী তার অসহনীয় যন্ত্রণাকে ঢেকে রাখার জন্য শোওয়া থেকে উঠে বসার চেষ্টা করে। ওদের দেখে হাসার চেষ্টা করে। কিন্তু হাসি কোথায়? সেই হাসি কে কেড়ে নিয়েছে? হাসির একটা সামান্য কণিকাও শশী ওদের দেবার জন্য খুঁজে পায় না। শশীর চোখ থেকে কেবল টপটপ করে অনেক মুক্তো ঝরে পড়ছিল।
কিন্তু মুক্তোর কত দাম রাহুল নীপারা সে কথা তখন জানত না।
ডাক্তারেরও ডাক্তার এসে শশীকে দেখেছিল। তজো এগিয়ে দেওয়া সাবান জলে হাত ধুয়ে নীপার সাহিত্যের খাতার পাতা ছিঁড়ে পেনিসিলিন লিখে দিয়েছিল। শান্তি নামের সেই চিরন্তন গর্ভবতী নার্সটি প্রতিদিন এসে শশীর ডান দিকের কোমরে একদিন বাঁদিকের কোমরে ধবধবে সাদা পেনিসিলিনগুলি ইনজেকশন দিয়ে শরীরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু শশির অপরিচিত লোকের সামনে পেনিসিলিনগুলি পরাজয় স্বীকার করেছিল।
আরও একদিন ডাক্তারেরও ডাক্তার উমেশ ডাক্তার যখন ঘোষণা করল– শশীর ক্যান্সার হয়েছে, তখন রাহুলদের ঘরের উপরে ঝুলতে থাকা আকাশটা অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। তখন ক্যান্সার মানেই মৃত্যু। ক্যান্সার মানেই তখন ডিব্রুগড়। ডিব্রুগড় মেডিকেল কলেজ। তখন ভেলোর ছিল না।
অসম রাজ্যিক পরিবহন নিগমের একটি লাল বাসে একদিন শশীকে বরুণ ডিব্রুগড়ে নিয়ে গেল।
পরিবহন নিগমের বাসস্ট্যান্ডে সেদিন শশীকে এগিয়ে দেবার জন্য অনেক মানুষ জমায়েত হয়েছিল। বাসস্ট্যান্ডের বারান্দায় মানুষ বসা বেঞ্চটির তেলের দাগ লাগা হাত দুটি দিয়ে রাধা মামা এবং হরে কৃষ্ণ মামা চোখের জল বয়ে এসে মাটিতে পড়ছিল। শশীর পিতা নমাতি মৌজার মৌজাদারও এসেছিলেন ঘোড়ার গাড়ি চড়ে। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে পরিবহন নিগমের অচল হয়ে থাকা একটা বাসের চাকার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাঁর প্রথম পত্নীর একমাত্র কন্যা শশীর মুখের দিকে তিনি তাকাতে পারছিলেন না, কারণ সেই মুখে তার প্রথম পত্নীর চোখের আলো লেগে আছে। তাই ডিব্রুগড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা লাল বাসটা আসার আগেই নমাতি মৌজার মৌজাদার ঘোড়া গাড়িতে উঠে পালিয়ে এসেছিলেন যাতে চোখ থেকে কিছু নেমে এসে তার সম্ভ্রম নষ্ট করে ফেলতে না পারে।
দূরের গ্রাম থেকেও কিছু আত্মীয়-স্বজন এসেছিল সেই লাল বাস আড্ডায়। মালিনী দিদি সেদিন রাষ্ট্রভাষা প্রচার সমিতির স্কুলে যায়নি। সেই স্কুলের চৌকিদারও এসেছিল সেখানে। শান্তি নামের নার্সটিও এসেছিল। সঙ্গে ছিল প্রদীপ নামের কুখ্যাত ছেলেটি। সে সেদিন শান্ত হয়েছিল।
পরিবহন নিগমের বাসের গায়ে আঁকা গন্ডারটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল সে। হরেশ্বর দর্জিও সাইকেলে চড়ে এসেছিল।
লাল বাসটি যখন পশ্চিম দিক থেকে আসছিল, কান্নার একটি রোল গাড়িটাকে ঘিরে ধরেছিল। সেই ফোঁপানির মেলায় একটা ভিখারিও যোগ দিতে এসেছিল। সে কারও কাছ থেকে পয়সা চায়নি। রাহুলের পিতা তার বেঁকে যাওয়া সিলভারের বাটিতে একটা চকচকে এক টাকার নোট ফেলে দিয়েছিল।
সবুজ রঙের সিটটাতে বসিয়ে দিয়ে মাথার দিকে একটা বালিশ গুঁজে দিয়েছিল গজেন্দ্রনাথ তার প্রথম পুত্রবধূকে। এই পৃথিবীতে গজেন্দ্র্রনাথ যদি সবচেয়ে বেশি কাউকে ভালোবেসে থাকে সে ছিল শশী ।
একদিন নমাতি মৌজার মৌজাদারের বাড়িতে কোনো একটি কাজে যাওয়ায়, মৌজাদারের সঙ্গে কথা বলার সময় গজেন্দ্রনাথ প্রথমবারের জন্য শশীকে দেখেছিল। সেই অবিবাহিত মেয়েটি একটা পাত্রে কিছু মাছ এবং এক বাটি ছাই সামনে নিয়ে দা দিয়ে মাছ কাটছিল। সঙ্গে সঙ্গে গজেন্দ্রনাথ সংকল্প করে ফেলেছিল সেই মেয়েটিকে তিনি বড়ো ছেলের বউ করে নিয়ে আসবেন। গজেন্দ্রনাথ জেনেছিল যে শশীর মা শৈশবে মারা গিয়েছিল এবং একজন মাসি বিনিময়ের নিয়মে ওদেরকে লালন পালন করেছে যেমন – দুপুরবেলা ভাতের বিনিময়ে একপাত্র মাছ!
আর যখন বরুণের বিয়ের বয়স হল, গজেন্দ্রনাথ বোকো হাইস্কুলে শিক্ষকতা করা এবং আনারকলি নাটকে সেলিম হওয়া বরুণকে ‘বিয়ের তারিখ আমি ঠিক করেছি। বিয়ের দশ দিন আগে আসবি।’ বলে চিঠি লিখে ডেকে পাঠিয়েছিল।
বরুণ জিজ্ঞেস করেছিল,’মেয়ে কে?’
গজেন্দ্রনাথ বলেছিল,’নমাতি মৌজার মৌজাদারের মেয়ে।’
দ্বিতীয় প্রশ্ন করার সাহস তখন বরুণের ছিল না।
সুশীল কষ্ট মোচন করার জন্যই গজলের রাত তাকে পুত্রবধূ করে এনেছিল। আদর করে শশীকে’মাকো’ বলে ডাকত গজেন্দ্রনাথ । শশীর প্রতি এতটা ভালোবাসা দেখে এমনকি অমৃতপ্রভাও মাঝে মাঝে ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ত।
গজেন্দ্রনাথের পা দুটি স্পর্শ করার জন্য শশীর হাত দুটি নিচের দিকে নেমে এসেছিল। কিন্তু যন্ত্রণা শশীকে সেভাবে করতে দিল না।
গজেন্দ্রনাথ বলল,’ লাগবে না মাকো, ব্যথা পাবি, ছেড়ে দে। আমার আশীর্বাদ সব সময় তোর সঙ্গে আছে। আর শালগ্রাম আছে না! আমি এত বছর ধরে দুধ দিয়ে শালগ্রামকে স্নান করিয়ে আসছি– সেই পুণ্য বৃথা যাবে নাকি! তুই ভালো হয়ে যাবি।
গজেন্দ্রনাথ শশীর মাথায় হাতটা রাখল। সেই হাতটাও যেন কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল।
কেউ রাহুল এবং নীপাকে গাড়ির ভেতরে ডাকল। সেটা ছিল একটা হাত। শশির হাত। হাতটা ওদের দুজনকেই কাছে ডেকেছিল। হ্যান্ডেল ধরে দুজনেই উঠে গিয়েছিল মায়ের কাছে। মা দুজনকেই বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেছিল। মায়ের চোখ থেকে টপটপ করে খসে পড়া মুক্তাগুলি রাহুলের শার্ট এবং ফ্রক শুষে নিয়েছিল। মা ওদের একটি গাল টেনে ধরে অন্য গালে চুমু খেয়েছিল। তীব্র জ্বর ছিল শশীর। তাই সেই চুমুটা এত উষ্ণ ছিল, যা রাহুল সারা জীবন ত্বকের নিচে বহন করে নিয়ে চলেছিল। সেই চুমুটা কেউ ঠান্ডা করতে পারেনি। রাহুল লাভ করা অজস্র চুমুর মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিল সেই চুমুটি।
হর্ণ বাজিয়ে ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দেবার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে রাহুলরা নেমে এল। বরুণ কী ভেবেছিল জানা যায় না। তাঁর মুখটা আশ্চর্যজনকভাবে গম্ভীর এবং করুণ হয়ে পড়েছিল।
একজন ক্যান্সার রোগীকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেবার চেষ্টায় অসম রাজ্যিক পরিবহন নিগম সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল। কারণ ভারী চাকা ঘুরিয়ে লাল বাসটি কালো ধোঁয়া ছেড়েছিল এবং রাজপথের উদ্দেশ্যে এগিয়ে গিয়েছিল। বাসের একটা চাকায় লেগে একটা পাথর দূরে ছিটকে পড়েছিল। কালো গণ্ডারটার দিকে তাকিয়ে থাকা প্রদীপকে যেন সেই পাথরটা খ্যাপাচ্ছিল।
লাল বাসটা চোখের আড়ালে চলে না যাওয়া পর্যন্ত লোকেরা বাস আড্ডার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। সেইসবের মধ্যে আরও কয়েকজন ক্যান্সার রোগী ছিল। সে কয়েকজন হল গজেন্দ্রনাথ, রাহুল, নীপা এবং তজো। হ্যাঁ তজোরও ক্যান্সার হয়েছিল।
রাহুল দাদুর ধুতির আঁচল ধরে জিজ্ঞেস করেছিল,’ ও দাদু মা ফিরে আসবে তো? ভালো হয়ে যাবে তো?’
একজন ক্যান্সার রোগী দ্বিতীয়জন ক্যান্সার রোগীকে জিজ্ঞেস করেছিল তৃতীয়জন ক্যান্সার রোগীর কথা।
আর দ্বিতীয়জন বলেছিল–’ফিরে আসবে, ফিরে আসবে, শালগ্রাম সবকিছু ঠিক করে দেবে।’
সেই তপ্ত চুমুটা ত্বকের নিচে নিয়ে রাহুল কোথাও স্থির থাকতে পারছিল না। বাড়িতে ফিরে এসে রাহুল চুপি চুপি ঠাকুর ঘরে ঢুকল। আসনটাতে একান্ত মনে শুয়েছিল ভগবানেরা, একজনও জেগে ছিল না। রাহুল শালগ্রামের গায়ে থাকা ছোটো কাপড়টা সরিয়ে দিল। চন্দনের সঙ্গে তুলসী পাতাটা শালগ্রামের বুকে তখনও লেপ্টে ছিল। রাহুল শালগ্রামটাকে বুকের মধ্যে দুহাতে জড়িয়ে ধরল এবং জিজ্ঞেস করল,’মা ভালো হবে কি…. মা ভালো হবে বল শালগ্রাম!’
শালগ্রাম উত্তর দেয়নি।
এই ভগবানদের একটাই বড়ো সুবিধা যে ওদের কথা বলতে হয় না।
একটি বন্য স্বপ্নের অন্ধ যাত্রা ( ৮ম পর্ব) // নীলিম কুমার II অসমিয়া থেকে অনুবাদঃ বাসুদেব দাস

Facebook Comments

comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

scroll to top